মানুষের মনের ভাব প্রকাশ করার সবচেয়ে সহজতম মাধ্যম হিসেবে ভাষার উৎপত্তি হয়েছিল। কালের বিবর্তনে একটি নির্দিষ্ট ভাষা ব্যবহারকারী মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। একেক অঞ্চলের সেই আদিম মানুষগুলো তাদের ভাষার সহজার্থে ব্যবহার করতো নতুন নতুন রূপ। এভাবে প্রতিটি ভাষার উৎপত্তি হয়েছে সেই অঞ্চলের প্রচলিত সংস্কৃতির উপর নিভর্র করে। বিভিন্ন ভাষার বর্ণ উদ্ভাবনেও দেখা যায় অঞ্চলগত ভিন্নতা। তৈরি হয়েছে ভাষার কথ্য রূপ ও লেখ্য রূপ। সেই কথ্য রূপের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ আঞ্চলিক ভাষা। আঞ্চলিক ভাষা কাকে বলে এবং আঞ্চলিক ভাষা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানতে পারবেন এই লেখাতে।
আঞ্চলিক ভাষা কাকে বলে?
কোন নির্দিষ্ট অঞ্চলের মানুষের কথ্য ভাষাই আঞ্চলিক ভাষা। এটি একটি স্বতন্ত্র ভাষা নয়, বরং একই ভাষার অঞ্চলভেদে ভিন্ন ভিন্ন রূপ।
সাধারণত ভৌগোলিক ব্যবধান, সমাজগঠন, সংস্কৃতি, যোগাযোগ ব্যবস্থা, পেশা ও ধর্মভেদে একটি ভাষার শব্দ, ধ্বনি, উচ্চারন, ব্যাকরন ও বাক্যগঠন রীতি ভিন্ন হয়। তাই ভূপ্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য অনুসারে কালক্রমে গড়ে ওঠে আঞ্চলিক কথ্য ভাষা। একই দেশের মধ্যে এক অঞ্চলের ভাষার সঙ্গে অন্য অঞ্চলের ভাষার ভিন্নতা দেখা দেয়। বাংলাদেশেও বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের কথ্য ভাষা ভিন্ন। অঞ্চলভেদে বাংলা ভাষার বিভিন্ন কথ্য রূপই বাংলার আঞ্চলিক ভাষা। এটি বাংলা ভাষা বৈচিত্র্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
আঞ্চলিক ভাষার অপর নাম কি?
আঞ্চলিক ভাষার অপর নাম উপভাষা। প্রমিত কথ্য ভাষার পাশাপাশি অঞ্চলবিশেষের জনগোষ্ঠী কর্তৃক প্রচলিত ও ব্যবহৃত আঞ্চলিক কথ্য ভাষাই উপভাষা। পৃথিবীর সর্বত্রই উপভাষার ব্যবহার রয়েছে। প্রমিত কথ্য ভাষার সাথে উপভাষার পার্থক্য ধ্বনি, রূপমূল, উচ্চারণ ও ব্যাকরণগত কাঠামোর মধ্যে নিহিত থাকে। একটি উপভাষা দেশের মধ্যে কোন বিশেষ অঞ্চলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে।
আঞ্চলিক ভাষার বৈশিষ্ট্য
প্রতিটি আঞ্চলিক ভাষার সাধারণ কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যথাঃ
- এই ভাষা সাধারণত নির্দিষ্ট অঞ্চলের কথ্য ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তবে, কিছু কিছু আঞ্চলিক ভাষার লিখিত রূপও রয়েছে।
- এই ভাষার উচ্চারণ ও বাক্যগঠন রীতি নিজ নিজ অঞ্চলের উপর নির্ভর করে। স্থান, কালভেদে এটি পরিবর্তনশীল।
- আঞ্চলিক ভাষা একটি জনপদের লোকসংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারক।
- এই ভাষা সম্পূর্নরুপে ব্যাকরনের কঠিন নিয়মনীতি মেনে চলে না।
- এটি প্রাকৃতিক রূপে বংশগতভাবে বিকশিত হয়।
- ভাষার আঞ্চলিক রূপে কিছু কিছু শব্দ সাধু রীতি বা চলিত রীতিতে গৃহীত হয়।
আঞ্চলিক ভাষা ও প্রমিত ভাষার পার্থক্য
আঞ্চলিক ভাষা ও প্রমিত ভাষার মধ্যে ভাবগত, উচ্চারণগত, উৎপত্তিগত ও ব্যবহারিক কিছু পার্থক্য রয়েছে। নিচে তার তালিকা তুলে ধরা হলোঃ
প্রমিত ভাষা | আঞ্চলিক ভাষা |
প্রমিত ভাষা একটি ভাষাভাষী অঞ্চলে সকলের ব্যবহার্য ভাষা। | একটি ভাষাভাষী অঞ্চলের মধ্যবর্তী ক্ষুদ্রতর একটি অঞ্চলে ব্যবহার্য ভাষা। |
সাহিত্যক, শিক্ষিত সমাজ ও ভাষাবিদদের মাধ্যমে পরিমার্জিত হয়ে সর্বজনীনভাবে একটি ভাষার যে রূপটি গৃহীত হয়, তা-ই প্রমিত ভাষা। | কোন রূপায়ণ প্রচেষ্টা ছাড়া একটি ভাষার মৌখিক ব্যবহারের মাধ্যমে পরিবর্তিত রূপই আঞ্চলিক ভাষা। |
প্রমিত ভাষা একটি নির্দিষ্ট ভাষার মার্জিত ও আধুনিক রূপ। | আঞ্চলিক কথ্য ভাষা হলো বংশ-পরম্পরায় পাওয়া আঞ্চলিকভাবে মাতৃভাষী রূপ। |
অঞ্চলভেদে এই ভাষার পরিবর্তিত হয় না। | বিভিন্ন অঞ্চলভেদে ভাষার রূপ পরিবর্তিত হয়। |
এটি একটি ভাষার আদর্শ রূপ। | এটি একটি ভাষার আঞ্চলিক রূপ। |
এই ভাষায় সুনির্দিষ্ট ব্যাকরণবিধি থাকে, যা সম্পূর্ণরূপে মানতে হয়। | এই ভাষায় প্রমিত ভাষা থেকে ব্যাকরণিক ভিন্নতা থাকলেও, এটি কোন সুনির্দিষ্ট ব্যাকরণবিধি অনুসরণ করে না। |
প্রমিত ভাষার কথ্য ও লেখ্য, উভয় রূপই ব্যবহৃত হয় এবং উভয়ই গুরুত্বপূর্ণ। | এই ভাষায় কথ্য রূপটিই অধিক গুরুত্বপূর্ণ। |
প্রমিত ভাষায় শুধুমাত্র শিষ্ট রূপটি-ই গৃহীত হয়। | ভাষার আঞ্চলিক রূপে শিষ্ট ও অশিষ্ট উভয় রূপই ব্যবহৃত হয়। |
এটি নির্দিষ্ট একটি ভাষাভাষী মানুষের মাঝে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। | শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয় না। |
একটি দেশের সরকারি কর্মকান্ডে এই ভাষা ব্যবহৃত হয়। | এটি সরকারি কর্মকাণ্ডে ব্যবহৃত হয় না। |
একটি ভাষার অধিকাংশ সাহিত্য রচিত হয় প্রমিত ভাষায়। | আঞ্চলিক সাহিত্যে এই ভাষা ব্যবহৃত হয়। তবে আঞ্চলিক ভাষাতে সাহিত্যের সংখ্যা খুবই কম। |
বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষা
বাংলাদেশকে বলা হয় ভাষা বৈচিত্র্যের দেশ। ২০১৮ সালে ‘এথনোলগ’ এর ২১ তম সংস্করণ অনুযায়ী বাংলাদেশে ৪১ টি ভাষা প্রচলিত আছে। সকল ভাষাগুলোই জীবিত এবং নির্দিষ্ট অঞ্চলের মানুষের দ্বারা ব্যবহৃত হয়। এতো ভাষার বাসস্থান, এই বাংলাদেশে রয়েছে প্রায় শতাধিক আঞ্চলিক ভাষাও।
বাংলাদেশের অঞ্চলভেদে ভাষার উচ্চারণগত ভিন্নতা বহুকাল পূর্ব থেকেই গড়ে উঠেছে। বর্তমানে দেশের ৬৪টি জেলার নিজস্ব ভাষাভিত্তিক উচ্চারণ লক্ষ্য করা যায়। প্রতিটি জেলার বিভিন্ন উপজেলাতেও আঞ্চলিক কথ্য ভাষার অভ্যন্তরীন ভিন্নতা রয়েছে। তাই বলা যায়, আঞ্চলিক ভাষার বৈচিত্র্যে বাংলাদেশ সমৃদ্ধ।
বিভিন্ন জেলার আঞ্চলিক ভাষা
বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার ভাষায় নানান আঞ্চলিক রূপ খুঁজে পাওয়া যায়। প্রায় প্রতিটি জেলারই আঞ্চলিক কথ্য ভাষা রয়েছে, যেখানে ভাষার উচ্চারণ, ভাষারীতি ও টান ভিন্ন। কিছু জেলাতে আঞ্চলিক ভাষার নিজস্ব রূপ, বিস্তৃত শব্দভান্ডার এতটাই পৃথক যে, তা বাংলা ভাষা থেকে ভিন্ন কোন ভাষা বলে মনে হয়।
পুরান ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশাল, খুলনা, ময়মনসিংহ, রংপুর, সিলেট, নোয়াখালী, রাজশাহী, বগুড়া, কিশোরগঞ্জ, কুষ্টিয়া, সাতক্ষীরা ইত্যাদি জেলার বিশেষ আঞ্চলিক কথ্য ভাষা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানতে পড়তে পারেন বিভিন্ন জেলার আঞ্চলিক ভাষা সম্পর্কে।
বাংলা ভাষার আঞ্চলিকতা ও উপভাষিক প্রকারভেদ
বাংলা ভাষা সমগ্র বাংলাদেশসহ ভারতের কিছু অঞ্চল ধরে ব্যবহৃত হয়। অঞ্চলভেদে এই ভাষার একই শব্দের ভিন্ন ভিন্ন উচ্চারণ হয়। ভাষার এই ভিন্নতার উপর ভিত্তি করে, ‘ভাষাবিদ সুকুমার সেন’ বাংলা উপভাষার শ্রেণীবিন্যাস করেছেন। তার শ্রেণীবিন্যাস অনুযায়ী বাংলা উপভাষা ৫ প্রকার হলেও, বর্তমানে বাংলা ভাষাকে ৮টি উপভাষায় বিভক্ত করা যায়। যথাঃ
- বঙ্গালী উপভাষা
- রাঢ়ী উপভাষা
- ঝাড়খণ্ডী উপভাষা
- বরেন্দ্রী উপভাষা
- রাজবংশী উপভাষা
- সুন্দরবনী উপভাষা
- সিলেটি উপভাষা
- চাঁটগাঁইয়া উপভাষা
নিচে এই উপভাষাগুলোর আঞ্চলিক বিস্তার ও ভাষাভিত্তিক বৈশিষ্ট্যসমূহ তুলে ধরা হলোঃ
বঙ্গালী উপভাষা
বঙ্গালী উপভাষা বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত উপভাষা। ঢাকা, খুলনা, ময়মনসিংহ, বরিশাল, নোয়াখালী বিভাগ, বৃহত্তর কুমিল্লা এবং ত্রিপুরার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে এই উপভাষায় কথা বলা হয়। বঙ্গালী উপভাষার বৈশিষ্ট্যসমূহ হলোঃ
- উ > ও এবং এ > অ্যা ধ্বনি হিসেবে উচ্চারণ করা হয়। যেমন: সুতা > সোতা, কেন > ক্যান ইত্যাদি।
- এই উপভাষার বহুবচন পদ গঠিত হয় গুল, গুলাইন শব্দ দিয়ে। যেমন: মাছ গুল কাটো।
- গৌণ কর্ম কালে ‘রে’ বিভক্তি হয়। যেমন- আমারে মারে ক্যান।
রাঢ়ী উপভাষা
পশ্চিমবঙ্গের হুগলী, হাওড়া, কলকাতা, উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা, পূর্ব বর্ধমান, নদীয়া ও মুর্শিদাবাদ জেলায় এটি ব্যবহৃত হয়। এই আঞ্চলিক ভাষা/ উপভাষাকে কেন্দ্র করেই প্রমিত বাংলা ভাষা গঠন করা হয়েছে। রাঢ়ী উপভাষার বৈশিষ্ট্যসমূহ হলোঃ
- ‘অ’ > ‘ও’ রূপে উচ্চারণ করা হয়। যেমন: মধু > মোধু ইত্যাদি।
- শব্দের ‘ন’ > ‘ল’ রূপে এবং ‘ল’ > ‘ন’ রূপে উচ্চারণ করা হয়। যেমন: লেবু > নেবু, নৌকা > লৌকা ইত্যাদি।
- কর্তৃকারকের বহুবচনে- গুলি, গুলো এবং অন্য কারকের বহুবচনে ‘দের’ বিভক্তি হয়। যেমন: আমগুলো, প্রানীদের।
ঝাড়খণ্ডী উপভাষা
এটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ঝাড়গ্রাম, ঝাড়খণ্ডের বোকারো, পশ্চিম মেদিনীপুর, পশ্চিম বর্ধমান, পুরুলিয়া, ওড়িশা ইত্যাদি জেলায় ব্যবহৃত উপভাষা। ঝাড়খণ্ডী উপভাষার বৈশিষ্ট্যসমূহ হলোঃ
- প্রায় সকল শব্দে ‘ও-কার’ লুপ্ত হয়ে ‘অ-কারে’ পরিণত হয়। যেমন: ভালো > ভাল ইত্যাদি।
- ক্রিয়াপদে ‘ক’ প্রত্যয়ের প্রয়োগ বেশি হয়। যেমন: বলবেক, খাবেন ইত্যাদি।
- নামধাতুর ব্যবহার অনেক বেশি হয়। যেমন: গঁধাচ্ছে।
বরেন্দ্রী উপভাষা
বাংলাদেশের দক্ষিণে দিনাজপুর রাজশাহী বিভাগে এবং উত্তরবঙ্গের মালদহে বরেন্দ্রী উপভাষা ব্যবহৃত হয়। বরেন্দ্রী উপভাষার বৈশিষ্ট্যসমূহ হলোঃ
- অপ্রত্যাশিত স্থানে ‘র’ ধ্বনির আগমন হয় বা লোপ পায়। যেমন: রস > অস, আম > রাম ইত্যাদি।
- গৌণকর্মে ‘ক/কে’ বিভক্তি লক্ষ্য করা যায়। যেমন- আমাকে দাও।
রাজবংশী উপভাষা
বঙ্গালী ও বরেন্দ্রী উপভাষার মিশ্রণে রাজবংশী উপভাষার উদ্ভব হয়েছে। বাংলাদেশের রংপুর বিভাগের কিছু জেলা, দিনাজপুর, পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, আসামের বঙাইগাঁওয়ে এটি ব্যবহৃত হয়। রাজবংশী উপভাষার বৈশিষ্ট্যসমূহ হলোঃ
- যৌগিক ক্রিয়াপদে ‘খোয়া’ ধাতু ব্যবহৃত হয়। যেমন: রাগ করা > আগ খোয়া।
- কখনো কখনো ‘ও’ ধ্বনি ‘উ’ রূপে উচ্চারিত হয়। যেমন: বোন > বুন, শোন > শুনে ইত্যাদি।
- শব্দে ‘ড় > র’ এবং ‘ন > ল’ এর বিপর্যয় ঘটে। যেমন: পড়ি > পরি, জননী > জলনী ইত্যাদি।
- শব্দের আদিতে ‘অ’ ধ্বনি ‘আ’ রূপে উচ্চারিত হয়। যেমন: অসুখ > আসুখ, নড়া > নাড়া ইত্যাদি।
সুন্দরবনী উপভাষা
বাংলাদেশের সাতক্ষীরা ও যশোর জেলা এবং পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা এবং নদীয়া জেলার দক্ষিণ অংশে এই উপভাষা ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশের খুলনা ও যশোর জেলায় বঙ্গালী উপভাষা এবং ভারতের কলকাতায় বাংলা ভাষীদের মাঝে রাঢ়ী উপভাষা মধ্যবর্তী ভাষা। এর বাচনভঙ্গি রাঢ়ী এবং বঙ্গালী উপভাষার বৈশিষ্ট্য থেকে ভিন্ন। তাই এটি একটি আলাদা উপভাষা হিসেবে বিবেচিত হয়। সুন্দরবনী উপভাষার বৈশিষ্ট্যসমূহ হলোঃ
- ক্ষেত্র বিশেষে এই ভাষার ক্রিয়াপদের শেষে ‘তি/ কে/ গে/ গি’ বিভক্তি হয়। যেমন: দৌড়ে দৌড়ে > দৈর্গে দৈর্গে, নদীতে > নদীতি, ডুবে > ডুইবগে, তারাতারি > জলদি করি ইত্যাদি।
- ক্রিয়াপদের শেষে ‘এ’ এর স্থলে ‘এ্যা’ বিভক্তি হয়। যেমন: করে > কোইর্যা ইত্যাদি।
সিলেটী উপভাষা
বাংলাদেশের সিলেটের সুরমা উপত্যকা এবং ভারতের আসাম রাজ্যের বরাক উপত্যকা ও হোজাই জেলায় এই ইন্দো-আর্যীয় উপভাষা ব্যবহৃত হয়। বাংলা ভাষার মূল রীতির সাথে এর বহু পার্থক্য দেখা যায়। সিলেটী উপভাষার বৈশিষ্ট্যসমূহ হলোঃ
- মহাপ্রাণতা লোপ পাওয়ার দরুন উচ্চ টোনের উদ্ভব হয়।
চাটগাঁইয়া উপভাষা
এটি ইন্দো-আর্য ভাষাগোষ্ঠির একটি সদস্য উপভাষা। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়িতে চাটগাঁইয়া উপভাষা ব্যবহৃত হয়। প্রমিত বাংলা ভাষার সাথে এর শব্দগত মিল থাকলেও এটি বিভিন্নভাবে এটি স্বতন্ত্র ভাষার বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। চাটগাঁইয়া উপভাষার বৈশিষ্ট্যসমূহ হলোঃ
- ‘ক’ কে ‘হ’ উচ্চারণ করা হয়। যেমন: কথা > হতা।
- ‘না-বোধক’ অব্যয় সর্বদা ক্রিয়াপদের পূর্বে বসে। যেমন: খাবো না > ন খাইয়ুম।
- উপসর্গ, অনুসর্গ এবং অন্যান্য উপায়ে শব্দের কলেবর ও বাক্যের কাল পরিবর্তিত হয়।
- শব্দের মধ্যস্থিত ‘ব’ লোপ পায়। যেমন: যাবো > যাইয়ুম।
- শব্দের মধ্যস্থিত ‘ম’ আনুনাসিক চন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। যেমন: আমার > আঁর।
- অনেক সময় ‘র’ কে ‘ল’ উচ্চারণ করা হয়। যেমন: শরীর > শরীল।
প্রমিত ভাষা থেকে আঞ্চলিক ভাষায় রূপান্তর
বাংলাদেশের সকল বিভাগের বিখ্যাত আঞ্চলিক কথ্য ভাষার কিছু বাক্য এবং তা প্রমিত ভাষায় রূপান্তর করে নিচে তুলে ধরা হলোঃ
(১) ঢাকাইয়া ভাষার বাক্য
প্রমিত ভাষা: মনে হচ্ছে ভালোই আছো।
ঢাকাইয়া ভাষা: বালাই আছচ মনে অইবার লাগছে।
প্রমিত ভাষা: আরে ভাই, তুমিও দেখি আমাদের মতো কথা বলছো!
ঢাকাইয়া ভাষা: আবে বেটা, তুমিও দেহি আমগো লাহান কতা কইবার লাগছো!
(২) চট্টগ্রামের ভাষার বাক্য
প্রমিত ভাষা: আমি এই কাজটি গতকাল করেছি।
চট্টগ্রামের ভাষা: আঁই হাম ইয়ান গেলদে হালিয়ে গইরগি।
প্রমিত ভাষা:আমার ভালো লাগছে না।
চট্টগ্রামের ভাষা: আঁত্তে গম ন লা’র।
(৩) সিলেটি ভাষার বাক্য
প্রমিত ভাষা: শহরের চেয়ে গ্রাম সুন্দর।
সিলেটি ভাষা: টাউনেত্তোন গাউ সুন্দর।
প্রমিত ভাষা: কোথায় যাচ্ছেন?
সিলেটি ভাষা: খই যাইতরায়?
(৪) বরিশালি ভাষার বাক্য
প্রমিত ভাষা: তার একটি ছেলে আছে।
বরিশালি ভাষা: হের এউক্কা পোলা আছে।
প্রমিত ভাষা: ও মনু, তোগো বাড়ি কোম্মে?
বরিশালি ভাষা: তোমার বাড়ি কোথায়?
(৫) নোয়াখালী ভাষার বাক্য
প্রমিত ভাষা: আপনি এখন কোথায় যাবেন।
নোয়াখালী ভাষা: আন্নে হনে কোঁনাই যাইবেন।
প্রমিত ভাষা: পেঁপে স্বাস্থ্যের জন্য ভালো।
নোয়াখালী ভাষা: হাইয়াগুন শইলেল লাইগ্গা বালা।
(৬) ময়মনসিংহের ভাষার বাক্য
প্রমিত ভাষা: বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি রাষ্ট্র।
ময়মনসিংহের ভাষা: বাংলাদেশ দহিন এশিয়ার একটা রাইষ্ট্র।
প্রমিত ভাষা: পর্যায়ক্রমে বাংলার পরে ইংরেজি ক্লাস হলো।
ময়মনসিংহের ভাষা: লাগালাগাই বাংলার ফরে ইংরেজি কেলাস হইলো।
(৭) রাজশাহী ভাষার বাক্য
প্রমিত ভাষা: এই দেখে চলতে পারেন না?
রাজশাহীর ভাষা: মামুর বুঠা, দেইখা চ্যাইলতে পারছিসনা?
প্রমিত ভাষা: সবাই কথাগুলো বুঝবে না।
রাজশাহীর ভাষা: সবাই কথাগুইলান বুইঝবে নাখো।
(৮) খুলনার ভাষার বাক্য
প্রমিত ভাষা: ভালোবাসা না থাকলে, কেন ফিরে আসো?
খুলনার ভাষা: ভালবাসা না-ই যদি থাহে, তালি কও, ক্যান আসো ফিরে?
প্রমিত ভাষা: আমাদের খুলনা জেলার মানুষ অনেক সরল।
খুলনার ভাষা: আংগা জিলা খুলনাইয়ার মানুষ বড্ড সুজা।
(৯) রংপুরের ভাষার বাক্য
প্রমিত ভাষা: এই যে ভাই, আমাদেরকে যেতে দিন।
রংপুরের ভাষা: ও বাহে, হামাকগুলাক যাইতে দিন।
প্রমিত ভাষা: তোমাদের চিন্তা করতে হবে না।
রংপুরের ভাষা: তোমারগুলাক চিন্তা করা নাইগবার নয়।
বাংলার লোকসাহিত্য ও আঞ্চলিক ভাষা
বাংলাদেশের অধিকাংশ লোকসাহিত্য গড়ে উঠেছে আঞ্চলিক ভাষায়। প্রাচীনকাল থেকে মানুষ নিজেদের তথ্য ভাষা ব্যবহার করে লোক সাহিত্য সমৃদ্ধ করতে আবেদন রেখেছে। লোকসাহিত্যের সেই অনন্য উপাদানগুলো, যেমন: মহাকাব্য, কবিতা ও নাটক, লোকগল্প, পুঁথি, শোলক, প্রবাদ বাক্য, গীতি কাব্য, লোকগীতি, বাউল গান, মরমী সংগীত, ভাওয়াইয়া, যাত্রাপালা, হয়লা বা সয়লা, ভাটিয়ালি, গম্ভীরা, কবিগান, জারিগান, সারিগান, গীতিকা ইত্যাদি ভাষার আঞ্চলিক রূপেই তৈরি।
লোকসংগীতের ভান্ডার হিসেবে, ঐতিহাসিক কাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বাংলা ভাষার আঞ্চলিক রূপে রচিত হয়েছে কয়েক হাজার লোকসংগীত। বর্তমান আধুনিক সময়ে এসেও বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতি প্রায় সম্পূর্ণরূপ এই আঞ্চলিক ভাষার উপরই নির্ভরশীল। আঞ্চলিক রূপ ছাড়া বাংলার এই সাহিত্য, সংগীত ও সংস্কৃতির ভান্ডার খুবই সামান্য।
বাংলার আঞ্চলিক ভাষার উচ্চারণগত বৈচিত্র্য
সমগ্র বঙ্গদেশের বাংলা ভাষাকে অঞ্চলভেদে কয়েকটি উপভাষায় বিভক্ত করা হয়েছে। এ সকল উপভাষিক অঞ্চলের মধ্যে যে জেলাগুলো অবস্থিত রয়েছে, সেই জেলাগুলোতেও উপভাষার নানান জেলাভিত্তিক ও অঞ্চলভিত্তিক আঞ্চলিকতা প্রকাশ পায়। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের ও নিকটস্থ ভারতের বাংলাভাষী অঞ্চলগুলোর বাক্যগঠন রীতি ও উচ্চারণে বৈষম্য দেখা যায়।
উদাহরণস্বরূপ, প্রমিত/ শুদ্ধ বাংলা ভাষায়- ‘একজন মানুষের দুটি ছেলে ছিল’, এই বাক্যটিকে বঙ্গদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যে ভিন্ন ভিন্ন রূপে ব্যবহার করা হয়, তা নিচে তুলে ধরা হলোঃ
উপভাষার নাম | কথ্যভাষী অঞ্চলের নাম | আঞ্চলিক ভাষায় বাক্য |
উত্তরবঙ্গের উপভাষা | দিনাজপুর | অ্যাক জন মানুষের দুই ছাওয়া ছিল। |
বগুড়া | অ্যাক ঝনের দুই ব্যাটা ছৈল আছলো। | |
রংপুর | অ্যাক জন মানষের দুইকনা ব্যাটা আসিল। | |
রাজশাহী | অ্যাক লোকের দুইড্যা ব্যাটা ছিলো। | |
পাবনা | কোনো মানষের দুই ছাওয়াল ছিল। | |
জয়পুরহাট | অ্যাকটা মানষের দুটা ব্যাটা আছল। | |
মালদা | অ্যাক ঝন মানুসের দুটা ব্যাটা আছল। | |
দক্ষিণবঙ্গের উপভাষা | খুলনা | অ্যাক জন মানষির দুই সোয়াল সিলো। |
বাগেরহাট | অ্যাক জন মানষির দুই সাওয়াল সিলো। | |
ফরিদপুর | কেরো মানষের দুগ্গা পোলা সিলো। | |
বরিশাল | অ্যাক জোন মানষের দুগ্গা পোলা আসিলো। | |
চুয়াডাঙ্গা | অ্যাক জন লোকির দুইটো সেইলে সিলো। | |
যশোর | অ্যাক জোনের দুটো সোল সিলো। | |
সাতক্ষীরা | অ্যাক লোকের দুডি সাবাল সেলো। | |
কুষ্টিয়া | অ্যাক মান্ষের দুডি সেইলে সিলো। | |
পূর্ববঙ্গীয় উপভাষা | চট্টগ্রাম | অ্যাগুয়া মাইনষের দুয়া ফুয়া আসিল। |
নোয়াখালীর হাতিয়া দ্বীপ অঞ্চল | একজন মাইনসের দুগা হোলা আছিল। | |
নোয়াখালীর ছাগলনাইয়া অঞ্চল | একজনের দুই হোলা আছিল। | |
নোয়াখালীর রামগঞ্জ অঞ্চল | একজনের দুই হুত আছিল। | |
বৃহত্তর নোয়াখালীর ফেনী অঞ্চল | ডিম মেনশের দুগা হোলা আছিলো। | |
নোয়াখালীর সন্দ্বীপ অঞ্চল | এক শকস’র দুই বেটা আসিলো। | |
কুমিল্লা | অ্যাক ব্যাডার দুই ফুৎ আসিল। | |
সিলেটের পশ্চিম অঞ্চলের ভাষা | কোনো মানুষর দুই ফুয়া আসিল। | |
সিলেট | অ্যাকজন মানুষর দুগুয়া ফুয়া আসিল। | |
মুন্সীগঞ্জ | অ্যাক জনের দুইডা পোলা আসিলো। | |
মানিকগঞ্জ | অ্যাক জনের দুইডী ছাওয়াল আছিলো। | |
ময়মনসিংহ | এক জনের দুই পুৎ আছিল। | |
পশ্চিমবঙ্গীয় উপভাষা | মানভূমি | অ্যাক লোকের দুটা বেটা ছিলো। |
পশ্চিম বর্ধমান জেলা | কোনো লোকের দুইটি ছেলে ছিলো। | |
পশ্চিম মেদিনীপুর | গোতে লোকের দুইটা তোকা থিলো। | |
রাজবংশী উপভাষা | গোয়ালপাড়া | অ্যাক জনকার দুই ব্যাটা আসিল। |
রংপুর | অ্যাকজন মানষের দুইকনা ব্যাটা আসিন। | |
কোচবিহার জেলা | অ্যাক জনা মানসির দুই কোনা ব্যাটা আছিল। | |
জলপাইগুড়ি জেলা | অ্যাক ঝনকার দুই ঝন ব্যাটা আছিল। | |
দার্জিলিং জেলা | অ্যাক ঝনকার দুইটা ব্যাটা ছিলো। | |
অন্যান্য উপভাষা | অসমীয়া | এজন মানুহব দুজন পুতেক আছিল। |
মাল পাহাড়িয়া | অ্যাক ঝঁণঁর দুইট বেটা আছল্যাক। | |
দোভাষী | এক আদমের দুই আওলাদ ছিল। | |
সাধু ভাষা | কোন এক ব্যক্তির দু’টি পুত্র ছিল। | |
চাকমা | এক জনতুন দিবা পোয়া এল। | |
হাজং | একজন মানলগ দুইদা পলা থাকিবার। |
আঞ্চলিক ভাষার অভিধান
পৃথিবীর অন্যান্য ভাষা থেকে বাংলা ভাষা অনেক বেশি বৈচিত্র্যপূর্ণ। অঞ্চলভেদে, ভৌগোলিক অবস্থা ও বিদেশী ভাষা সংস্কৃতির প্রভাবে বাংলা ভাষাতেই বিভিন্ন জেলার আঞ্চলিক রূপ পায়। বাংলাদেশ ছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ এই ভাষায় নিজেদের আঞ্চলিক কথ্যরূপ হিসেবে ব্যবহার করে। এই সকল অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষার বৈচিত্র্য সম্পর্কে জানতে বাংলাদেশের অঞ্চলভিত্তিক ভিন্নধর্মী শব্দগুলো জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশসহ সমগ্র বাংলাভাষী অঞ্চলে ব্যবহৃত বাংলার আঞ্চলিক শব্দগুলোর সঠিক রূপ এবং শুদ্ধ ও প্রমিত বাংলায় শব্দের অর্থসহ, বাংলা একাডেমী কর্তৃক সরকারিভাবে একটি এটি অভিধান প্রকাশিত হয়েছে। অভিধান টির নামকরণ করা হয়েছে, “বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান”। এই অভিধানটি সম্পাদনা করেছেন ভাষাবিদ ‘ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ’।
এই বইটিতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সর্বমোট ১ লক্ষ ৬৬ হাজার ২৪৬টি আঞ্চলিক শব্দ রয়েছে। ১২৯৩ পৃষ্ঠার এই বইটিতে সকল আঞ্চলিক শব্দের উচ্চারণ, শুদ্ধ/ প্রমিত রূপ রয়েছে। এটি বাংলা ভাষার বৈচিত্র্যকে সকলের কাছে সহজবোধ্য করেছে। অধিকাংশ আঞ্চলিক কথ্য ভাষাই বর্তমানে দুর্বল হয়ে পড়ছে। ভবিষ্যতে কখনো এই ভাষাগুলো হারিয়ে গেলে বা ভাষার মৃত্যু হলে, ঐতিহাসিকভাবে এই অভিধান ব্যবহার করা যাবে।
আঞ্চলিক ভাষার মৃত্যু
আদিকাল থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের যে ভাষাগুলো বিরাজমান ছিল বর্তমান সময়ে তার অনেকগুলোই বিলুপ্ত। শুধু বাংলা ভাষার আঞ্চলিক রূপই নয়, পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে থাকা ৭,১০০ ভাষার রয়েছে কয়েক হাজার উপভাষা। তবে ধীরে ধীরে আঞ্চলিক ভাষাসহ বহু বিখ্যাত ভাষাও হারিয়ে যাচ্ছে। প্রাচীন সেই কর্নিশ ভাষা, ম্যারিঞ্জার ভাষা এখন লুপ্তপ্রায়। এরকম হাজারো ভাষা কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে যুগে যুগে। কিছু আঞ্চলিক ভাষার নিজস্ব বর্ণমালাও ছিল, বর্তমানে তার কোন অস্তিত্ব নেই।
বাংলাদেশেরও বিভিন্ন জেলার প্রত্নতাত্ত্বিক অঞ্চলের আঞ্চলিক কথ্য ভাষার হাজারো শব্দ এখন বিলুপ্ত। শব্দবিলুপ্তি এবং ব্যবহারকারীর সংখ্যা কমতে থাকলে একটি ভাষা বিলীন হওয়া বা মৃত্যুর দিকে অগ্রসর হয়। ভাষা গবেষকদের মতে, কোন ভাষার সক্রিয় ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৫০ হাজারের কম হলে, সেই ভাষার বিলুপ্তি সন্নিকটে। স্বাভাবিক অর্থে, যখন কোন ভাষা তার শেষ মাতৃভাষী বক্তাকে হারায়, অর্থাৎ মাতৃভাষা হওয়া সত্ত্বেও যখন কেউ সেই ভাষা ব্যবহার করে না, তাকে ভাষার মৃত্যু বলা হয়।
ভাষার মৃত্যু বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। যেমন:
- ধারাবাহিকভাবে ভাষার মৃত্যু বা ক্রমশ ব্যবহারকারী কমতে থাকা।
- ভিত্তিগত ভাবে ভাষার মৃত্যু।
- নিম্ন স্তরের পরিবেশ থেকে ভাষার মৃত্যু শুরু হয় উপরের স্তরে যাওয়া। যেমন- একটি বাড়িতে ভিন্ন ভাষা ব্যবহার করলে, ধীরে ধীরে সমগ্র গ্রামবাসী মাতৃভাষা ছেড়ে সেই ভাষা ব্যবহার করলে।
- সরকারিভাবে কোন ভাষায় নিষেধাজ্ঞা জারি করার মাধ্যমে ভাষার মৃত্যু।
আঞ্চলিক ভাষার মৃত্যু বিভিন্ন ক্ষেত্রে উপভাষা এবং প্রধান ভাষাকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে।
আঞ্চলিক ভাষার হারিয়ে যাওয়ার কারন
ভাষা হারিয়ে যাওয়ার প্রধান কারণ হলো- সেই ভাষা ব্যবহারকারী সম্প্রদায় অন্য কোন ভাষায় দ্বিভাষিক হয়ে যাওয়া। তারপর ক্রমশ নতুন ভাষার ব্যবহারকারী হয়ে মূল ভাষা পরিত্যাগ করা। বর্তমানে সামাজিক মূল্যবোধ, আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা, আধুনিক সংস্কৃতি চর্চার জন্য বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ প্রমিত বা শুদ্ধ বাংলা ভাষাকে প্রধান ভাষা হিসেবে গ্রহণ করছে। এছাড়াও কথাবার্তায় বিদেশী ভাষা প্রয়োগ করার কারনে আঞ্চলিক ভাষাগুলো ধীরে ধীরে লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
শুধু প্রমিত ভাষা চর্চাই আঞ্চলিক কথ্য ভাষা হারিয়ে যাওয়ার কারণ নয়। বরং দেশের এক অঞ্চলের মানুষের অন্য অঞ্চলের ভাষা নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ, অবহেলা এবং অপব্যবহারও এর অন্যতম প্রধান কারণ। তাছাড়া ঐতিহাসিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক কিংবা ভৌগোলিক টানাপোড়েনে এবং বেতার, পত্রিকা, ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের প্রসারে আঞ্চলিক ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে।
আঞ্চলিক ভাষার গুরুত্ব
প্রতিটি মানুষের মনের ভাব, আবেগ, অনুভূতি, চিন্তা, চেতনা, অভিব্যক্তি ইত্যাদি প্রকাশের সবচেয়ে বড় বাহন হচ্ছে ভাষা। আমরা বাঙালিরা জন্মসূত্রেই বাংলা ভাষায় কথা বললেও, বাংলা ভাষার মধ্যে থাকা আঞ্চলিক কথ্য ভাষাই মূলত আমাদের প্রধান মাতৃভাষা। আর নিজের মাতৃভাষা ভাষায় কথা বলেই ভাব প্রকাশের পরিপূর্ণ স্বাদ পাওয়া যায়
আঞ্চলিক ভাষা শুধুমাত্র একজন মানুষের মনের ভাব প্রকাশের আঞ্চলিক রূপই নয়। বরং এটি একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের মানুষের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অন্যতম ধারক ও বাহক। ভাষাভিত্তিক আঞ্চলিকতা আমাদের মধ্যে বিকশিত করে সুশৃংখল সামাজিকতা। বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষা সমগ্র বাংলা ভাষার শব্দ ভান্ডারকে প্রসারিত করে। ভাষার আঞ্চলিক রূপ আমাদের বিনোদনের অন্যতম মাধ্যমও। হাজারো সাহিত্য, লোকসংগীত, প্রবাদ-প্রবচন, কবিতা, নাটক, ঐতিহাসিক মতবাদ বা উক্তি এবং লোকসংস্কৃতির ধারক এই আঞ্চলিক ভাষা।
মূলত আঞ্চলিক ভাষা কোনো ভাষার বিকৃত রূপ নয়। বরং এটি একটি ভাষার বৈচিত্র্য ও ভাষার সৌন্দর্য্য। সকল আঞ্চলিক রূপের সমন্বয়েই বাংলা ভাষা পূর্ণতা পায়। তাই একটি আঞ্চলিক কথ্য ভাষাকে অবহেলা বা অবজ্ঞা করা মূলত সমগ্র বাংলা ভাষার অঙ্গহানির শামিল। কিন্তু বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে কথিত শিক্ষিত সমাজে, কোন প্রমিত বাংলা ভাষায় কথা বলতে না পারলে এবং আঞ্চলিক কথ্য ভাষায় কথা বললে, তাকে তিরস্কার শুনতে হয়। কখনো কখনো তা অমার্জিত, অশিক্ষিত, মূর্খতা হিসেবেও দেখা হয়।
কিন্তু প্রতিটি মানুষ তার মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং সে ভাষায় কথা বলতে গর্ববোধ করে। আঞ্চলিক ভাষার মাধ্যমে মানুষ তার মাতৃভাষারই প্রকাশ ঘটায়। তাই আমাদের সকলেরই উচিত প্রত্যেকের আঞ্চলিক মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া।
শেষকথা
একটি দেশের সকল অঞ্চলজুড়ে ভাষার উচ্চারণে যেই ভিন্নতা, তা অনেকেই আয়ত্ত করতে পারে না। মূলত সেই ভাষা বৈচিত্র্যকে সহজবোধ্য করতেই তৈরি করা হয়েছিল ভাষার প্রমিত রূপ। বাস্তবিক অর্থে প্রমিত বাংলা ভাষা প্রয়োজনীয়তাই পূরণ করে, এটি কোন ফ্যাশন নয়। শিক্ষিত সমাজের কেউ যদি কোন আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে না পারে, তা কি অশিক্ষা, মূর্খতা বলা যাবে? যদি বলা না যায়, তাহলে আঞ্চলিক ভাষাকেও অবজ্ঞা করা যাবে না। বরং আঞ্চলিক বাংলা ভাষার ব্যবহারকারী হয়ে পাশাপাশি প্রয়োজন অনুসারে প্রমিত ভাষা আয়ত্ত করতে হবে।