আঞ্চলিক ভাষা প্রতিটি মানুষের প্রধান ও প্রাথমিক মাতৃভাষা। আমাদের প্রধান কথ্য ভাষা বাংলা হলেও প্রকৃতপক্ষে বিভিন্ন জেলার আঞ্চলিক ভাষাই মনের ভাব প্রকাশের সর্বোত্তম মাধ্যম। বর্তমানে বাংলাদেশে ৪১ টি জীবিত ভাষা রয়েছে। এছাড়াও অঞ্চলভেদে রয়েছে বহু আঞ্চলিক ভাষা।
ভাষা গবেষণা বিষয়ক প্রতিষ্ঠান এথনোলগের সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩ ভাগ, অর্থাৎ প্রায় ২৮ কোটি ৫০ লক্ষ্য মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে। বাংলা ভাষার এই বিশাল ব্যবহারকারী জনস্রোত দেশ ও দেশের বাইরে বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থান করে। ফলে অঞ্চলভেদে একই বাংলা ভাষার উচ্চারণ, বাচনভঙ্গি, টান ভিন্ন হয়।
আঞ্চলিক ভাষা অবহেলার উপাদান নয়, বরং এটিই স্বদেশী ভাষার গৌরব। বাংলাদেশের এই আঞ্চলিক ভাষা অনেক বেশি বৈচিত্র্যময়। সেই বৈচিত্র্যময় বিভিন্ন জেলার আঞ্চলিক ভাষার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতেই আজকের এই প্রবন্ধ।
আঞ্চলিক ভাষা কী?
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের কথ্য ভাষা ভিন্ন। অঞ্চলভেদে বাংলা ভাষার বিভিন্ন কথ্য রূপকেই আঞ্চলিক ভাষা বা উপভাষা বলে।
সাধারণত কোনো ভাষার অঞ্চলভেদে এবং ভৌগোলিক ব্যবধান, সংস্কৃতি, সমাজগঠন, যোগাযোগ ব্যবস্থা, পেশা ও ধর্মভেদে সেই ভাষার শব্দ, ধ্বনি, উচ্চারন ও ভাষারীতি ভিন্ন হয়। তাছাড়া বাংলা ভাষার প্রমিত শব্দের সাথে বিভিন্ন অঞ্চলের আঞ্চলিক শব্দের ভিন্নতা থাকে। এগুলো বাংলা ভাষা বৈচিত্র্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং আঞ্চলিক ভাষা নামে পরিচিত।
আঞ্চলিক ভাষা একটি স্বতন্ত্র ভাষা নয়। এটি একই ভাষার অঞ্চলভেদে ভিন্ন ভিন্ন রূপকে বুঝায়।
বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার আঞ্চলিক ভাষা
বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি জেলারই আঞ্চলিক ভাষা রয়েছে। দেশের বিভিন্ন জেলায় বাংলা ভাষার উচ্চারণ, ভাষারীতি, টান ভিন্ন। এমনকি কিছু কিছু জেলার মধ্যবর্তী উপজেলা গুলোতেও ভিন্ন ভিন্ন ভাষা পরিলক্ষিত হয়। দেশের ৬৪ টি জেলার ভাষাতেই আঞ্চলিকতার প্রভাব থাকা স্বাভাবিক। তবে কিছু জেলাতে আঞ্চলিক ভাষার নিজস্ব রূপ, বিস্তৃত শব্দ ভান্ডার এতটাই পৃথক যে, তা বাংলা ভাষা থেকে ভিন্ন মনে হয়।
বাংলাদেশে আঞ্চলিক ভাষার জন্য বিখ্যাত কিছু জেলার আকর্ষণীয় ভাষা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য নিচে তুলে ধরা হলোঃ
ঢাকাইয়া কুট্টি ভাষা
রাজধানীর পুরান ঢাকার একটি ঐতিহাসিক ও বৈচিত্র্যময় ভাষা হলো কুট্টি ভাষা। বর্তমানে শুধুমাত্র পুরান ঢাকার কুট্টি সম্প্রদায়ের বাঙালীরাই এই উপভাষায় কথা বলেন। এই উপভাষাটি বিপুল পরিমাণ আরবি ও ফার্সি শব্দভান্ডারে সমৃদ্ধ। মুঘল আমলে ১৮০০ শতকের মাঝামাঝি সময়ে কুট্টি সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়। তখন বাংলার উর্দুভাষী নবাবদের সাথে বিভিন্ন অঞ্চলের (বিশেষ করে হিন্দুস্থানী) লোকদের কথোপকথন হতো। ফলে বিভিন্ন অঞ্চলের সংস্কৃতির সাথে বাংলা সংস্কৃতির সংমিশ্রণে ১৭৬০ সালের দিকে ঢাকাইয়া কুট্টি ভাষার জন্ম হয়।
বিংশ শতাব্দীতে ঢাকার বিভিন্ন অঞ্চলের পঞ্চায়েত গুলো ঢাকাইয়া কুট্টি ভাষার মাধ্যমে আলোচনা করতেন। তখন পুরান ঢাকায় বসবাসকারী সাধারণ জনগণরাও এই ভাষায় কথা বলতেন। বর্তমানে বিভিন্ন জেলার আঞ্চলিক ভাষার মধ্যে এটি বাংলা ভাষার একটি বৈচিত্র্যপূর্ণ ও ঐতিহাসিক রূপ হিসেবে সকলের কাছে পরিচিত।
চান্নিপশর রাইতের লৌড়, এই মাতোয়ালা রাইত – এগুলো ঢাকাইয়া কুট্টি ভাষার বিখ্যাত কবিতা।
ঢাকাইয়া কুট্টি ভাষার উদাহরণঃ
প্রমিত ভাষা | ঢাকাইয়া কুট্টি উপভাষা |
যাচ্ছি | যাইতাছি |
করবো | করুম |
সত্যি | হাচা |
শোন | হুন/শুন |
ছেলে/ মেয়ে | পোলা/ মাইয়া |
চট্টগ্রামের চাটগাঁইয়া আঞ্চলিক ভাষা
চাটগাঁইয়া বা চিটাইঙ্গা ভাষা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের, বিশেষ করে চট্টগ্রাম বিভাগের চট্টগ্রাম জেলা ও কক্সবাজার জেলার মানুষের প্রধান ভাষা। এছাড়াও রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়িতে এই ভাষা বিশেষভাবে ব্যবহৃত হয়। এটি ইন্দো-আর্য ভাষাগোষ্ঠির একটি সদস্য ভাষা। ভাষাবিদদের মতে, চাটগাঁইয়া ভাষা একটি স্বতন্ত্র ভাষা হিসেবে বিবেচিত হয়। তবে বাংলা ভাষার সাথে এর শব্দগত মিল থাকায় একে বাংলার উপভাষা মনে করা হয়।
বাংলাদেশের প্রায় ১ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষ চাটগাঁইয়া ভাষায় কথা বলে। বিশ্বের সেরা ১০০ টি কথ্য ভাষার তালিকায় এর অবস্থান ৮৮ তম। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার আঞ্চলিক ভাষার মধ্যে বাংলার পরে এটি দ্বিতীয় বৃহত্তম ভাষা চাটগাঁইয়া ভাষা।
অঞ্চলভেদে চট্টগ্রামের চাটগাঁইয়া ভাষার কয়েকটি উপভাষা রয়েছে। যেমন- চট্টগ্রামের উত্তরাঞ্চলে, দক্ষিণাঞ্চলে, চট্টগ্রাম শহরে এবং কক্সবাজারে চাটগাঁইয়া ভাষার মধ্যে ভিন্নতা দেখা যায়।
চাটগাঁইয়া ভাষার শব্দ বিন্যাস বা বাক্যগঠন হয়ে থাকে “কর্তা + কর্ম + ক্রিয়া” – এই ধারায়। বিভিন্ন লোকগীতিতে চাটগাঁইয়া ভাষার ব্যাপক প্রচলন রয়েছে।
চট্টগ্রামের চাটগাঁইয়া আঞ্চলিক ভাষার উদাহরণঃ
প্রমিত ভাষা | চট্টগ্রামের চাটগাঁইয়া আঞ্চলিক ভাষা |
খাওয়া-দাওয়া | হানা-ফিনা |
ছেলেমেয়ে | ফোয়াসা |
কাঠাল | হাট্টল |
সকাল | বেইন্না |
মোরগ | রাতা কুরা |
সিলেট জেলার সিলেটি আঞ্চলিক ভাষা
সিলেটি ভাষা বাংলাদেশের মানুষের ব্যবহৃত ৩য় বৃহত্তম আঞ্চলিক ভাষা। আঞ্চলিক ভাষার দিক থেকে এটি অনেকটা প্রাচীন। ধারণা করা হয়, সিলেট শহরের নামানুসারে ইউরোপীয় ব্যবসায়িকরা সিলেটের স্থানীয় ভাষাকে সিলেটিয়া নামে অভিহিত করতো। সেই সময়কালীন সিলেটের স্থানীয়রা তাদের ভাষাকে জৈন্তিয়াপুরি, উজানিয়া, পূর্ব শ্রীহট্টীয়া, সিলেট্টি, ছিলটি ইত্যাদি নামে ডাকতেন। যা বর্তমানে সর্বত্র সিলেটি ভাষা নামে পরিচিত।
ঐতিহাসিক ও বৈচিত্র্যময় এই ভাষাটি সিলেটের সুরমা উপত্যকা অঞ্চলে, ভারতের আসাম রাজ্যের বরাক উপত্যকা এবং হোজাই জেলায় প্রচলিত একটি ইন্দো-আর্য ভাষা। লন্ডনের সিলেটি রিসার্চ এন্ড ট্রান্সলেশন সেন্টারের উদ্যোগে পরিচালিত একটি জরিপ হয়েছে। তা থেকে জানা যায়, বর্তমানে বাংলাদেশের সিলেটসহ পৃথিবীজুড়ে প্রায় ১ কোটি ৬০ লক্ষ মানুষ সিলেটি ভাষায় কথা বলে। এত ভাষাভাষী মানুষ নিয়ে এটি পৃথিবীর ৯৭ তম বৃহৎ ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
সিলেটি ভাষার নিজস্ব বর্ণমালাও রয়েছে। মধ্যযুগে ইসলামী শাসনামলে বাংলার পাশাপাশি সিলেটি ভাষার বর্ণমালা বা সিলেটি নাগরী লিপি প্রচলিত হয়। সিলেটি নাগরী লিপিতে ৩৩টি বর্ণ রয়েছে। তন্মধ্যে, ৫টি স্বরবর্ণ, ২৭টি ব্যঞ্জনবর্ণ এবং ১টি ধ্বনি নির্দেশক চিহ্ন।
সিলেট বিভাগের এবং ভারতের কিছু অঞ্চলে অবস্থানভেদে এবং ধর্মীয় মতাদর্শ ভেদে সিলেটি ভাষার প্রয়োগ ভিন্ন।
সিলেটি ভাষার উদাহরণঃ
প্রমিত ভাষা | সিলেটের আঞ্চলিক সিলেটি ভাষা |
আঙুল | অঙ্গুইল |
ভালোবাসা | ভালাপাওয়া, পেরেম |
সমস্ত | হক্কল |
জামাই | দামান |
এটা কী? | ইগু/ ইটা কিতা? |
নোয়াখালী জেলার নোয়াখাইল্লা আঞ্চলিক ভাষা
বৃহত্তর নোয়াখালী জেলার আঞ্চলিক ভাষাকে নোয়াখালীয়/ নোয়াখাইল্লা ভাষা বলা হয়। বিভিন্ন জেলার আঞ্চলিক ভাষার মধ্যে এটি অনেক বেশি আকর্ষণীয়, বৈচিত্রপূর্ণ এবং নাট্যাভিনয়ে অন্যতম উপযোগী ভাষা।
প্রাচীন ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা-পরিবারের অন্তর্গত উপভাষীয় বাংলার একটি অংশ নোয়াখালীয় ভাষা। এটি প্রায় ৭০ লক্ষ মানুষের কথ্য ভাষা। বাংলাদেশের নোয়াখালী অঞ্চল ছাড়াও চট্টগ্রাম, ভোলা, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লা ও চাঁদপুর জেলার কিছু অঞ্চলের মানুষ এই ভাষায় কথা বলেন। তাছাড়া ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের প্রধান উপভাষা হিসেবে সাব্রুম, হৃষ্যমুখ, বিলোনিয়ার পাশাপাশি নোয়াখালীয় ভাষাও প্রচলিত।
নোয়াখালীয় ভাষার একটি উপভাষা হলো চাটখিল। এছাড়া অঞ্চলভেদে এই ভাষার শব্দ উচ্চারণে কিছুটা তারতম্য রয়েছে। লিখন পদ্ধতি হিসেবে এই ভাষা বাংলা বর্ণমালা ব্যবহার করে। আনুষ্ঠানিকভাবে এই ভাষাটি ব্যবহৃত না হলেও, বাংলাদেশের জনপ্রিয় হাস্যরসাত্বক কৌতুক, নাট্যাভিনয়, সিনেমায় এর ব্যাপক ব্যবহার লক্ষণীয়।
নোয়াখাইল্লা ভাষার উদাহরণঃ
প্রমিত ভাষা | নোয়াখাইল্লা ভাষা |
ডিম | বয়জা |
শয়তানি | খন্নাশি |
পানি | হানি |
সে আমাকে ফোন করেছিল | হেতে আঁরে হোন কইরছিলো |
শুয়ে পড়ো | হুতি যা |
ময়মনসিংহ জেলার ময়মনসিংহীয় আঞ্চলিক ভাষা
বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের প্রধান উপভাষাকে ময়মনসিংহীয় উপভাষা বা মোমেনশিঙ্গা বাংলা ভাষা বলা হয়। এটি বাংলা ভাষার বঙ্গালী উপভাষার একটি বৃহৎ অংশ। ময়মনসিংহ বিভাগসহ দেশের ঢাকা বিভাগ, সিলেট বিভাগ, ভারতের মেঘালয় ও আসাম রাজ্যের অনেকটা অংশ জুড়ে এই ভাষার প্রচলন রয়েছে। এছাড়াও কিশোরগঞ্জ এ টাঙ্গাইল জেলার বাঙ্গালীদের প্রধান কথ্য ভাষা এটি।
এই ভাষাটি প্রাকৃতিকভাবেই পূর্বাঞ্চলীয় বাঙ্গালীদের বাংলা অসমীয়া ভাষা থেকে পর্যায়ক্রমে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বর্তমানে প্রায় ৫৫ লক্ষ মানুষ এই ভাষায় কথা বলে। প্রমিত বাংলা ভাষার সাথে এই ভাষার অনেক মিল রয়েছে। তবে অধিকাংশ শব্দেই ময়মনসিংহ অঞ্চলের উপভাষীয় প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়।
ময়মনসিংহীয় আঞ্চলিক ভাষা উদাহরণঃ
প্রমিত ভাষা | ময়মনসিংহীয় আঞ্চলিক ভাষা |
ঢাকা | ডাহা |
সঙ্গে/ সাথে | লগে |
ঝাড়ু | হাছুন |
টাকা | ট্যাহা/ টেহা |
খাবো | খাইবাম |
বরিশাল জেলার বরিশাইল্যা আঞ্চলিক ভাষা
বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার আঞ্চলিক ভাষার মধ্যে বৈচিত্র্যময় বরিশাইল্যা ভাষা সম্পর্কে সমগ্র দেশব্যাপী কৌতূহল রয়েছে। এটি পর্যায়ক্রমিকভাবে বাংলা অসমীয়া থেকে বাংলা উপভাষার একটি অংশ হিসেবে এসেছে। আদিকালে বরিশালের এই অঞ্চলটি বাঙ্গালা/ বাকলা নামে পরিচিত ছিল।
ধারণা করা হয়, ১০০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে বাকলাসহ পার্শ্ববর্তী মাদারীপুর ঝালকাঠি, গোপালগঞ্জ, বাগেরহাট, ভোলা, বরগুনা, পটুয়াখালী, পিরোজপুর ইত্যাদি অঞ্চল নিয়ে তৎকালীন চন্দ্র রাজবংশের রাজারা ‘চন্দ্রদ্বীপ’ নামক রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। সেই চন্দ্রদ্বীপ অঞ্চলের মানুষের আঞ্চলিক কথ্য ভাষা ছিল বরিশাইল্যা ভাষা। পরবর্তীতে, বাকলা থেকে বাকেরগঞ্জ ও সর্বশেষ বরিশাল অঞ্চলের প্রধান কথ্য ভাষা হিসেবে এটি বিরাজমান রয়েছে।
বর্তমানে প্রায় ৫৫ লক্ষ্য বাঙালী এই উপভাষা ব্যবহার করে। বাংলাদেশের বরিশাল বিভাগের বরিশাল, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি, বরগুনা এবং পিরোজপুর জেলার বাঙালীদের প্রধান বাংলা উপভাষা এটি। এছাড়াও নিকটস্থ খুলনা ও লক্ষ্মীপুর জেলা এবং ঢাকার বহু মানুষ বরিশাইল্যা উপভাষায় কথা বলে। এই উপভাষার নিজস্ব কোন লিখন পদ্ধতি নেই। আনুষ্ঠানিকভাবে এই ভাষার প্রয়োগ না থাকলেও বাংলাদেশের ভাষা বৈচিত্রের অন্যতম অংশ বরিশাইল্যা উপভাষা।
বরিশাইল্যা উপভাষার উদাহরণঃ
প্রমিত ভাষা | বরিশাইল্যা উপভাষা |
হাঁটু | আঁডু |
শেওলা | হিদলা |
পায়ের গােড়ালী | গুরমুইর্যা |
থেমে যাওয়া | খ্যামা দেওয়া |
গাইওল | গাভী |
খুলনা জেলার খুলনাইয়া আঞ্চলিক ভাষা
খুলনার খুলনাইয়া আঞ্চলিক ভাষা বাংলার ভাষা বৈচিত্র্যের অন্যতম আকর্ষণীয় উপভাষা। এই আঞ্চলিক ভাষাটি অনেকাংশে বাংলা প্রমিত ভাষার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। মূলত এটি বাংলার প্রমিত ভাষার শব্দ ভান্ডারকেই আরো বিস্তৃত করেছে। তবে খুলনা জেলার পার্শ্ববর্তী বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলা পূর্বে ভারতের নদীয়া উপজেলার অন্তর্গত ছিল। তখন থেকেই কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর এলাকার অধিবাসীদের কথ্য ভাষায় ভারতীয় নদীয়া জেলার ভাষার প্রভাব লক্ষণীয় ছিল।
বর্তমানে খুলনা জেলার উত্তর-পশ্চিমাংশের ভৈরব, দৌলতপুর, তেলিগাতী, মহেশ্বরপাশা, ডাকাতিয়া, আড়ংঘাটা উপজেলা এবং যশোর জেলার দক্ষিণ পূর্বাংশ জুড়ে মানুষের অন্যতম কথ্য উপভাষা হলো খুলনাইয়া আঞ্চলিক ভাষা।
বিভিন্ন জেলার আঞ্চলিক ভাষার তূলনায় বাংলার সাহিত্যে ও সংস্কৃতিতে খুলনাইয়া ভাষার অবদান ব্যাপক। চারণ কবিতা, সংগীত, গদ্য রচনা, নাট্য অভিনয় ইত্যাদি বহু সাংস্কৃতিক পটভূমিতে খুলনার আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহৃত হয়েছে যুগে যুগে। কিছুকাল পূর্বের অত্যন্ত জনপ্রিয় গাজী কালুর গান, চম্পাবতী, রহিম রূপবানের পালা, নদের চাঁদের পালা, নিমাই সন্যাসী, দাতা কর্ণের উপাখ্যান, নৌকা বিলাস ইত্যাদি এই উপভাষার বিখ্যাত সাহিত্যকর্ম।
খুলনাইয়া আঞ্চলিক ভাষার উদাহরণঃ
প্রমিত ভাষা | খুলনার আঞ্চলিক ভাষা |
দুষ্ট, চতুর | কল্লা |
গায়ক | গাইন |
অমাবস্যা | জোগা |
লবণ | নেমক |
জঙ্গল | বাদা |
রাজশাহী জেলার বরেন্দ্রী উপভাষা
বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতোই রাজশাহী অঞ্চলেরও একটি নিজস্ব উপভাষা রয়েছে। প্রাচীন বরেন্দ্র ভূমির অন্যতম একটি অঞ্চল রাজশাহী। তাই রাজশাহী বিভাগে বসবাসকারীরা স্থানীয়ভাবে যে ভাষায় কথা বলে তাকে বরেন্দ্রী উপভাষা বলা হয়। বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যবর্তী পদ্মা ও মহানন্দা নদীর তীরের উপত্যকা জুড়ে রাজশাহী ছাড়াও নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, মুর্শিদাবাদ, দিনাজপুর, মালদহ অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের কথ্য ভাষা বরেন্দ্রী উপভাষা।
প্রমিত/ শুদ্ধ বাংলা ভাষা মূলত রাঢ়ী উপভাষার পরিমার্জিত বাংলা রূপ। সেই রাঢ়ী উপভাষার সাথে বরেন্দ্রী উপভাষার মিল রয়েছে অনেকাংশে। রাজশাহীর এই ভাষাটি বিভিন্ন জেলার আঞ্চলিক ভাষা থেকে অনেক বেশি সহজ ও বোধগম্য। এই ভাষার নিজস্ব দুটি উপভাষা রয়েছে। সেগুলো পূর্বী উপদল ও পশ্চিমী উপদল নামে পরিচিত। বরেন্দ্রী উপভাষায় লিখিত রূপ হিসেবে বাংলা বর্ণমালা ব্যবহৃত হয়।
বরেন্দ্রী উপভাষা ছাড়াও রাজশাহীতে আরো কিছু বৈচিত্রপূর্ণ উপভাষা রয়েছে। সাধারণত রাজশাহীতে নানা সংস্কৃতির মানুষ, যেমন- সাঁওতাল, বিহারী ইত্যাদি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বসবাস করে। তারা নিজস্ব উপভাষায় কথা বলে থাকে। রাজশাহীর উপভাষা গুরুগম্ভীর আলোচনায় ও সাহিত্য-সংগীতে ব্যবহৃত হয়। এটি বাংলার ভাষা বৈচিত্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে রয়েছে।
রাজশাহীর বরেন্দ্রী উপভাষার উদাহরণঃ
প্রমিত ভাষা | রাজশাহীর বরেন্দ্রী উপভাষা |
আমাদের | আমাগোর |
চলে | চইল্যা |
আমি | হামি |
আসছে | আইচ্চে |
এগুলো কী? | ইগলা কী? |
রংপুর জেলার রংপুরী আঞ্চলিক ভাষা
বাংলাদেশের রংপুর অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষা রংপুরী ভাষা নামে পরিচিত। প্রাচীন ইন্দো-আর্য ভাষা পরিবারভুক্ত কামপুরী ভাষার একটি অংশ রংপুরী/ রাজবংশী ভাষা। আঞ্চলিক ভাষা হিসেবে বাংলাদেশসহ ভারত ও নেপালের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে এই ভাষা ব্যবহৃত হয়। বর্তমানে পৃথিবী জুড়ে প্রায় ১.৫ কোটি মানুষের মাতৃভাষা এবং সর্বমোট প্রায় ২ কোটি ৬০ লক্ষ মানুষের কথ্য ভাষা হিসেবে এটি ব্যবহৃত হয়।
সাধারণত রাজবংশী, নাথ-যোগী, তাজপুরিয়া, খেন, নস্যশেখ সম্প্রদায়ের লোকেরা এই ভাষার প্রচলন করেছিল এবং বর্তমানেও কথা বলেন। রংপুরের এই আঞ্চলিক ভাষাটি বাংলাদেশে রংপুরী ভাষা; ভারতে রাজবংশী, কামতাপুরী, গোয়ালপারীয়া, সূর্যাপুরী ভাষা এবং নেপালে রাজবংশী, তাজপুরি ভাষা নামেও পরিচিত। বাংলাদেশের রংপুর বিভাগের ৮টি জেলা; ভারতের উত্তরবঙ্গের সকল জেলার মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬০ ভাগের বেশি মানুষ; নেপালের ঝাপা ও মোরং জেলা; এবং ভূটানের কিছু অঞ্চলে এই ভাষার প্রচলন রয়েছে।
রংপুরী ভাষার পূর্ব, মধ্য, পশ্চিম এবং পাহাড়ী উপভাষা রয়েছে। এই ভাষা ব্যবহারকারী অধিকাংশ জনগণ দ্বিভাষী। সাধারণত রংপুরী ভাষাভাষীরা একইসাথে রংপুরী, প্রমিত বাংলা/ অসমীয়া ভাষায় কথা বলে অভ্যস্ত। রংপুরী/ রাজবংশী ভাষার নিজস্ব লিখন পদ্ধতি রয়েছে। এক্ষেত্রে পূর্ব নাগরী লিপি ব্যবহার করা যায়।
রংপুরের আঞ্চলিক রংপুরী ভাষার উদাহরণঃ
প্রমিত ভাষা | রংপুরী ভাষা |
আমি | মুই |
মেয়ে | চেংড়ি |
পুরুষ | ব্যাটাছাওয়া |
আমাদেরকে | হামাকগুলাকে |
মরিচ | আকালী |
কুমিল্লা জেলার আঞ্চলিক ভাষা
কুমিল্লা জেলার অধিকাংশ মানুষ শুদ্ধ বাংলা ভাষায় কথা বলে। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত কুমিল্লা জেলা। বাংলাদেশ ও ভারতের সংযোগস্থলে অবস্থিত এই জেলাকে ঘিরে রেখেছে ঢাকা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিভাগের জেলাসমূহ ও ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য। বিভিন্ন জেলার আঞ্চলিক ভাষার সাথে সংযুক্ত থাকায় এই জেলাতেও আঞ্চলিক ভাষাবৈচিত্র্য গড়ে উঠেছে।
কুমিল্লার মেঘনা, হোমনা, তিতাস, দাউদকান্দি এবং এদের নিকটবর্তী উপজেলা গুলো ঢাকার নিকটবর্তী হওয়ায়, এখানে শুদ্ধ বাংলা ভাষা ব্যবহৃত হয়। অন্যদিকে, চৌদ্দগ্রাম, লাকসাম ও এদের নিকটবর্তী উপজেলা গুলোতে নোয়াখালী ও ভারতের ত্রিপুরার আঞ্চলিক ভাষার প্রভাব লক্ষ্যনীয়।
কুমিল্লার আঞ্চলিক ভাষার উদাহরণঃ
প্রমিত ভাষা | কুমিল্লার আঞ্চলিক ভাষা |
সে | হেতে |
হাইনজালা | সন্ধ্যা রাতে |
করবো | করবাম |
হেন | ভাতের মার |
পাখি | পইখ |
কক্সবাজারের রোঁয়াই আঞ্চলিক ভাষা
কক্সবাজারের প্রধান কথ্য ভাষা হলো চাটগাঁইয়া ভাষা। তবে বাংলাদেশের সমুদ্র তীরবর্তী কক্সবাজার জেলার ভাষা মিশ্র প্রকৃতির। বিভিন্ন অঞ্চল/ দেশের পর্যটকরা এই দর্শনীয় স্থান পরিদর্শনে আসে প্রতিনিয়তই। ফলে তাদের ভাষাগত বৈচিত্র্য কক্সবাজারের স্থানীয় ভাষাকে প্রভাবিত করে। তবে স্থানীয়রা কক্সবাজারের নিজস্ব রোঁয়াই উপভাষাতেই কথা বলেন।
হাজার বছর পূর্ব থেকেই কক্সবাজারে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষের আগমন ঘটেছিল। বিশেষ করে বর্তমান মায়ানমারের (পূর্বের আরাকান) সাথে কক্সবাজারের ব্যাপক বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। তাছাড়া আরবীয়, ভারতীয়, ইংরেজ, চাকমা, চাক, সাঁওতাল, রাখাইন, তুর্কি, চীনা, পাখতুন, ভুটিয়া, পাঞ্জাবি, ত্রিপুরা, পতুর্গিজসহ অনেক দেশ থেকেই বিভিন্ন ভাষার ও সংস্কৃতির মানুষের আগমন হতো এখানে। ফলে যোগে যোগে কক্সবাজারের ভাষা ও শব্দ ভান্ডার সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে।
সাহিত্যচর্চার জন্য বিভিন্ন জেলার আঞ্চলিক ভাষার মধ্যে এটি অন্যতম। যুগে যুগে বহু লেখক, কবি, গীতিকার রোঁয়াই আঞ্চলিক ভাষায় নানান সাহিত্যকর্ম রচনা করেছেন।
কক্সবাজারের রোঁয়াই আঞ্চলিক ভাষার উদাহরণঃ
প্রমিত ভাষা | কক্সবাজারের রোঁয়াই আঞ্চলিক ভাষা |
সকাল | বিইন্না |
ঝগড়া | হইজ্জা |
নদী | দইজ্জা |
বিধবা | রারি |
সন্ধ্যা | আজঅইন্না |
বগুড়া জেলার আঞ্চলিক ভাষা
বাংলাদেশের বগুড়া জেলায় কথাবার্তায় বরেন্দ্রী উপভাষা ব্যবহৃত হয়। তবে স্থানীয়দের কথাবার্তায় রংপুরী ভাষা বা রাজবংশী ভাষার বৈশিষ্ট্যেরও প্রয়োগ অনেকাংশে লক্ষ্যনীয়। বগরা খাঁর নামানুসারে বগুড়া জেলা উত্তরবঙ্গের একটি প্রাচীন জনপদ হিসেবে পরিচিত ছিল। মধ্যযুগে বগুড়া জেলা উত্তরবঙ্গের রাজধানী বা প্রবেশদ্বার হিসেবে খ্যাত ছিল। ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য এটি হয়ে উঠেছিল তীর্থকেন্দ্র।
মধ্যযুগীয় পাল, সেন, সুলতানি আমল থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত বগুড়ার জনপদ গুলো বিভক্ত হতে থাকে। তখন রাঢ়ী, বরেন্দ্র, বঙ্গ, সমতট, ঝাড়খন্ডী ইত্যাদি উপভাষার প্রচলন শুরু হয়। বগুড়া জেলার আঞ্চলিক ভাষাকে এখন উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম ও সদর এই ৫ টি ভাগে ভাগ করা যায়। জেলার দক্ষিণ, সদর ও পশ্চিমাংশে বরেন্দ্রীয় প্রভাব বেশি। উত্তর-পূর্বাংশে রাজবংশী উপভাষার প্রভাব বেশি। স্থানীয়দের মধ্যে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কথাবার্তায় বিশুদ্ধ রাঢ়ী উপভাষার ব্যবহারও বিদ্যমান।
আধুনিককালে, বগুড়া জেলার শিক্ষা ব্যবস্থায় এবং পারিবারিকভাবে শিশুদের প্রমিত বাংলা শব্দ ব্যবহারে উৎসাহিত করা হয়। বিভিন্ন জেলার আঞ্চলিক ভাষার মতো এই ভাষার ব্যবহারও কমে যাচ্ছে। তবে এই জেলার বিভিন্ন অঞ্চল জুড়ে কয়েকটি আঞ্চলিক ভাষার প্রয়োগ অব্যাহত রয়েছে।
বগুড়া জেলার আঞ্চলিক ভাষার উদাহরণঃ
প্রমিত ভাষা | বগুড়া জেলার আঞ্চলিক ভাষা |
ছেলে | ছোরা |
শরীর | গাও |
সকলে | সোগলি |
কেমন আছো? | ক্যাংকা আছু? |
শাশুড়ি | শৌড়ি |
সাতক্ষীরা জেলার সুন্দরবনী আঞ্চলিক ভাষা
দক্ষিণ বাংলার একটি প্রাচীন জনপদ সাতক্ষীরা জেলা। উপমহাদেশের ভাষাবিজ্ঞানীদের মতানুসারে, বাংলাভাষীয় জনপদ গুলোকে ৫টি ভাগে ভাগ করা হয়। এর মধ্যে, বাংলাদেশের খুলনা বিভাগের বৃহত্তর খুলনা ও যশোর জেলায় বঙ্গালী উপভাষা ব্যবহৃত হয়।
অন্যদিকে, ভারতের কলকাতায় বাংলা ভাষীদের মাঝে রাঢ়ী উপভাষা ব্যবহৃত হয়। ফলে সাতক্ষীরা অঞ্চলের ভাষার বাচনভঙ্গি ও টান বিশেষভাবে রাঢ়ী এবং বঙ্গালী উপভাষার একক বৈশিষ্ট্য বহন করেনা। উভয় অঞ্চলের মধ্যবর্তী সুন্দরবন অধিভুক্ত সাতক্ষীরা জেলার ভাষায় মিশ্র বৈশিষ্ট্য প্রতিফলিত হয়। তাই সাতক্ষীরার উপভাষায় রাঢ়ী ও বঙ্গালী রীতির মিশ্র বৈশিষ্ট্যের ভাষাকে সুন্দরবনী উপভাষা বলা হয়।
বর্তমানে সাতক্ষীরা জেলায় উপজেলা/ অঞ্চলভেদে উপভাষীয় প্রয়োগ ভিন্ন। যথাঃ
(১) সাতক্ষীরার উত্তর ও উত্তর-পূর্ব যশোর জেলা সংলগ্ন কলারোয়া; খুলনা জেলা সংলগ্ন তালা ও আশাশুনি উপজেলাতে খুলনাইয়া, বরিশাইল্যা ও ফরিদপুরী ভাষার প্রভাব লক্ষণীয়।
(২) সাতক্ষীরা জেলার মধ্য অঞ্চলে সদর উপজেলা ও তৎসংলগ্ন তালা, আশাশুনি ও দেবহাটা উপজেলা অন্তর্গত। এখানে সাতক্ষীরার জেলা শহর অবস্থিত থাকায় শিক্ষা, সংস্কৃতি, অফিস-আদালত, রাজনীতি ও অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক কাজকর্মে প্রমিত ভাষার প্রয়োগ বেশি। তবে সামাজিক কর্মকান্ডে রাঢ়ী ও বঙ্গালী উপভাষার মিশ্র প্রয়োগ দেখা যায়।
(৩) সাতক্ষীরা জেলার দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চল সুন্দরবনের সীমার অন্তর্গত। এখানে শ্যামনগর, কালীগঞ্জ, দেবহাটা, আশাশুনি উপজেলা গুলো অবস্থিত। সুন্দরবন সংলগ্ন হওয়ায় ২ দেশের বিভিন্ন উপভাষার মিশ্র বৈশিষ্ট্যের সুন্দরবনী উপভাষা এখানে লক্ষণীয়।
সাতক্ষীরার আঞ্চলিক ভাষার কয়েকটি রূপ থাকায় এটি বাংলার ভাষা বৈচিত্রকে অনেক বেশি প্রভাবিত করে। বিভিন্ন জেলার আঞ্চলিক ভাষার মতোই সাতক্ষীরার আঞ্চলিক ভাষায় যুগে যুগে বহু সাহিত্য গড়ে উঠেছে।
সাতক্ষীরার সুন্দরবনী আঞ্চলিক ভাষার উদাহরণঃ
প্রমিত ভাষা | সুন্দরবনী আঞ্চলিক ভাষা |
ওদের | উইগের |
যেতে, খেতে | জাতি, খাতি |
কালকে | কাউল্যা |
করে | কোইর্যা |
মেরেছি | মারিচি |
বাগেরহাট জেলার আঞ্চলিক ভাষা
বাগেরহাট জেলায় বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষার মিশ্র রূপ ব্যবহৃত হয়। পূর্বকালে এই জেলার অধিকাংশ স্থান ছিল বন-জঙ্গল। পরবর্তীতে, ধীরে ধীরে বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ এখানে আগত হয়ে বন নিধন করে জনপদ গড়ে তুলেছিল। একেক জেলা থেকে আগত ব্যক্তিবর্গের আঞ্চলিক ভাষার ভিন্নতা ছিল, যা বাগেরহাটের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। বর্তমানে কৃষিপ্রধান এই জেলার মানুষের সাথে সেই ভাষা নিবিড়ভাবে মিশে গেছে।
বাগেরহাট জেলার মোংলা, রামপাল ও ফকিরহাট উপজেলায় খুলনার আঞ্চলিক ভাষা পরিলক্ষিত হয়। অন্যদিকে, শরণখোলা ও মোড়েলগঞ্জ উপজেলার অধিবাসীরা বরিশালের আঞ্চলিক ভাষা এবং মোল্লাহাট, চিতলমারী উপজেলার অধিবাসীরা গোপালগঞ্জের আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করে। বর্তমানে বাগেরহাটের অধিকাংশ বসবাসকারী শুদ্ধ বাংলা ভাষায় কথা বলে। তবে সামাজিক কার্যকলাপে এসকল ভাষার প্রয়োগ অনেকাংশে লক্ষণীয়।
বাগেরহাটের আঞ্চলিক ভাষার উদাহরণঃ
প্রমিত ভাষা | বাগেরহাটের আঞ্চলিক ভাষা |
ধানের দালাল | কয়াল |
গন্ডার | গ্যাড়া |
শিষ্য | চেলা |
তেলাপোকা | তেলাচোরা |
বাম-হাতি | ড্যাবরা |
ঠাকুরগাঁও জেলার আঞ্চলিক ভাষা
বাংলাদেশের ঠাকুরগাঁও জেলায় বসবাসকারী বাঙালিরা প্রধানত কোচ রাজবংশীয় উপভাষায় কথা বলে। বিভিন্ন জেলার আঞ্চলিক ভাষার মধ্যে এই ভাষা তুলনামূলক প্রাচীন। বাচনভঙ্গি ও শব্দ উচ্চারণের দিক থেকে এই ভাষা অত্যন্ত শ্রুতিমধুর। ঠাকুরগাঁও ছাড়াও বাংলাদেশের রংপুর, দিনাজপুর ও ভারতের কোচবিহারে এই ভাষার ব্যাপক প্রচলন রয়েছে।
ঠাকুরগাঁও জেলায় রাজবংশী, পলিয়া, সাঁওতাল, ওরাও উপজাতি সহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বসবাস। পূর্বকালে এই সকল জেলায় বিভিন্ন অঞ্চল থেকে জনগণ এসে বসতি স্থাপন করেছিল। তাদের জীবনযাপনের সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত বৈচিত্র্যের সংমিশ্রণে ঠাকুরগাঁও জেলা বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষার বিচরণ ভূমি হয়ে ওঠে।
নিকটস্থ জেলাগুলোর ভাষা বৈচিত্র্যও ঠাকুরগাঁওয়ের স্থানীয় ভাষাকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। অন্যদিকে, ভারতের বিহার, পূর্ণিয়া, মালদহ ইত্যাদি অঞ্চল ঠাকুরগাঁওয়ের নিকটবর্তী হওয়ায় স্থানীয়দের কথাবার্তায় ভারতীয় টান লক্ষ্য করা যায়। ঠাকুরগাঁবের আঞ্চলিক ভাষার বৈশিষ্ট্য দুটি উপ-অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন। যথাঃ (১) নেকমরদ, হরিপুর, পশ্চিম সীমান্তবর্তী উপজেলা বালিয়াডাঙ্গী ও রানীশংকৈল; (২) ঠাকুরগাঁও সদর ও পীরগঞ্জ উপজেলার পূর্বাঞ্চল। তবে প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকান্ডে জেলার সমস্ত অঞ্চলের, জাতির, ধর্মের জনগণ বিশুদ্ধ বাংলা ভাষার ব্যবহার করে।
ঠাকুরগাঁওয়ের আঞ্চলিক ভাষার উদাহরণঃ
প্রমিত ভাষা | ঠাকুরগাঁওয়ের আঞ্চলিক ভাষা |
রাত | আইত |
আমার | হামার |
বলবো | বলিম |
মারলো | মারিল্ল |
লুকিয়ে | নুকিয়া |
শরীয়তপুর জেলার আঞ্চলিক ভাষা
বাংলাদেশের শরীয়তপুরে বসবাসকারী বাঙালিরা প্রমিত বাংলা ভাষায় কথা বলে। তবে অঞ্চলভেদে দেশের বিভিন্ন জেলার ভাষায় যেমন বৈচিত্র রয়েছে, তেমনি শরীয়তপুরেরও নিজস্ব আঞ্চলিক ভাষার প্রভাব রয়েছে। পূর্বে শরীয়তপুর অঞ্চল বিক্রমপুর হিসেবে পরিচিত ছিল। বর্তমানেও শরীয়তপুর জেলার ভাষা এবং বাচনভঙ্গিতে বিক্রমপুরী ভাষার প্রভাব লক্ষণীয়।
এই আঞ্চলিক ভাষায় বাক্য গঠনের ক্ষেত্রে অধিকাংশই শুদ্ধ বাংলার শব্দ ব্যবহৃত হয়। বর্তমানে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা, বিদেশী ভাষার অনাকাঙ্ক্ষিত প্রয়োগ হয় বিভিন্ন জেলার আঞ্চলিক ভাষায়। একই কারণে ফলে শরীয়তপুরের আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহৃত শব্দগুলো আজ প্রায় বিলুপ্ত।
শরীয়তপুরের আঞ্চলিক ভাষার উদাহরণঃ
প্রমিত ভাষা | শরীয়তপুরের আঞ্চলিক ভাষা |
পাকের ঘর | পাহাল ঘর |
এগিয়ে আসা | আউগ্গায়া |
তাড়াতাড়ি | কুদায়া |
বড়োসড় | ডাঙ্গর |
বালিশের কাছে | হিতান |
টাঙ্গাইল জেলার আঞ্চলিক ভাষা
বাংলাদেশের জেলা সমূহের মধ্যে ১৯ তম জেলা হিসেবে ১৮৬৯ সালের ১ ডিসেম্বর টাঙ্গাইল মহকুমাটি জেলা হিসেবে পরিণত হয়। এই জেলার স্থানীয়দের কথাবার্তায় চারপাশের ৫টি জেলার আঞ্চলিক ভাষাভিত্তিক শব্দ ও টান লক্ষ্য করা যায়। এই জেলার অবস্থান মেঘনা, গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার প্রায় মধ্যভাগে হওয়ায় এর ভাষা বৈচিত্রপূর্ণ।
টাঙ্গাইলে বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বসবাস। যেমন- গারো, কোচ, হাজং, মান্দি ইত্যাদি উপজাতি। তাদের নিজস্ব উপভাষা রয়েছে। গারোদের মাতৃভাষা গারো নামে পরিচিত। এছাড়াও তারা অঞ্চলভেদে আচিক, আবেং ইত্যাদি ভাষায় কথা বলে। এই ভাষার নিজস্ব কোন বর্ণমালা নেই।
অন্যদিকে, টাঙ্গাইলের কোচ সম্প্রদায়ের নিজস্ব ভাষা রয়েছে। কোচদের ভাষাটি বাংলা, হিন্দি, উড়িষা, গন্ড, ছোট নাগপুরী ও অহম ভাষার সংমিশ্রনে সৃষ্টি হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। এছাড়াও হাজং, মান্দি ইত্যাদি উপজাতির মাঝে আরও বিভিন্ন ভাষার উপস্থিতি রয়েছে। তবে কর্মক্ষেত্রে এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে টাঙ্গাইলের সর্বত্র শুদ্ধ বাংলা ভাষা ব্যবহৃত হয়।
টাঙ্গাইলের আঞ্চলিক ভাষার উদাহরণঃ
প্রমিত ভাষা | টাঙ্গাইলের আঞ্চলিক ভাষা |
বোকা | অগদমা |
মূল্যহীন | অপুচ্ছা |
নাড়াচাড়া | আউল-জাউল |
বেহায়া | ঘ্যাচরা |
শক্ত, মজবুত | পোক্ত |
সুনামগঞ্জ জেলার আঞ্চলিক ভাষা
বাংলাদেশের সুনামগঞ্জ জেলার জনগণ সাধারণত প্রমিত বাংলা ভাষায় কথা বলেন। তবে সেই অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষার সাথে প্রাচীন চর্যাপদের ভাষার মিল লক্ষ্য করা যায়। ভাষাবিদদের মতে, প্রাচীন চর্যাপদের ভাষার সাথে বাংলা, অসমীয়া, উড়িয়া, মৈথিলা ভাষাসহ নানান বাংলা উপভাষার মিল রয়েছে। অতীতে, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও নেত্রকোনা নিয়ে প্রাচীন লাউড় রাজ্য গঠিত ছিল। সেই প্রাচীন লাউড় রাজ্যে চর্যাপদের ভাষার প্রয়োগ ছিল।
চর্যাপদের ভাষা ছাড়াও সুনামগঞ্জের ভাষায় চারদিকের বিভিন্ন জেলার আঞ্চলিক ভাষার প্রভাব লক্ষণীয়। এছাড়াও এই অঞ্চলের অধিবাসীরা বাংলা সহ মোট ৭টি ভাষায় সাহিত্য চর্চার ঐতিহ্য স্থাপন করেছেন।
সুনামগঞ্জের আঞ্চলিক ভাষার উদাহরণঃ
প্রমিত ভাষা | সুনামগঞ্জের আঞ্চলিক ভাষা |
গুনে | গুনিয়া |
শশুর | হৌড় |
কনে | কইন্যা |
কাদা | ফেখ |
ঘুড়ি | গুড্ডি |
বাংলাদেশের সবচেয়ে শুদ্ধ কুষ্টিয়া জেলার আঞ্চলিক ভাষা
বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলায় বসবাসকারীরা বাংলা ভাষার সবচেয়ে প্রমিত/ শুদ্ধ রূপে কথা বলে। প্রাতিষ্ঠানিক ও আনুষ্ঠানিক কর্মকাণ্ডে আমরা যেই ভাষা ব্যবহার করি তা অনেকাংশেই কুষ্টিয়া জেলার কথ্য ভাষার অনুরূপ। এই জেলার ভাষা অত্যন্ত স্পষ্ট, শ্রুতিমধুর, উচ্চারণে জড়তাহীন ও সকলের কাছে সহজবোধ্য।
বাংলাদেশের সবচেয়ে শুদ্ধ এই ভাষায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা, বাউল লালন শাহ এর লালনগীতি, বিভিন্ন উৎসবের কবিতা, সংগীত, পালা গান, জারী গান, মেলা, বাউল গান, পাঁচালী, যাত্রা, কৃষকের মেঠো গান ইত্যাদি রচিত হয়েছে।
এটি শুদ্ধ বাংলা ভাষা হওয়ায় কুষ্টিয়ার আঞ্চলিক ভাষা ও প্রমিত ভাষার মধ্যে তেমন পার্থক্য নেই।
বাংলা আঞ্চলিক ভাষার অভিধান
বাংলা ভাষা অনেক বৈচিত্রপূর্ণ একটি ভাষা। বাংলাদেশ ছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে এটি মানুষের কথ্য ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অঞ্চলভেদে, ভৌগোলিক অবস্থা ও বিদেশী ভাষা সংস্কৃতির প্রভাবে বাংলা ভাষায় বিভিন্ন জেলার আঞ্চলিক ভাষা দেখা যায়। বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষার সঠিক অর্থ জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অন্যথায়, সেই অঞ্চলে অবস্থান করলে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষার শব্দগুলোর সঠিক, শুদ্ধ ও প্রমিত রূপ নিয়ে ভাষাবিদ ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ একটি অভিধান সম্পাদনা করেছেন। এটি বাংলা একাডেমী কর্তৃক, “বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান” নামে সরকারিভাবে প্রকাশিত আছে।
এই বইটিতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সর্বমোট ১ লক্ষ ৬৬ হাজার ২৪৬টি আঞ্চলিক শব্দ রয়েছে। ১২৯৩ পৃষ্ঠার এই বইটিতে সকল আঞ্চলিক শব্দের উচ্চারণ, শুদ্ধ/ প্রমিত রূপ রয়েছে। এটি বাংলা ভাষার বৈচিত্রকে সকলের কাছে সহজবোধ্য করেছে।
আঞ্চলিক ভাষা হারিয়ে যাওয়ার কারণ
বর্তমানে সামাজিক মূল্যবোধ, আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা, বিদেশী ভাষার প্রয়োগ ও আধুনিক সংস্কৃতি চর্চার কারণে আঞ্চলিক ভাষা গুলো ধীরে ধীরে লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষার হাজারো শব্দ এখন বিলুপ্ত। কিছু আঞ্চলিক ভাষার বর্ণমালাও ছিল, বর্তমানে তার কোন অস্তিত্ব নেই। যুগে যুগে প্রমিত ভাষা চর্চার ফলে বর্তমানের ভাষাগুলোও একসময় বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে।
শুধুমাত্র প্রমিত ভাষা চর্চাই এর মূল কারণ নয়। বরং আঞ্চলিক ভাষা সম্পর্কে আমাদের ঠাট্টা-বিদ্রূপ, অবহেলা, অব্যবহার এবং অপব্যবহারও এর অন্যতম প্রধান কারণ।
শেষকথা
বাংলাদেশের প্রায় সকল জেলাতেই কোন না কোন আঞ্চলিক ভাষার প্রভাব রয়েছে। তবে উপরে উল্লেখিত বিভিন্ন জেলার আঞ্চলিক ভাষাগুলোর ব্যবহার তুলনামূলক বেশি। বাংলাদেশের সকল জেলার ভাষা বৈচিত্র্যকে টিকিয়ে রাখতে আমাদেরকে কথ্য ভাষায় লজ্জাবোধ দূর করতে হবে। দেশের ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে ব্যক্তিগত অংশগ্রহণের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় অংশগ্রহণও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।