🇰🇷 কোরিয়ান ভাষা বর্ণমালা পরিচয় এবং অন্যান্য তথ্য 

কোরিয়ান ভাষা বর্ণমালা হ্যাঙ্গুল (한국어) পৃথিবীর অন্যতম সহজ বর্ণমালা। প্রতিটি প্রসিদ্ধ ভাষারই নিজস্ব বর্ণমালা রয়েছে। প্রতিটি ভাষায় মৌখিকভাবে বুঝা এবং বলার পাশাপাশি লিখে প্রকাশ করাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তেমনিভাবে কোরিয়ান ভাষারও একটি সহজ সাবলীল বর্ণের সমাহার রয়েছে, যা হ্যাঙ্গুল নামে পরিচিত। উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়াতে এর লেখ্য রূপের ভিন্নতা রয়েছে। 

দক্ষিণ কোরিয়াতে এর লেখ্য রূপের নাম হ্যাঙ্গুল (한국어)। উত্তর কোরিয়াতে ব্যবহৃত লেখ্য রূপের নাম ‘জোসন গুল’ (조선굴)। তবে বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় হ্যাঙ্গুল বর্ণমালাকে। আকর্ষণীয় এই বর্ণমালার পরিচয়, বর্ণসমষ্টি, উচ্চারণ, শব্দ গঠন প্রক্রিয়া, কোরিয়ান ভাষা বর্ণমালা প্রতিষ্ঠার ইতিহাস সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য জানতে পারবেন এই লেখাতে।

কোরিয়ান বর্ণমালা পরিচয় 

কোরিয়ান ভাষা বর্ণমালার নাম হ্যাঙ্গুল (한국어)। ‘Hangeul’ নামটি কোরিয়ান শব্দ “han (한) – মহান” এবং “geul(글) – লিপি” থেকে এসেছে। অর্থাৎ হ্যাঙ্গুল শব্দের অর্থ ‘মহান লিপি’। তবে এই বর্ণমালার প্রতিষ্ঠাকালে একে হ্যাঙ্গুল বলতে ‘কোরিয়ান লিপি’ বুঝানো হয়েছিল।

জোসন রাজবংশের রাজা সেজং দ্য গ্রেট, তার রাজত্বকালীন সময়ে, ১৪৩৩ খ্রিস্টাব্দে হ্যাঙ্গুল বর্ণমালার পূর্বরূপ হুনমিন-ঝং উম প্রতিষ্ঠা করেন। যা পরবর্তীতে ১৯৩৩ সালে হ্যাঙ্গুল নামকরণ করা হয়। ১৯৪৬ সালে কোরিয়ার সরকারি লিখিত পদ্ধতি হিসেবে হ্যাঙ্গুল লিপিবদ্ধ হয়। হ্যাঙ্গুল বর্ণমালায় বর্ণের সংখ্যা হয় মোট ৪০টি। 

কোরিয়ান ভাষার বর্ণগুলো খুবই সহজবোধ্য, পদ্ধতিসিদ্ধ ও বিজ্ঞানসম্মত হওয়ায় দ্রুত এর উচ্চারণ আয়ত্ত করা ও লেখা সম্ভব হয়। এইজন্য বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার পর্যালোচনায় সহজ বর্ণমালা হিসাবে স্বীকৃতি পেয়ে হানগূল ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কোর বিশ্বস্মরণীকার মর্যাদা পায়। কোরিয়াতে সরকারিভাবে প্রতিবছর ৯ই অক্টোবর কোরিয়ান বর্ণমালা দিবস (한글 날) পালন করা হয়। 

কোরিয়ান ভাষা বর্ণমালা শিক্ষা

বর্তমানে কোরিয়াতে প্রচলিত ভাষায় হ্যাঙ্গুল ভাষায় বর্ণমালা ব্যবহৃত হয়। কোরিয়ান ভাষার হ্যাঙ্গুলের ক্ষেত্রেও অন্যান্য ভাষার মতো স্বরবর্ণ এবং ব্যঞ্জনবর্ণ রয়েছে। এই ভাষার মৌলিক স্বরবর্ণ এবং ব্যঞ্জনবর্ণ মোট ২৪ টি। এছাড়াও কয়েকটি সংযুক্ত স্বরবর্ণ এবং জোর ব্যঞ্জনবর্ণ রয়েছে। হ্যাঙ্গুল ভাষার মধ্যে পাঁচটি দ্বিগুণ ব্যঞ্জনবর্ণ ব্যবহৃত হয়। 

বর্তমানে কোরিয়ান বর্ণমালায় রয়েছে সর্বমোট ৪০টি বর্ণ। যথাঃ

(১) মৌলিক স্বরবর্ণ – ১০টি (기본 모음 = 10개)

(২) সংযুক্ত স্বরবর্ণ – ১১টি (이중 모음 = 11개)

(৩) মৌলিক ব্যঞ্জনবর্ণ – ১৪টি (기본 자음 = 14개)

(৪) জোড় ব্যঞ্জনবর্ণ – ০৫টি (쌍 자음 = 05개)

এসকল বর্ণগুলো অনেকটাই সহজবোধ্য এবং সরল প্রকৃতির। তবে ‘লাতিন’ (Latin) বর্ণমালা থেকে এর বর্ণগুলো সম্পূর্ণ পৃথক। প্রাচীন চীনা হাঞ্জা বর্নমালার প্রভাবও এতে পরিলক্ষিত হয় না। কোরিয়ান ভাষার এসকল স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণের লিখন পদ্ধতি ও উচ্চারণ নিচে তুলে ধরা হলোঃ

কোরিয়ান ভাষার মৌলিক স্বরবর্ণ

কোরিয়ান বর্ণমালায় স্বরবর্ণ-কে ‘মোঊম (기본 모음)’ বলা হয়। 

হ্যাঙ্গুলের ১০টি মৌলিক স্বরবর্ণ হলো:

• ㅏ 아 = (আ) 
• ㅑ 야 = (ইআ) 
• ㅓ 어 = (অ) 
• ㅕ 여 = (ইঅ) 
• ㅗ 오 = (ও) 
• ㅛ 요 = (ইও) 
• ㅜ 우 = (উ) 
• ㅠ 유 = (ইউ) 
• ㅡ = ঊ/ 으 = ঊ 
• ㅣ= ই/ 이 = ই

কোরিয়ান ভাষা বর্ণমালায় স্বরবর্ণ গুলোকে সাধারণত ২ ভাগে বিভক্ত করা হয়। যথা: 

• মনোফথং 
• ডিফথং

মনোফথং: বর্ণের একক আর্টিকুলার নড়াচড়ার মাধ্যমে তৈরি করা হয়। 

ডিপথং: এটি একটি উচ্চারণমূলক পরিবর্তনের বৈশিষ্ট্য, যা দুটি উপাদান নিয়ে গঠিত হয়ে থাকে। একটি হলো গ্লাইড বা অর্ধস্বর এবং অপরটি হলো স্বয়ং মনোফথং।

কোরিয়ান ভাষার সংযুক্ত স্বরবর্ণ

কোরিয়ান ভাষার সংযুক্ত স্বরবর্ণ (이중 모음) – মোট ১১টি। এগুলো দুটি স্বরবর্ণ একসাথে মিলে তৈরি হয়। এই সংযুক্ত স্বরবর্ণ গুলোর লিখিত রূপ ও উচ্চারণ নিম্নরূপঃ

• ㅏ+ㅣ=­­­ㅐ 애 (য়্যা)
• ㅑ+ㅣ=ㅒ 얘 (ইয়্যা)
• ㅓ+ㅣ=ㅔ 에 (এ)
• ㅕ+ㅣ=ㅖ 예 (ইয়ে)
• ㅗ +ㅏ= ㅘ 와 (ওয়া)
• ㅗ +ㅐ= ㅙ 왜 (ওয়্যা)
• ㅗ +ㅣ= ㅚ 외 (ওই)
• ㅜ +ㅓ= ㅝ 워 (উয়)
• ㅜ +ㅔ= ㅞ 웨 (উয়ে)
• ㅜ +ㅣ= ㅟ 위 (উই)
• ㅡ +ㅣ= ㅢ 의 (ঊই)

কোরিয়ান ভাষার ব্যঞ্জনবর্ণ

কোরিয়ান ভাষা বর্ণমালায় ব্যঞ্জনবর্ণ মোট ১৪টি। বাংলা ভাষার বর্ণমালার মতো এগুলোর নিজস্ব উচ্চারণ থাকলেও শব্দ গঠনের ক্ষেত্রে স্বরবর্ণ ছাড়া উচ্চারিত হতে পারে না। এসকল ব্যঞ্জনবর্ণের লিখিত রূপ ও উচ্চারণ নিম্নরূপঃ 

• ㄱ (গিয়ক) = খ,গ,ক 
• ㄴ (নিয়ন) = ন,ণ 
• ㄷ (দিগুত) = দ,ত 
• ㄹ (রিউল) = র,ল 
• ㅁ (মিউম) = ম 
• ㅂ (বিউপ) = ফ,ব,প 
• ㅅ (সিওত) = ছ,স,ত 
• ㅇ (ইউং) = ং,ঙ 
• ㅈ (জিউত) = ছ,জ,ত 
• ㅊ (ছিউত) = ছ 
• ㅋ (খিউক) = খ 
• ㅌ (থিউত) = থ,ট 
• ㅍ (ফিউপ) = ফ 
• ㅎ (হিউত) = হ 

কোরিয়ান ভাষায় সংযুক্ত ব্যঞ্জনবর্ণ

কোরিয়ান ভাষায় সংযুক্ত ব্যঞ্জনবর্ণ (–자음) মোট ৫ টি। কোরিয়ান শব্দ গঠনের ক্ষেত্রে এসকল বর্ণগুলোও অনেক বেশি পরিলক্ষিত হয়। এসকল সংযুক্ত ব্যঞ্জনবর্ণের লিখিত রূপ ও উচ্চারণ নিম্নরূপঃ 

• ㄲ (ছ্যাং গিয়ক) = ক 
• ㄸ (ছ্যাং দিগুত) = ত 
• ㅃ (ছ্যাং বিউপ) = প 
• ㅆ (ছ্যাং সিওত) = শ 
• ㅉ (ছ্যাং জিউত) = চ 

এসকল বর্ণগুলো পরিপূর্ণভাবে আয়ত্ত করতে পারলে এবং কোরীয় শব্দ গঠন করতে পারলে কোরিয়ান ভাষা সহজভাবে আয়ত্ত করতে পারবেন।

কোরিয়ান বর্ণমালার উচ্চারণ

হ্যাঙ্গুল বর্ণমালা আবিষ্কারের মূলে রয়েছে কোরিয়ান সর্বশ্রেণীর জনসমাজের সহজলভ্য ব্যবহারের উদ্দেশ্যে। তাই করিয়ান বর্ণমালার উচ্চারণও সকলের জন্যই সহজ। রাজা সেজং দ্য গ্রেট – এর নিয়োগকৃত ভাষাবিদ/ পন্ডিতগণ দীর্ঘ ৩ বছরের পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে মানুষের উচ্চারণের জন্য সহজ বর্ণমালা তৈরি করেছিলেন। 

কোরিয়ান ভাষা বর্ণমালার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো এই বর্ণগুলোর নকশা তাদের উচ্চারণের মাত্রা বা সময়ের উপর নির্ভর করে নির্ধারিত হয়েছিল। যেমন: “ㅅ” এই বর্ণটিকে দেখতে কিছুটা দাঁতের মতো মনে হয়। ফলে ㅈ বর্ণটি বা ‘স’ উচ্চারিত হবে জিহ্বার সাথে মুখের উপরের দিকটার সংযোগস্থলে। এভাবেই মুখনিঃসৃত শব্দ গুলো সকলের উচ্চারণের উপযুক্ত করেই কোরিয়ান বর্ণমালা গঠিত।

হ্যাঙ্গুল বর্ণমালা ব্যবহার করে শব্দ তৈরি করার নিয়ম 

হ্যাঙ্গুল ভাষায় স্বতন্ত্র বর্ণ গুলোকে একত্রিত করে শব্দ তৈরি করা হয়। কোরীয় শব্দ বাম থেকে ডানে, উপরে থেকে নীচে লেখা হয়। একটি শব্দাংশে থাকা অক্ষরগুলো বাম থেকে ডানে সাজানো হয়। কোরিয়ান বর্ণমালা ব্যবহার করে নিজে নিজে সেই ভাষার প্রয়োজনীয় শব্দগুলো তৈরি করতে। বর্ণ থেকে শব্দ গঠন প্রক্রিয়ার বিস্তারিত নিচে তুলে ধরা হলোঃ

হ্যাঙ্গুল ভাষার শব্দাংশ 

একটি কোরিয়ান শব্দাংশে সাধারণত দুই থেকে তিনটি উপাদান থাকে। একটি প্রাথমিক ব্যঞ্জনবর্ণ, একটি মধ্যস্বর, এছাড়াও একটি ঐচ্ছিক সংযুক্ত ব্যঞ্জনবর্ণ থাকে। তবে সকল শব্দাংশে সংযুক্ত ব্যঞ্জনবর্ণ থাকে না। কয়েকটি অক্ষরকে একত্রিত করে একটি ব্লক তৈরি করা হয়। প্রতিটি ব্লক একটি শব্দাংশের প্রতিনিধিত্ব করে।

কোরিয়ান ভাষা বর্ণমালার শব্দ গঠন পদ্ধতি

কোরিয়ার হ্যাঙ্গুল ভাষায় স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ একত্রিত হয়ে শব্দ গঠিত হয়। বাংলা ভাষায় শুধুমাত্র ব্যঞ্জনবর্ণ ব্যবহার করেও বহু শব্দ গঠন করা যায়। তবে কোরীয় ভাষার শব্দে স্বরবর্ণের প্রয়োগ থাকা প্রায় আবশ্যক। এক্ষেত্রে শুধুমাত্র স্বরবর্ণ ব্যবহার করেও আলাদাভাবে শব্দ গঠন করা সম্ভব। কয়েকটি শব্দাংশের সমন্বয়ে শব্দ গঠিত হয়। প্রতিটি ব্লক একটি শব্দাংশ। একাধিক ব্লক একসাথে রাখা হলে একাধিক শব্দাংশের সমন্বয়ে একটি শব্দ তৈরি হয়।

শব্দ গঠনে স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণের অবস্থানের প্রভাব 

শব্দ গঠনের সময় একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণের মিল বন্ধন। কিছু স্বরবর্ণ ব্যঞ্জনবর্ণের পাশাপাশি এবং কিছু কিছু উপরে বা নিচে ব্যবহৃত হয়। এক্ষেত্রে শব্দভেদে স্বরবর্ণের অবস্থানের ভিন্নতা থাকে। সাধারণত কোরিয়ার হ্যাঙ্গুল ভাষার স্বরবর্ণ আকৃতির দিক থেকে দুই ধরনের। যথা: 

(১) খাড়া বা ভার্টিক্যাল (Vertical)। যেমন: ㅣ= ই

(2) আনুভূমিক বা হরিজন্টাল (Horizontal)। যেমন: ㅡ (ঊ)

সাধারণত এই দুটি বর্ণ (ㅣ= ই, এবং ㅡ = ঊ) এর ডান, বাম পাশে কিংবা উপরে ও নিচে ছোট চিহ্ন বা দাগ/লাইন টেনেই কোরিয়ান ভাষার অন্যান্য স্বরবর্ণ গুলো তৈরি করা হয়েছে। 

যেমন: 

ㅣব্যবহার করে ㅓ, ㅕ, ㅏ , ㅑ ইত্যাদি। 

ㅡ ব্যবহার করে ㅗ, ㅛ, ㅜ, ㅠ ইত্যাদি।

শব্দ গঠনের সময়, কোরিয়ান ব্যঞ্জনবর্ণের সাথে যখন স্বরবর্ণ যুক্ত হয় তখন খাড়া স্বরবর্ণ গুলো ব্যঞ্জনবর্ণের পাশে বসে। যেমন: 기, 거, 겨, 게, 계 , 가, 갸, 개 , 걔

অন্যদিকে, আনুভূমিক বা হরিজন্টাল স্বরবর্ণ গুলো ব্যঞ্জনবর্ণের নিচে বসে শব্দ গঠন করে। 

যেমন: 그, 고, 교, 구, 규

বর্ণ‌ দিয়ে কোরীয় শব্দ তৈরি 

কোরিয়ান বর্ণগুলোকে জামো (자모) বলা হয়। যেসকল বর্ণগুলো দুটি মাত্রায় সাজানো শব্দাংশ/ ব্লকে লেখা হয় সেগুলোকে জামো বর্ণমালা হিসাবে প্রকাশ করা হয়। 

উদাহরণঃ

(১) বাংলা মৌমাছি শব্দের কোরিয়ান অনুবাদ হলো কুলবিওল। যার লিখিত রূপ- 꿀벌। এই কুলবিওল (꿀벌) শব্দটিকে ভাঙতে চাইলে, সেক্ষেত্রে এটি- “ㄲㅜㄹㅂㅓㄹ” এই রূপে লিখতে হবে। তবে কোরিয়ান লিখন পদ্ধতির শব্দ গঠন নীতি অনুসারে এই কুলবিওল শব্দকে “ㄲㅜㄹㅂㅓㄹ” এই রূপে লেখার পরিবর্তে “꿀벌” এভাবে লেখা হয়। মূলত এসকল যুক্ত শব্দগুলোকেই জামো বলা হয়।

(২) বাংলা ভাত শব্দের কোরিয়ান অনুবাদ হলো প্যাপ। যার লিখিত রূপ- ㅂ: 밥। শব্দটিকে একটু বড় করে তৈরি করা যায়- পোরিবাপ (보리밥)। যার অর্থ- “ভাতের সাথে বার্লি মেশানো কোনো একটি খাবার”

(৩) বাংলা বল শব্দের কোরিয়ান অনুবাদ হলো কং। যার লিখিত রূপ- ㄱ: 공। শব্দটিকে একটু বড় করে তৈরি করা যায়- সায়েগং (새 공)। যার অর্থ- “নতুন বল”।

এভাবে কোরিয়ান ভাষার উচ্চারণ ও শব্দ গঠন প্রক্রিয়া নির্ভর করে শব্দের অর্থ, গঠন, উচ্চারণের মাত্রারউপর।

কোরিয়ান বর্ণমালার ইতিহাস 

কোরিয়ান ভাষার ইতিহাস প্রায় ২ হাজার বছরের পুরনো। তবে প্রথমদিকে এর কোন লিখিত রূপ ছিল না। কোরিয়ান ভাষা বর্ণমালা প্রাকৃতিকভাবে যুগের বিবর্তনে আবির্ভূত হয়নি। মানুষের মনের ভাব প্রকাশের সহজলভ্য ভাষা হিসেবে এর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। পঞ্চদশ শতাব্দী থেকেই হাংগুল বর্ণমালার ইতিহাস-ঐতিহ্যের শুরু। কোরিয়ান বর্ণমালার ইতিহাস, ক্রমবিকাশ, বাধা-বিপত্তি, গঠন ও বর্তমানের ব্যবহার পরিধি নিচে ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হলোঃ

হাংগুল প্রতিষ্ঠার পূর্বে চীনা বর্ণমালা হাঞ্জার ব্যবহার

কোরিয়ান – হাংগুল বর্ণমালার ইতিহাসের সূচনা হয়েছিল প্রায় ৬ শত বছর পূর্বে। পঞ্চদশ শতকের পূর্বে/ হ্যাঙ্গুলের বিকাশের আগে, কোরিয়ান উপদ্বীপে প্রাথমিকভাবে লেখার জন্য কোরিয়ান ভাষায় হাঞ্জা নামক চীনা বর্ণমালা দিয়ে লেখা হতো। এই লেখ্যরূপটি কোরিয়া অঞ্চলে চীনের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আধিপত্য দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। 

এই চীনা অক্ষরগুলো ছিল জটিল প্রকৃতির। হাঞ্জা বর্ণমালায় স্পষ্টভাবে কোন শব্দ লেখায় প্রকাশ করা সম্ভব হতো না। শুধুমাত্র বিভিন্ন ধারনার চিত্ররূপ দিয়ে প্রকাশ করা হতো। সমাজের অভিজাত শ্রেনীর উচ্চ শিক্ষিত লোকজন ছাড়া এ বর্ণমালা সাধারণ মানুষ লিখতে ও পড়তে পারতো না। তাছাড়া সমাজের ধনী ও অভিজাত শ্রেণীর মানুষের মর্যাদার কথা বিবেচনা করে সাধারণ শ্রেণীর মানুষের জন্য এই বর্নমালার ব্যবহার প্রায় নিষিদ্ধ ছিল।

সেজং রাজার সর্বজনীন বর্নমালা প্রনয়নের উদ্যোগ গ্রহন

সমাজের উচ্চ শ্রেণি এবং নিম্ন শ্রেণীর মানুষের লেখন পদ্ধতির এ বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যে পদক্ষেপ নেন জোসন যুগের চতুর্থ রাজা সেজং দ্য গ্রেট (১৩৯৭-১৪৫০)। তিনি ১৪১৮ – ১৪৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত জোসন যুগের রাজা ছিলেন। কোরিয়ান ভাষার প্রতিনিধিত্ব করার জন্য চীনা অক্ষরগুলোর ব্যবহারে যে সীমাবদ্ধতা রয়েছে তা তিনি বুঝতে পেরেছেন এবং স্বীকার করেছিলেন। তিনি সর্বস্তরের কোরিয়ানদের ব্যবহার উপযোগী কোরিয়ান ভাষা বর্ণমালা প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নেন। 

কিন্তু এমন সিদ্ধান্তের সাথে একমত ছিলেন না সমাজের অভিজাত শ্রেণী। শিক্ষিত সমাজের আভিজাত্য আর মর্যাদার প্রভাব তখন খুবই প্রকট ছিল। সাধারণ জনগণ থেকে নিজেদের ভিন্নতা রাখাটাই ছিল অভিজাতদের সবচেয়ে বড় চিন্তা ধারা। ফলে সর্বসাধারণকে অক্ষরজ্ঞান প্রদানের পদক্ষেপটা তারা গ্রহণ করেনি।

হুনমিন-ঝং উম বর্ণমালা প্রতিষ্ঠা 

সকল বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে ১৪৪০ সালে রাজা সেজং তার রয়্যাল সোসাইটির পণ্ডিতদেরকে একটি নতুন, সরল ও সহজবোধ্য বর্ণমালা প্রণয়নের দায়িত্ব দেন। প্রায় শতাধিক ভাষাবিদের তিন বছরের প্রচেষ্টায় প্রণীত হয় কোরিয়ান ভাষার স্বতন্ত্র বর্ণমালা। মানুষের বাক-প্রত্যঙ্গ মুখ, জিহ্বা ও কণ্ঠনালীর উপর দীর্ঘ গবেষণার মাধ্যমে ভাষাবিদরা মোট ২৮ টি অক্ষর (১৭ টি ব্যঞ্জনবর্ণ ও ১১ টি স্বরবর্ণ) প্রস্তাব করেন। তখন তার নামকরণ করা হয়েছিল হুনমিন-ঝং উম (Hunmin-chongum)। 

পরবর্তীতে আরও ৩ বছর আলোচনা-পর্যালোচনা করে পণ্ডিতগণ ১৪৪৬ সালে পূর্ণ ব্যাকরণ, উদাহরণ ও বিস্তারিত ব্যাখ্যাসহ হুনমিন-ঝং উম বর্ণমালা রাজার কাছে হস্তান্তর করেন। সেই বছরের (১৪৪৬ সালের) অক্টোবর মাসে রাজা সেজং সর্বশ্রেনীর কোরিয়ানদের তাঁদের সম্পূর্ণ নিজস্ব বর্ণমালাটি আনুষ্ঠানিক ঘোষণার মাধ্যমে উপহার দেন। বর্তমানেও প্রতিবছর ৯ই অক্টোবর কোরিয়ায় সরকারিভাবে হ্যাঙ্গুল দিবস উদযাপন করা হয়।

হুনমিন-ঝং উম বা কোরিয়ান ভাষা বর্ণমালার ক্রমবিকাশ

রাজা সেজং দ্য গ্রেট – এর হুনমিন-ঝং উম বর্নমালার প্রচলন কোরিয়ার সমাজব্যবস্থায় বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছিল। এই বর্নমালা ব্যবহার করে যোগাযোগের মাধ্যমে শ্রেনী বৈষম্য, শিক্ষা-দীক্ষায় উঁচু-নিচু ভেদাভেদ রাতারাতি ধুলোয় মিশে যেতে লাগলো। 

রাজা সেজং এর এই উদ্যোগ তৎকালীন সমাজের অভিজাত শ্রেণির জন্য গ্রহণযোগ্য ছিল না। পরবর্তী কয়েক শতক অভিজাত শ্রেণীরা নিজেদের হাঞ্জা ভাষাতেই সাহিত্যচর্চা, পড়াশুনা চালিয়ে যেতে লাগলো। অন্যদিকে, শ্রেষ্ঠত্ব হারানোর ভয় আর হতাশা, ক্ষোভ, ঘৃণায় হুনমিন-ঝং উম বর্নমালাকে ‘আবর্জনা’ আখ্যা দিয়ে বিলুপ্ত করারও চেষ্টা করেছে অনেক।

১৯ শতকের শেষের দিকে কোরিয়ায় জাতীয়তাবাদের প্রভাব তীব্রভাবে লক্ষ্য করা যায়। এ সময় হুনমিন-ঝং উম বর্নমালার নতুন নামকরণ করা হয় খুংমুন বা জাতীয় বর্ণমালা। সাহিত্যের ভাষা হিসেবে হাঞ্জার ব্যবহার ব্যাপকভাবে কমতে থাকে। অন্যদিকে, খুংমুনে সাহিত্য চর্চা ‘নিউ নোভেল্লা (New Novella)’ নামে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। 

১৮৮০’র দশকে কোরিয়ায় অবস্থিত – প্রেসবিটারিয়ান ও রোমান ক্যাথলিক মিশনারী স্কুলগুলো (Presbyterian and Roman Catholic Missionary Schools) কোরিয়ান শিশুদের খুংমুন বর্ণমালা শেখাতে শুরু করে। কারন আমেরিকান ও ইউরোপীয়দের জন্য হাঞ্জা বর্নমালার চেয়ে খুংমুন শেখা সহজ ছিল।

১৯০০ সালের দিকে জাপানীরা কোরিয়া দখলের পর কোরিয়ান সংস্কৃতি ধ্বংসের লক্ষ্যে, প্রথমেই খুংমুন ভাষার ব্যবহারে আইনগত নিষেধাজ্ঞা জারি করে। তবে এ অপচেষ্টায় তারা সফল হতে পারেনি। সর্বস্তরের কোরিয়ানরা তাদের ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে নতুন উদ্যমে খুংমুন ব্যবহার শুরু করে। নিজেদের বর্ণমালা রক্ষায় সমগ্র জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রচেষ্টা চালায়।

কোরিয়ান ভাষা বর্ণমালার আধুনিকীকরণ এবং হাংগুল (한글) প্রচলন

১৯ শতকের শেষে ২০ শতকের শুরুর দিকে কোরিয়ান ভাষা ও খুংমুন বর্ণমালা কোরিয়ার প্রধান সাহিত্যিক ভাষা হয়ে উঠে। তখন এই ভাষার জটিলতা কমাতে এবং আরো বেশি যুগোপযোগী করে তুলতে আধুনিকীকরণ ও প্রমিতকরণের দাবী জোরালো হয়। ১৯৩৩ সালে কোরিয়ান ল্যাংগুয়েজ সোসাইটি (Korean Language Society) নিজ উদ্যোগে কোরিয়ান ভাষা ও বর্ণমালা সংরক্ষনের ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এ সময় কোরিয়ান বর্ণমালায় ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল।

এই সময় কোরিয়ান ভাষার আধুনিক ও প্রমিত লিপির নামকরণ করা হলো হাংগুল (한글) বা কোরিয়ান লিপি। হাংগুল জাপানী ঔপনিবেশিক সরকারের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কোরিয়ানদের অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠলো। পত্রপত্রিকা, ম্যাগাজিন, বাইবেলসহ সব ধরনের দৈনন্দিন লেখালেখির প্রচলন হলো হাংগুল বর্ণমালায়। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে পূর্বের হাঞ্জা বর্নমালা প্রায় বই-পুস্তকে মলাটবন্দী হয়ে পড়েছিল। অন্যদিকে, হাংগুল হয়ে ওঠে কোরিয়ান ভাষার সার্বজনীন লেখ্যরূপ। সহজলভ্যতার কারণে সাধারণ মানুষের কাছে এটি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে আজকের সময় পর্যন্ত।  সময়ের সাথে সাথে হ্যাঙ্গুলের ব্যবহার ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে এটি কোরিয়ান সংস্কৃতি, সাহিত্য এবং প্রশাসনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে ওঠে।

হাংগুল (한글) বর্নমালার সমসাময়িক ব্যবহার

বর্তমানে হ্যাঙ্গুল বর্নমালা দক্ষিণ কোরিয়া এবং উত্তর কোরিয়ার সরকারি লিপি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। দুই দেশের লিখন পদ্ধতিতে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। দুটি রূপই ১৯৩৩ সালে প্রণীত ভাষারীতিকে আদর্শ হিসেবে অনুসরণ করে এবং এখনো পর্যন্ত প্রায় একইরকম রয়ে গেছে। তবে দক্ষিণ কোরিয়ার ভাষায় ইংরেজী ও উত্তর কোরিয়ার ভাষায় রুশ পারিভাষিক শব্দের অনুপ্রবেশ এবং ভিন্ন বাগধারার ব্যবহার কোরিয়ান ভাষার দুটি রূপে কিছু সুস্পষ্ট পার্থক্য উত্থাপন করেছে।

রাজা সেজংয়ের সেই সরল কোরিয়ান ভাষা বর্ণমালার উপর ভিত্তি করে প্রণীত হাংগুল আজও আঞ্চলিকতার প্রভাব উপেক্ষা করে দীর্ঘ ৬০০ বছর স্বকীয়তা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। এটি দক্ষিণ কোরিয়ায় উচ্চ শিক্ষার হার উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। শতকরা ৯৮ ভাগেরও বেশী স্বাক্ষরতার হার নিয়ে কোরিয়ান জাতিকে বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে শিক্ষিত জাতিগুলোর একটি হয়ে উঠতে সাহায্য করেছে এই সর্বজনীন বর্নমালা। 

বহু ভাষাবিদদের মতে, হ্যাঙ্গুল বর্ণমালা পৃথিবীর সবচেয়ে নিখুত ও সহজবোধ্য বর্ণমালা। বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার পর্যালোচনায় সহজ বর্ণমালা হিসাবে স্বীকৃতি পেয়ে হানগূল (한글) (কোরিয়ান বর্নমালা) ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কোর বিশ্বস্মরণীকার মর্যাদা পায়। 

কোরিয়া ভাষা জাতীয় পরিচয়ের অন্যতম প্রতীক হয়ে উঠেছে। দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রতিবছর সরকারিভাবে ৯ই অক্টোবর হ্যাঙ্গুল দিবস উদযাপন করা হয়। কারণ এই দিনটিতেই প্রাথমিকভাবে উদ্ভাবিত হয়েছিল হ্যাঙ্গুল বর্ণমালার পূর্বরূপ হুনমিন-ঝং উম। বর্তমানেও সেই চীনা-কোরীয় ভাষার প্রায় ৩,০০০ হাজারেরও বেশি হাঞ্জা শব্দের ব্যবহার কোরীয় ভাষায় লক্ষ্য করা যায়। তবে ধীরে ধীরে তা লুপ্তপ্রায় হয়ে যাচ্ছে।

শেষকথা 

কোরিয়ান ভাষা বর্ণমালা পৃথিবীর অন্যতম সহজ বর্ণমালা। উপরোক্ত আলোচনা থেকে কোরিয়ান বর্ণমালার বর্ণ সমষ্টি, বর্ণের উচ্চারণ, বর্ণ দিয়ে শব্দ গঠন সম্পর্কে জেনেছেন। তাছাড়া কোরিয়ান বর্ণমালার ইতিহাস এই ভাষা সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানকে অনেক বেশি বিকশিত করে। কোরিয়ান ভাষা শিখে দক্ষ হওয়ার জন্য হ্যাঙ্গুল বর্ণমালায় দক্ষতা অর্জন করুন।