চাটগাঁইয়া ভাষা বা চিটাইঙ্গা ভাষা (Chittagonian Language), বাংলাদেশের চট্টগ্রাম অঞ্চলের মানুষের প্রধান কথ্য ভাষা। চাটগাঁইয়া জাতির এই ভাষাটি কথ্যভাষীর সংখ্যা বিবেচনায় বাংলার পরে ২য় বৃহত্তম ভাষা এবং পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ১০০টি ভাষার মধ্যে এর অবস্থান ৮৮তম। চট্টগ্রাম অঞ্চলের বহু আঞ্চলিক গান, লোকসংগীত, সাহিত্য, কাব্য সমগ্র দেশজুড়ে বিখ্যাত। সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য থাকায় চাটগাঁইয়া ভাষা সম্পর্কে বিস্তারিত জানার আগ্রহ পোষণ করেন অনেকেই।
দেশব্যাপী চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার প্রতি বাংলার মানুষ এবং বিশ্ববাসীর যেই জ্ঞানপিপাসা, সেই তৃষ্ণা পূরণ করতেই চাটগাঁইয়া ভাষা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য থাকছে এই নিবন্ধে।
চাটগাঁইয়া ভাষা
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের, প্রধানত চট্টগ্রাম বিভাগের অধিকাংশ মানুষের আঞ্চলিক ভাষাই চাটগাঁইয়া বা চিটাইঙ্গা ভাষা। এটি চট্টগ্রাম বিভাগের চট্টগ্রাম জেলা, কক্সবাজার জেলার মানুষের প্রধান ভাষা। এছাড়াও রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের প্রায় ৪৫% মানুষ এই ভাষায় কথা বলে।
ধারণা করা হয়, এই ভাষার প্রচলন হয়েছিল বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন- ‘চর্যাপদ’ রচিত হওয়ার পূর্বেই। প্রাচীন ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবার থেকে কালের বিবর্তনে এই ভাষার জন্ম হয়েছে। অধিকাংশ ভাষাবিদদের মতে, এটি একটি স্বতন্ত্র ভাষা হিসেবে বিবেচিত। তবে বাংলা ভাষার সাথে এর শব্দগত ও অঞ্চলগত মিল থাকায় এটিকে বাংলা ভাষার একটি উপভাষা বলা হয়।
অচল ভেদে এই ভাষার কয়েকটি উপভাষা রয়েছে। যেমন: চট্টগ্রাম শহরাঞ্চলের ভাষা, চট্টগ্রামের উত্তরাঞ্চলের ভাষা, চট্টগ্রামের দক্ষিণাঞ্চলের ভাষা ও কক্সবাজারের চিটাইঙ্গা ভাষা। এটি বাংলা, অসমীয়া, বিহারি, ওড়িয়া, সিলেটি ও রোহিঙ্গা ভাষাগুলোর সমগোত্রীয় ভাষা। এই ভাষার নিজস্ব কোন লিখন পদ্ধতি নেই। তাই চট্টগ্রাম অঞ্চলের অধিবাসীরা একে বাংলা বর্ণমালা, লাতিন বর্ণমালা ও আরবি হরফে লিখে প্রকাশ করে।
প্রাচীনকালের সেই চর্যাপদ থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত চাটগাঁইয়া উপভাষায় কয়েক হাজার সাহিত্য, কবিতা ও লোকসংগীত রচিত হয়েছে। এই ভাষার ব্যাকরণবিধি ও বাক্য গঠন রীতি বাংলা ভাষা থেকে অনেকটাই ভিন্ন। বর্তমানে চট্টগ্রামের কোটি মানুষের প্রাণের ভাষা হিসেবে চিটাইঙ্গা ভাষা লোকমুখে ছড়িয়ে আছে।
চাটগাঁইয়া ভাষার ইতিহাস
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা উৎপত্তির সঠিক ইতিহাস বর্তমান সময় অব্দি উদঘাটন করা যায়নি। ধারণা করা হয়, চিটাইঙ্গা ভাষাটি বাংলা ভাষা থেকেও প্রাচীন। এটি মূলত প্রাচীন ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবার থেকে পর্যায়ক্রমিকভাবে ইন্দো-ইরানীয়, তারপর ইন্দো-আর্য ভাষা শাখার পূর্বাঞ্চলীয় ইন্দো-আর্যের উপশাখা বাংলা-অসমীয় ভাষার একটি সদস্য। অন্যান্য বাংলা-অসমীয় ভাষার অনুরূপ বিবেচনায় ধারণা করা হয়, পালি ভাষা চাঁটগাঁইয়ার পূর্বসূরী।
ইতিহাস অনুযায়ী, প্রাচীন চট্টগ্রাম অঞ্চলের আনোয়ারার দেয়াঙ পাহাড়ে অষ্টম শতকের দিকে পন্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পূর্বেই প্রাচীন চিটাইঙ্গা ভাষার প্রচলন ছিল। তবে তার নিজস্ব নাম ও পরিচিতি ছিলনা। আনুমানিক নবম-দশম শতকের পূর্বে চট্টগ্রাম অঞ্চলের নামের কোন অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।
প্রাচীন আরাকানের ইতিহাস অনুসারে জানা যায়, আরাকান রাজ্যের আঞ্চলিক সদর দপ্তর ছিল চক্রশালা। আনুমানিক ২০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে প্রাচীন চট্টগ্রামের চক্রশালায় একটি বৌদ্ধবিহার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। এটি বাংলাদেশের প্রাচীনতম বিহার বলে বিবেচিত। এটি ছিল গৌতম বুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত চক্রশালা। গৌতমবুদ্ধের জীবিতাবস্থায় যেই বৌদ্ধচক্র নির্মিত হয়েছিল, সেই স্থানকে ঘিরেই চক্রশালার বৌদ্ধবিহারটি নির্মিত হয়েছিল।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সেই কালে বৌদ্ধধর্মের প্রচার, ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান ও বৌদ্ধ ধর্মীয় সাধারণ অনুসারীদের ধর্মীয় বিধিবিধান সম্পর্কে জ্ঞানদানের উদ্দেশ্যেই বিহারটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। আরাকানের বৌদ্ধ ধর্মীয় অনুসারীদের কাছে ধর্মীয় বাণী সহজে বোধগম্য করার জন্য নিজস্ব আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহারও ছিল অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
তৎকালীন ব্রাহ্মণরা ছিল সংস্কৃতভাষী। সংস্কৃতভাষী ব্রাহ্মণদের দৌরাত্ম্য থেকে সাধারণ মানুষের মুখের ভাষাকে রক্ষার জন্য গৌতম বুদ্ধ নিজেই আঞ্চলিক ভাষায় ত্রিপিটক রচনা করেছিলেন। যা চক্রশালার বৌদ্ধবিহারের অনুসারীদের অনুপ্রাণিত করেছিল। ফলে বিহারের বৌদ্ধপন্ডিতগণ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত হলেও সাহিত্যচর্চায় তৎকালীন চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষাকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করতো। তখন থেকেই এই ভাষার বিস্তার লাভ হয় সাধারণ মানুষের মাঝে।
ঐতিহাসিক কালে ভাষাটির সঠিক নাম সম্পর্কিত কোন তথ্য জানা যায়নি। অষ্টম শতকে পূর্ববঙ্গের চট্টগ্রামে পন্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হওয়ার পর থেকেই চিটাইঙ্গা ভাষায় বিভিন্ন সাহিত্য রচিত হতে থাকে।
চাটগাঁইয়া ভাষার নামকরণ
অধিকাংশ ভাষা উৎপত্তিগত অঞ্চলের নামানুসারে ভাষার নামকরণ করা হয়। চিটাইঙ্গা ভাষারও নামকরণ হয়েছিল এই অঞ্চলের প্রাচীন নাম অনুসারে। দশম শতকের পূর্বে চট্টগ্রাম নামের কোন অস্তিত্ব ছিল না। প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান সময় অব্দি চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রায় ৪৮টি নাম পাওয়া গেছে।
প্রাচীনকাল থেকে এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের পরিব্রাজক, পন্ডিতদের অঙ্কিত মানচিত্র, লিখিত বিবরণ, চট্টগ্রাম অঞ্চলের গৌড়ের সুলতান ও রাজাদের মুদ্রাতে এই অঞ্চলটি বিভিন্ন নামে খ্যাত ছিল। তন্মধ্যে, সুহ্মদেশ, ক্লীং, রম্যভূমি, চাতগাঁও, সপ্তগ্রাম, চৈত্যগ্রাম, চট্টল, চট্টলা, শ্রীচট্টল, চাটিগাঁ, চক্রশালা, পুস্পপুর, চিতাগঞ্জ, চাটিগ্রাম ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
আনুমানিক দশম ও একাদশ শতকে আরাকানে চন্দ্ররাজারা চট্টগ্রামের শাসক ছিল। তৎকালীন চন্দ্র বংশীয় রাজা সু-লা-তাইং-সন্দয়া ৯৫৩ সালে বাংলা অভিযানে বের হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি চট্টগ্রাম অতিক্রম না করে সীতাকুণ্ড অঞ্চলে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেন। যার শিলালিপিতে চেৎ-ত-গৌঙ্গ (অর্থ: যুদ্ধ করা অনুচিৎ) লিখিত ছিল। তারপর থেকে এই এলাকার নামকরণ হয় ‘চেত্তগৌং’। কালের বিবর্তনের সেটি চাটগাঁ, চাটিগ্রাম, চট্টগ্রাম, চিটাগাং নামে পরিবর্তিত হয়।
এই অঞ্চলের নামানুসারে অঞ্চলের ব্যবহৃত ভাষাকে ‘চাটগাঁইয়া ভাষা’ নামকরণ করা হয়। সাহিত্য বিশারদ ব্রিটিশ ভাষাবিদ ও পণ্ডিত – ‘গ্রীয়ার্সন’ তার আলোচনায় চট্টগ্রামের উপভাষাকে ‘দক্ষিণ-পূর্ববাংলা’ উপভাষার অন্তর্গত করে ‘চাটগাইয়া’ নামকরণ টি সম্প্রসারিত করতে চেয়েছেন।
চাটগাঁইয়া উপভাষার ভৌগোলিক বিস্তার
অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যবর্তী সময়ে, পন্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পন্ডিতগণ শিক্ষাদানের সুবিধার্থে এই অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করতো। চিটাইঙ্গা ভাষায় সেই কালেই রচিত হয়েছিল বাংলা ভাষার প্রাচীন নিদর্শন ‘চর্যাপদ’। তখন মানুষের মুখে মুখে প্রাচীন বাংলা ভাষায় বিভিন্ন কবিতা, পদ রচনা হতো। যা ছিল চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শনের সূচনা।
যুগে যুগে মৌখিক ব্যবহারের পাশাপাশি বাংলা, লাতিন ও আরবি হরফে এই ভাষার লিখিত সাহিত্য প্রচলিত হয়। একুশ শতকে এসে, বর্তমানে চিটাইঙ্গা ভাষা ব্যাপকভাবে কোটি মানুষের মুখের ভাষা/ মাতৃভাষা হয়ে উঠেছে। ২০০৯ সালের সমীক্ষা অনুযায়ী, প্রায় ১৩ মিলিয়ন বা ১ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষ চাটগাঁইয়া ভাষায় কথা বলে।
২০২০ সালে কানাডাভিত্তিক ওয়েবসাইট- ‘ভিজ্যুয়াল ক্যাপিটালিস্ট’ এ, বিশ্বের সেরা ১০০টি কথ্য ভাষার তালিকা প্রকাশ করা হয়। সেই তালিকায় চাটগাঁইয়া ভাষা পৃথিবীর বৃহৎ ভাষা গুলোর মধ্যে ৮৮ তম স্থান দখল করেছে। তবে, অনেকের মতে এই ভাষা ব্যবহারকারীর সমীক্ষাটি ২০০৯ সালের সমীক্ষা অনুযায়ী প্রণীত। বর্তমানে ২০২৩ সালে এসে, প্রায় ১৪ বছরে এই ভাষার ব্যবহারকারীর সংখ্যা স্বাভাবিকভাবেই অনেক বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ কথ্য ভাষার দিক থেকেও বাংলার পরেই ২য় বৃহত্তম ভাষা হলো চিটাইঙ্গা ভাষা। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রাম বিভাগের চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলার মানুষের প্রধান ভাষা চাটগাঁইয়া উপভাষা। এছাড়া পার্বত্য তিন জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের মানুষেরা চাটগাঁইয়া ভাষায় কথা বলে। এই অঞ্চলের জনসংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি এই ভাষার ব্যবহারকারীর সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
চাটগাঁইয়া ভাষার উপভাষা
স্বাভাবিকভাবেই প্রতিটি অঞ্চলের মানুষের কথ্য ভাষার মধ্যে আঞ্চলিকতার টান লক্ষ্য করা যায়। বৃহত্তর অর্থে চাটগাঁইয়া ভাষা – রোঁয়াই ও চাডি দুইভাবে বিভক্ত। তবে উপভাষিক দিক থেকে, চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন অঞ্চল ভেদে চিটাইঙ্গা ভাষার প্রধান ৪টি উপভাষা পাওয়া যায়। এগুলো হলোঃ
- মাতামুহুরীর দক্ষিণ তীর থেকে নাফনদী পর্যন্ত।
- কর্ণফুলী নদীর উত্তরতীর থেকে চন্দ্রনাথ পাহাড়ের পূর্ব ঢাল পর্যন্ত।
- চন্দ্রনাথের পশ্চিম ঢাল থেকে ফেনী নদী পর্যন্ত।
- কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ তীর থেকে মাতামুহুরী নদী পর্যন্ত।
এছাড়াও ধর্মভেদে চাটগাঁইয়ার কথ্যরূপে পার্থক্য দেখা যায়। চট্টগ্রামের মূল জনগোষ্ঠী মুসলমান। এর পাশাপাশি চট্টগ্রামে বসবাসরত হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মীয়দের পরস্পরের ব্যবহৃত ভাষায় ভিন্নতা দেখা যায়। অন্যদিকে, চট্টগ্রাম অঞ্চল দেশের উপজাতিদের বসবাসের অন্যতম স্থান হওয়ায় অন্যান্য উপজাতীয় ভাষায় টানাপোড়েনে এই ভাষার উচ্চারণে ভিন্নতা লক্ষণীয়।
চাটগাঁইয়া ভাষার সতন্ত্রতা
বাংলা ভাষাভাষী বহু ভাষাবিদ ও পন্ডিত মৌন স্বীকৃতির মাধ্যমে চট্টগ্রামের ভাষার স্বাতন্ত্র্য স্বীকার করেছেন। বিখ্যাত গদ্যকার- প্রমথ চৌধুরী বলেছিলেন, “বাংলা ভাষা আহত হয়েছে সিলেটে, আর নিহত হয়েছে চট্টগ্রামে।” এই উক্তির মাধ্যমে তিনি চট্টগ্রামের ভাষাকে ভিন্ন ভাষা বা অন্য পারের ভাষা হিসেবে প্রকাশ করেছেন। বস্তুত চট্টগ্রামীয় ভাষা বাংলাদেশ ভূখণ্ডের অভ্যন্তরীণ ভাষা হলেও, প্রকৃতপক্ষে এটি লুপ্ত আরাকানের উত্তর-পশ্চিমাংশের ভাষা।
গ্রীয়ার্সন, ১৯০৩ সালে প্রকাশিত তার “লিঙ্গুয়েস্টিক সার্ভে অব ইণ্ডিয়া” গ্রন্থে বলেছেন- “বাংলা থেকে অসমীয়া ভাষার যতটা দূরত্ব রয়েছে, চট্টগ্রামের বুলির স্বাতন্ত্র্য তদপেক্ষা দূরত্ব প্রমাণ করতে সক্ষম।” ১৯১৯ সালে প্রকাশিত ‘ইসলামাবাদ’ গ্রন্থে লেখক আবদুল করিম (সাহিত্য বিশারদ) দাবি করেছেন- “লিখিত ভাষার সহিত চট্টগ্রামের কথ্যভাষার বৈষম্য খুবই বেশী। এত বেশী যে চেষ্টা করিলে অসমীয়ার মতো চট্টগ্রামীরাও অনায়াসে একটা পৃথক ভাষার সৃষ্টি করিতে পারিতাম।” নোয়াখালী ও ত্রিপুরার ভাষার সাথে চট্টগ্রামী ভাষার কিছু মিল পাওয়া যায়। তবে এটি একটি পৃথক ভাষার সকল বৈশিষ্ট্য ধারণ করে আছে।
কিছুকাল পূর্বে জার্মান গবেষক ড. হান ও ফিনল্যাণ্ডের ফোকলো’র গবেষক ড. ভেলাইটি চট্টগ্রামের ভাষায় নির্মিত মাইজভাণ্ডারী গান নিয়ে গবেষণা করেছেন। এ বিষয়ে সাহিত্যিক মহলের বিভিন্ন আলোচনায় তারা বলেন, “চট্টগ্রামের ভাষা বাংলা ভাষার অন্তর্ভুক্ত নয়, এটি একটি আলাদা ভাষা।”
কবি বুদ্ধদেব বসু বিষ্ময়ের সাথে নোয়াখালীতে অবস্থান করেই চট্টগ্রাম অঞ্চলের ভাষাকে অনুধাবন করেছেন। এই ভাষার মাধুর্য নিয়ে তিনি তার স্মৃতিকথায় উল্লেখ করেছেন- “আর কোথাও শুনিনি সেই ডাক, সেই ভাষা, সেই উচ্চারণের ভঙ্গি।” শুধুমাত্র নিজস্ব বর্ণমালা নেই বলেই চাটগাঁইয়া ভাষাকে অনেকে বাংলার উপভাষা বলে মনে করেন। তবে লিখিত রূপ না থাকলেও মৌখিক দিক থেকে এটিকে সর্বাঙ্গসম্পূর্ণা ভাষা বলা হয়।
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় চর্যাপদ রচনা
অষ্টম শতক থেকেই বাংলা ভাষায় সাহিত্যের বিশাল ভান্ডার রচিত হয়েছিল। তারই ধারাবাহিকতায়, অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে বাংলা ভাষা তার বর্তমান রূপ ধারণ করেছে। এই পর্যন্ত পাওয়া, বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন হলো ‘চর্যাপদ’। ১৯০৭ সালে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজকীয় গ্রন্থাগারে হাতে লেখা একটি পুঁথির সন্ধান পান। যার নাম ছিল ‘আশ্চর্য চর্যাচয়’/ ‘চর্যাচর্য বিনিশ্চয়’। এটি সাধারণভাবে ‘চর্যাপদ’ নামে পরিচিত। এই পুঁথির কবিতাগুলো বৌদ্ধ বাউল বা বৌদ্ধ লোকধর্মের অনুসরণ করে। এর রচয়িতাগণ বিভিন্ন উপায়ে ধর্মীয় বিষয়াদি, বাংলাদেশের প্রকৃতি ও জনজীবনের কথা ফুটিয়ে তুলেছেন।
চর্যাপদের ভাষা বর্তমান বাংলা ভাষার চেয়ে, চট্টগ্রামের ভাষার সাথে বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ। বিশেষজ্ঞদের মতে, চট্টগ্রামের প্রাচীন চক্রশালায় অবস্থিত পন্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন চর্যাপদ সমূহ রচিত হয়েছিল।
পন্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর পূর্ববঙ্গে সাহিত্যসাধনা ও বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের মিলনকেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা তাদের যোগ সাধনা, অধ্যাপনা ও অধ্যয়নের পাশাপাশি অবসর সময়ে স্থানীয় সাধারণ মানুষের মুখে প্রচলিত ভাষায় বিভিন্ন গান, দোঁহা, কবিতা ও পদ রচনা করেছিলেন। যারা চর্যাপদ রচনা করেছিলেন তাদের সিদ্ধাচার্য বলা হতো। বর্তমানকালে সিদ্ধাচার্যদের সেই গ্রন্থগুলোই চর্যাপদ নামে স্বীকৃতি পেয়েছে।
চট্টগ্রামেই এসব চর্যা বা দোহাগাণ রচিত হওয়ায় চর্যাপদের বাক্যগঠনে চিটাইঙ্গা ভাষার প্রভাব স্পষ্ট। এগুলোর ভাষা, শব্দগঠন, উৎপত্তিগত ইতিহাস, না-বোধক শব্দের অবস্থান, রচয়িতাদের ধর্মীয় প্রভাব, আধুনিক চট্টগ্রামের ভাষার সাহিত্যকর্ম ইত্যাদি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, চট্টগ্রামেই চর্যাপদ রচিত হয়েছিল।
চাটগাঁইয়া ভাষায় চর্যাপদের গ্রন্থসমূহ
চর্যাপদের অধিকাংশ চর্যায় চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার বাক্যগঠন শৈলী লক্ষণীয়। ‘আশ্চর্য চর্যাচয়’/ ‘চর্যাচর্য বিনিশ্চয়’ পুঁথিতে ২৩ জন কবির মোট ৫০টি পদ ছিল। তবে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর আবিষ্কৃত পান্ডুলিপিটি খন্ডিত ও ছেড়া থাকায় সাড়ে ৪৬ টি পদ পাওয়া গেছে। চর্যাপদের সেই ২৩ জন কবির অধিকাংশ লেখাতেই চট্টগ্রামী ভাষার শব্দ গঠন রীতি স্পষ্টভাবে ব্যবহৃত।
আদি চর্যাকার লুইপা, কাহ্নুপা, ডোম্বীপা, কুক্কুরীপা, ভুসুকুপা, গুন্ডরীপা, শান্তিপা, মহিধরাপাসহ প্রায় সকলের চর্যাপদে প্রাচীন চট্টগ্রামের ভাষার বাক্য গঠন ও শব্দ বিন্যাস দেখা যায়। এদের চর্যাপদের বাক্যে শব্দে শব্দে ব্যবহৃত হয়েছে চন্দ্রবিন্দু। চাটগাঁইয়া আঞ্চলিক ভাষার মতোই না-বোধক শব্দটি ক্রিয়া পদের পূর্বে ‘ন’ হয়ে বসেছে।
চাটগাঁইয়া ভাষার ব্যাকরণ
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় বাংলা থেকে বিভিন্ন কিছু ব্যাকরণবিধি রয়েছে, যা একে একটি স্বতন্ত্র ভাষার দ্বারপ্রান্তে রেখেছে। নিম্নে চট্টগ্রামের ভাষার সংক্ষিপ্ত ব্যাকরণিক প্রয়োগ তুলে ধরা হলোঃ
ধ্বণিতত্ত্ব
বাংলা ভাষার সাথে চট্টগ্রামের ভাষায় ধ্বনিতাত্ত্বিক বহু পার্থক্য রয়েছে। চিটাইঙ্গা ভাষার ধ্বনির বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এই ভাষাতে ৩৬টি ব্যঞ্জনধ্বনি ও ৭টি স্বরধ্বনি রয়েছে। সকল ধ্বনি গুলোর আনুনাসিক রূপও রয়েছে। এই ভাষায় একটানা টেনে কথা বলার প্রচলন বেশি।
চট্টগ্রামীয় ভাষা উচ্চারণের সময় সামান্য ভিন্ন উচ্চারণ হলেই অর্থ পরিবর্তিত হতে পারে। যেমন: ‘আঁর’ শব্দের অর্থ আমার; ‘আর’ শব্দের অর্থ এবং। এখানে উচ্চারণ প্রায় একই, তবে কিছুটা ভিন্নতার কারণে অর্থও ভিন্ন। চট্টগ্রামের ভাষার ধ্বনিতত্ত্বের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য হলোঃ
- ‘ক’ কে ‘হ’ উচ্চারণ করা হয়। যেমন: কথা > হতা।
- দ্রুত কথা বলার সময় নাকের অতি সুপ্ত একটা ব্যঞ্জনা স্পর্শলাভ করে, ফলে ধ্বনিগুলো চাপা হয়ে বেরিয়ে আসে।
- অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রথম ধ্বনিগুচ্ছ ও শেষ ধ্বনিগুচ্ছ ধরেই বাক্য সম্পূর্ণ হয়।
- মধ্যের সকল ধ্বনি বা শব্দ উচ্চারিত হয় না। যেমন: আমার > আর।
- চট্টগ্রামী উপভাষায় অন্তঃস্থ বর্ণগুলো অন্যান্য উপভাষা থেকে স্পষ্ট।
বাচ্যভেদ
চট্টগ্রামের ভাষার বাক্য গঠনে প্রধানত চার ধরনের বাচ্যভেদ দেখা যায়। যথাঃ
- কর্তৃবাচ্য;
- কর্মবাচ্য;
- ভাববাচ্য;
- কর্ম-কর্তৃবাচ্য।
এগুলোর ব্যবহারের নিচে দেখানো হলোঃ
কর্তৃবাচ্য: ইতানি হেনো জার। (তারা সেখানে যাচ্ছে)
কর্মবাচ্য: আঁই যাইয়ুম। (আমি যাবো)
ভাববাচ্য: তোয়ার জওন ন অইল। (তোমার যাওয়া হলো না)
কর্ম-কর্তৃবাচ্য: তোয়ার হরগান ছিরি গেইয়ই। ( তোমার কাপড়টা ছিঁড়ে গেছে)
বচন ও কারক
চাটগাঁইয়া ভাষার উৎপত্তি সংস্কৃত ভাষা থেকে হলেও, এর ব্যাকরণ বিধিতে সংস্কৃতি থেকে ভিন্নতা রয়েছে। সাধারণত সংস্কৃত ভাষায় ৩ ধরনের বচন ব্যবহার করা হয়। যথাঃ একবচন, দ্বিবচন ও বহুবচন। তবে চট্টগ্রামের ভাষা বাংলা ভাষার মতোই, একবচন ও বহুবচন এ দুই ধরনের বচন ব্যবহার করে। উদাহরণ হিসেবে, ‘মানুষ’ শব্দটি ব্যবহার করে কারক ও বচনের ভিত্তিতে বিভিন্ন রূপ দেখানো হলোঃ
কারক | একবচন | বহুবচন |
কর্তৃ কারক | মানুশ | মানুশগুন |
কর্ম কারক | মানুশরে | মানুশগুনরে |
করণ কারক | মানুশরেদি | মানুষগুরেদি |
সম্প্রদান কারক | মানুশরলাই | মানুশগুনরলাই |
অপাদান কারক | মানুশরতুন | মানুশগুনত্তুন |
সম্বন্ধ কারক | মাইনশর | মানুশগুনর |
অধিকরণ কারক | মাইনশততে | মানুষগুনর মইদদে |
অব্যয়
বাংলা ভাষার ব্যাকরণে না-বোধক অব্যয় – ক্রিয়াপদের পরে বসে। কিন্তু চাটগাঁইয়া আঞ্চলিক ভাষার ব্যাকরণে না-বোধক অব্যয় সর্বদা ক্রিয়াপদের পূর্বে বসে। যেমন:
- আমি খাবো না > আঁই ন খাইয়্যুম।
- আমি এই কাজটি করতে পারবো না > আঁই হাম ইয়ান গরিত ন ফাইরগুম।
কাল
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার ব্যাকরণে স্বরের পরিবর্তন (টান) – এর মাধ্যমে কালের পরিবর্তন হয়। যেমন:
- আমি ভাত খাই না > আঁই ভাত ন খাই।
- আমি ভাত খাই নি > আঁই ভাত নঅ খাই।
এটি বাংলা ভাষার ব্যাকরণ থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র একটি নিয়ম।
এছাড়াও চট্টগ্রামীয় ভাষায় উপসর্গ, অনুসর্গ এবং অন্যান্য উপায়ে শব্দের কলেবর ও বাক্যের কাল পরিবর্তনের বৈচিত্র্য লক্ষণীয়। যেমন:
- আমি এই কাজটি গতকাল করেছি > আঁই হাম ইয়ান গেলদে হালিয়ে গইরগি।
- আমি এই কাজটি এখন করছি > আঁই হাম ইয়া গরির।
- আমি এই কাজটি আগামীকাল করবো > আঁই হাম ইয়েন আইয়েদ্যে হালিয়ে গইরগুম।
এছাড়াও চিটাইঙ্গা ভাষা অন্যান্য ব্যাকরণিক দিক থেকেও বাংলা ভাষার থেকে ভিন্নতা প্রকাশ করে।
চাটগাঁইয়া ভাষার অন্যান্য স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য
চট্টগ্রামী ভাষায় বাংলা ভাষা থেকে ভিন্ন অন্যান্য ব্যাকরণিক প্রয়োগ গুলো হলোঃ
বিদেশী শব্দের ব্যবহার
অন্যান্য বিদেশী ভাষার শব্দ চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহৃত হলে, সেই সকল শব্দের মধ্যে বা শেষে ‘হ’ ধ্বনি থাকলে, তা উহ্য হয়ে যায় এবং সেই স্থানে টেনে বলতে হয়। যেমন:
- বাংলা- পাহাড় > চাটগাঁইয়া- ফাআর
- আরবি- সহি > চাটগাঁইয়া- সই
- ফারসি- মহব্বত > চাটগাঁইয়া- মঅব্বত
- ফারসি- মেহেরবানি > চাটগাঁইয়া- মে’রবানি
অন্যান্য বিদেশি শব্দের শুরুতে ‘হ’ থাকলে, তা উহ্য হয়ে সেই স্থানে চাপ দিয়ে বলতে হয়।
- আরবি- হয়রান > চাটগাঁইয়া- অরান
- বাংলা- হলুদ > চাটগাঁইয়া- অলইদ
স্বরসংক্রান্ত ভাষা বৈচিত্র
সাধারণত বাংলা ভাষা একটি বর্ণনাত্মক ভাষা। তবে চাটগাঁইয়া ভাষাটি স্বরসংক্রান্ত ভাষা। এই ভাষাতে একটি শব্দের স্বর কিছুটা পরিবর্তন করার মাধ্যমেই ভিন্ন অর্থ প্রকাশ করা যায়। যেমন:
- আর = এবং
- আঁর = আমার
- ফঅর = আলো
- ফর = পড়
- হানা – অন্ধ
- হাঁনা – খাবার
শব্দ সংক্ষেপণ ও উচ্চারণ সহজীকরণ
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার শব্দসংক্ষেপণ রীতি বাংলা ভাষা থেকে স্বতন্ত্র এবং উল্লেখযোগ্য একটি বৈশিষ্ট্য। বিভিন্ন ঐতিহাসিক কারনে পূর্ব থেকেই চট্টগ্রামের অধিবাসীরা বাংলা ভাষার দীর্ঘ শব্দের সংক্ষিপ্ত অবয়ব ব্যবহার করে আসছেন। উদাহরণস্বরূপ:
- চাটগাঁইয়াতে শব্দের মধ্যস্থিত ‘ব’ লোপ পায়। যেমন: রবিবার > রইবার।
- শব্দের মধ্যস্থিত ‘ম’ আনুনাসিক চন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। যেমন: আমার > আঁর।
কিছু কিছু পণ্ডিত এই শব্দ সংক্ষেপণকে উচ্চারণের কোমলীকরণ বলেও মত দিয়েছেন। এছাড়াও-
- পদমধ্যবর্তী ব্যঞ্জনবর্ণ প্রায়ই বিকৃত হয় বা লোপ পায়। পূর্ণবিকৃতিও হয় মাঝে মাঝে।
- ধ্বনিতত্ত্বে ঘোষ মহাপ্রাণ বর্ণগুলো, যেমন: ঘ, ধ, ভ ইত্যাদি এবং আদি ‘হ’ রতি আছে।
- রূপতত্ত্ব একবচনে ‘র’ ব্যবহৃত হয়।
- অধিকরণের এক বচনে ‘ত’ বিভক্তি হয়।
- নিষেধার্থক অব্যয় ‘ন’- ক্রিয়ার পূর্বে বসে।
- ক ধ্বনি খ-এর মতো এবং প ধ্বনি ফ-এর মতো উচ্চারিত হয়, কিন্তু উচ্চারণে তেমন জোর পড়ে না।
- অনেক সময় ‘র’ কে ‘ল’ উচ্চারণ করা হয়।
উচ্চারণ বৈচিত্র্য
চট্টগ্রামী ভাষাতে সপ্তমি বিভক্তিযুক্ত ও অসমাপিকা ক্রিয়ার ‘এ-কার’ লোপ পায় এবং শেষের বর্ণটি হসন্তযুক্ত হয়। এই ভাষায় শব্দের শুরুতে শ, ষ, স থাকলে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা ‘হ’ বর্ণে রূপান্তরিত হয়। একই শব্দ উচ্চারণের টান কম-বেশি হওয়ার কারনে অর্থ পরিবর্তিত হয়।
শব্দার্থ বৈচিত্র্য
প্রমিত বাংলা ভাষার একই শব্দ চট্টগ্রামীয় ভাষাতে এসে ভিন্ন অর্থ তৈরি করে। কোন শব্দের বিশিষ্ট দীর্ঘ ভাবকে সংক্ষিপ্ত অর্থে সুন্দরভাবে প্রকাশ করে। চাটগাঁইয়া ভাষায় শব্দসংক্ষেপনের এই অসীম ক্ষমতা ও প্রতিশব্দের আধিক্য রয়েছে।
চাটগাঁইয়া আঞ্চলিক ভাষার শব্দভান্ডার
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার শব্দভাণ্ডার অনেক বেশি বিস্তৃত, যা একটি স্বতন্ত্র ভাষা হওয়ার জন্য যথেষ্ট। চট্টগ্রামের অধিকাংশ শব্দভাণ্ডার সংস্কৃত থেকে উদ্ভূত। প্রাচীনকাল থেকেই চট্টগ্রাম অঞ্চল বন্দরনগরী হওয়ায় বিভিন্ন অঞ্চলের সাথে ব্যাপক বাণিজ্য সাধিত হতো। অঞ্চল সমূহের মধ্যে বিশেষ করে আরব, তুর্কি ও ফার্সি বণিকদের যোগাযোগ ও যাতায়াত ছিল সবচেয়ে বেশি। এছাড়াও ইউরোপীয় অঞ্চলভুক্ত পর্তুগিজ ও পরবর্তীতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সাথে এই বাণিজ্য আরও প্রসারিত হয়।
বিদেশী বিভিন্ন দেশের ভাষা ও সংস্কৃতির সংমিশ্রনে এসে চট্টগ্রামের ভাষায় বাংলার চেয়ে অধিক পরিমাণে আরবি, ফার্সি, পর্তুগিজ শব্দের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। ১৩৫৩ বঙ্গাব্দে (বাংলা সনে) সাহিত্যিক আব্দুর রশিদ সিদ্দিকী তার ‘চট্টগ্রামী ভাষাতত্ত্ব’ বইয়ে বলেন, “উর্দূ-ই চট্টগ্রামী ভাষার বাহন, আরবি ইহার অঙ্গপ্রত্যক্ষ, পার্শি ইহার অঙ্গরাগ এবং বাঙ্গলা ইহার নয়নাঞ্জন।” বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষার সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা বিশাল শব্দ ভান্ডারের কিছু তালিকা নিচে তুলে ধরা হলোঃ
প্রমিত শব্দ | চাটগাঁইয়া শব্দ |
টাকা | টিঁয়া |
ভালো | গম |
খারাপ | হরাপ/ গম নয় |
লেবু | হঁজি |
কাঠাল | হাট্টল |
খাওয়া-দাওয়া | হানাফিনা |
পাট শাক | নারিছ শাক |
ডাটা শাক | ডেঁড়া শাক |
জ্যোৎস্না | জোনাফ্ফর |
ছেলেমেয়ে | ফোয়াসা |
দাড়াঁন | তিয়্যন |
দক্ষিণ | দইন |
গোয়ালঘর | গরুর গোতাইল/ গরুর ওরা |
মুরগির ঘর | কুরার আরাইল |
মুরগি | কুঁরি কুরা |
মোরগ | রাতা কুরা |
পাকের ঘর | বওসহানা, অঁলা |
ঝগড়া | হইজ্জে/ফজাত |
সাঁতার | আঁসুর |
ভর্তা | চান্নি |
জাম্বুরা | তরুনজা/ হন্নাল |
সমুদ্র | শাগর, দইজ্যা |
রোগ | অসুখ |
মাটি | মেডি |
পিপড়া | পিয়ারা |
আগামি কাল | আইদ্দে হালিয়া |
আজকে | আজিয়া |
চাকরি | চঁরি |
বজ্রপাত | ঠাডাল |
কনে | হইন্না |
বর | দুলা |
নবজাতক | লেদাপোয়া |
ষাড় | বিরিশগরু |
কালকে | হালিয়া |
সকাল | বেইন্না |
দুপুর | দুইজ্জা |
সন্ধ্যা | আজুইন্না/আজিন্না |
বেড়া | টিঁয়ারা, জলি |
বাড়ির পিছনে | বারিসদি |
প্রধান দরজা | মেইন দুয়ার |
ছাগল | চঅল |
মই | আঁট্টা/ দঅর |
চাটগাঁইয়া ভাষায় বিদেশি ভাষার শব্দ
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা বিভিন্ন দেশের বিদেশি ভাষায় সমৃদ্ধ। যেমন:
বিদেশি ভাষা | চাটগাঁইয়া | বাংলা অর্থ |
আরবি ভাষা | হয়রান | হরান/ অরান |
বর্মী ভাষা | ছামমান | ছোট দ্রুতগামী নৌকা |
আরকানীয় ভাষা | ছা | বাচ্চা |
পর্তুগীজ | আনানশ | আনারশ |
চিটাইঙ্গা ভাষায় বাংলা বার মাসের নাম
চট্টগ্রামীয় ভাষায় বাংলা বার মাসের নামের উচ্চারণে পার্থক্য রয়েছে। যথাঃ
বাংলা | চাটগাঁইয়া |
বৈশাখ | বইশাক |
জৈষ্ঠ | জের/ জেঢ |
আষাঢ় | আশার |
শ্রাবন | শঅন |
ভাদ্র | ভাদঅ |
আশ্বিন | আশিন |
কার্তিক | হাতি |
অগ্রহায়ণ | অঁন |
পৌষ | ফোশ |
মাঘ | মাগ |
ফাল্গুন | ফঅওন |
চৈত্র | চইত |
চট্টগ্রামের ভাষায় বাক্য
চিটাইঙ্গা ভাষায় বাক্য গঠন রীতি ও বাক্যের শব্দসমষ্টির সাথে বাংলা ভাষার ব্যাপক বৈসাদৃশ্য রয়েছে। চট্টগ্রামের ভাষায় কিছু বাক্য ও তার বাংলা প্রমিত অর্থ নিম্নরূপঃ
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় বাক্য | বাংলা অর্থ |
আমি ভালো আছি। | আঁই গম আছি। |
তোমার ছেলে স্কুলে গিয়েছে? | তোয়ার ফোয়া স্কুলত গেছ্? |
আমার সাথে কথা বলিও না তো। | আঁর লয় ন মাইত্তো চাই এক্কানা। |
আমার কলমটি খুঁজে পাচ্ছি না! | আঁর হলম ইবে তোয়াই ন পাইয়র তো! |
কোথায় যাচ্ছ তুমি? | হন্ডে যঅদ্দে? |
কিরে তুই কোথায়? | কিরে হডো তুই হডে? |
হাসতেছো কেন? | এরাদ্দোও কিল্লাই |
আমি রাগ করেছি। | আঁই গোসসা গইজ্জি। |
আমি এটা করতে পারব না। | আঁই ইয়া ফাইত্তানো। |
চাটগাঁইয়া ভাষার বাক্যের বিভিন্ন অর্থগত দিক
গঠন অনুযায়ী চট্টগ্রামী ভাষায় বাক্যের বিভিন্ন অর্থগত দিক নিচে তুলে ধরা হলোঃ
নির্দেশবাচক বাক্য:
- আরা আজিয়া আইয়ুম। (আমরা আজকে আসবো) (হা-বোধক)
- আই ন ফাইরগম। (আমি পারবো না) (না-বোধক)
প্রার্থনাবাচক বাক্য:
- আল্লাহ অনর ভালা গরক। (আল্লাহ আপনার মঙ্গল করুক)
বিষ্ময়বাচক বাক্য:
- আহারে, রাতা কুরা কেন গরি মরি গেইলগই! (আহারে, মুরগটা কিভাবে মারা গেলো)
সন্দেহবাচক বাক্য:
- তোয়ার ফোয়ারে আজিয়ে আর শেশ হতা ফনলার। (তোমার সাথে বোধই আজই আমার শেষ দেখা)
প্রশ্নাবাচক বাক্য:
- তোয়ার এ হাম হনে করের? (তোমার এই কাজ কে করেছে?)
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় সাহিত্য
বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন চর্যাপদ রচিত হওয়ার পূর্ব থেকেই চাটগাঁইয়া ভাষায় সাহিত্য ও সংগীত রচিত হতো। অষ্টম শতকে প্রতিষ্ঠিত পন্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয়ের বৌদ্ধ পন্ডিতদের প্রধান কাজ ছিল- মহাযান বা তান্ত্রিক বৌদ্ধদের ধর্মীয় বিধি, দোহাগান, চর্যাপদ রচনা করা। পন্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ প্রজ্ঞাভদ্র, চট্টগ্রামের প্রাচীন আঞ্চলিক ভাষা এবং সংস্কৃত ও পালি সহ মিশ্রিত ভাষায় ৬টি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। আদিকালের এই ভাষায় বহু সাহিত্য রচিত হলেও, তাহলে বিবর্তনে তা বিলীন হয়ে গেছে। বর্তমানে শুধুমাত্র চর্যাপদই তার নিদর্শন হয়ে রয়েছে।
১৬ শতকের দিকে চট্টগ্রামীয় ভাষায় সাহিত্য রচনার বিপ্লব সাধিত হয়। এই সময় বিভিন্ন পন্ডিতগণ তাদের সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে আঞ্চলিক ভাষাকেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন। কারণ পর্যাপ্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও প্রচার মাধ্যম না থাকায়, ভিন্ন ভাষায় সাহিত্য রচনা করলে তা খুব বেশি বিস্তৃতি লাভ করত না।
মধ্যযুগের বিখ্যাত কবিদের মধ্যে – আলাওল, মোহাম্মদ মুকিম, সৈয়দ সুলতান, আব্দুল হাকিম, দৌলত উজির বাহরাম খান প্রমুখ ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে ইতিহাসে জানা যায়। ১৮ শতকের দিকে প্রকাশিত আস্কর আলী পন্ডিতের ‘ইন্না আমীনের বারমাস’ কাব্যগ্রন্থটি একটি স্মৃতিবিজড়িত কাব্যগ্রন্থ। বিংশ এবং একবিংশ শতকে, আধুনিক যুগে এসেও বহু কবি, সাহিত্যিক, গল্পকার এ ভাষা চর্চা করছেন।
চট্টগ্রামের ভাষায় লোকসংগীত
চর্যাপদ এর পূর্ব থেকেই চিটাইঙ্গা ভাষায় লোকগীতি সমগ্র অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত ছিল। তবে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক লোকগীতির স্বর্ণযুগ ছিল চতুর্দশ শতক হতে ঊনবিংশ শতকের মধ্যবর্তী সময়ে। মাইজভান্ডারী গান, কবিয়াল গান, লোকগীত, ভাটিয়ালি গান সহ নানান ধরনের সংগীতের সাম্রাজ্য এই চট্টগ্রামী ভাষা। মধ্যযুগের পর থেকে বর্তমান সময়ে অবধি সবচেয়ে বিখ্যাত লোকগীতিকারদের মধ্যে রয়েছে- আস্কর আলী পণ্ডিত (১৮৪৬-১৯২৭),আলী রজা ওরফে কানুফকির (১৭৫৯-১৮৩৭), আবদুল জলিল সিকদার (১৮৫৭-১৯৩৪), সেকান্দর গাইন (১৮৬০-১৯৪২), খাদেম আলী (১৮৭০-১৯৪৭) প্রমুখ।
চাটগাঁইয়া ভাষা শিক্ষা
চিটাইঙ্গা ভাষার মাধুর্য দেখে বহুকাল ধরে বহু মানুষ, গীতিকার, কবি এই ভাষা প্রেমে পড়েছে। হাস্যরসাত্মক এই বুলি শিখতে চান অনেকেই। যে কোন অঞ্চলের ভাষা শিক্ষার জন্যই নিজের ধাপগুলো সম্পন্ন করতে হয়ঃ
- চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান, চাটগাঁইয়া শব্দ ও শব্দের প্রমিত অর্থ শিক্ষা।
- চট্টগ্রামের ভাষা শিক্ষা বই পড়া।
- চট্টগ্রামের ভাষা শিক্ষা মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার।
- চাটগাঁইয়া উপভাষায় কথা বলে, এমন বন্ধুদের সাথে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বা সরাসরি নিয়মিত প্রয়োজনীয় কথাবার্তা।
চিটাইঙ্গা ভাষার সাথে বাংলা প্রমিত ভাষার অনেক বেশি মিল থাকায় খুব সহজেই এই ভাষা আয়ত্ত করা যায়।
চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিভিন্ন উপজাতিদের ভাষা
সুদীর্ঘকাল থেকেই চট্টগ্রামে বহু উপজাতিদের বসবাস রয়েছে। চট্টগ্রামের চাটগাঁইয়া উপভাষা ব্যবহারের পাশাপাশি তারা নিজস্ব উপজাতীয় ভাষায় কথা বলে। চট্টগ্রাম অঞ্চলে বসবাসর সাথে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী গুলো হলো- চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, লুসাই, মুরং (ম্রো), খিয়াং, খুমি, চক, পাংখো, বম। এই জাতিগোষ্ঠী ছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রামে আরও ৪ ধরনের আদিবাসী জনগোষ্ঠী দেখা যায়। যথা: বনজোগি, খিও, কুকি ও রাখাইন। এদের মধ্যে অধিকাংশই নিজস্ব ভাষা ব্যবহার করে।
চাটগাঁইয়া ভাষার মৃত্যু ঝুঁকি
চট্টগ্রামী ভাষা একটি বহুল প্রচলিত আঞ্চলিক ভাষা। এই ভাষা থেকে বাংলা শব্দভাণ্ডার এবং বৈদেশিক নানা শব্দ বাদ দিলে, এই ভাষার শব্দসমগ্রের কিছুটা অঙ্গহানি হবে। তবে বর্তমান সময়ে অবধি এই ভাষার মৃত্যু সম্পর্কে কোনো পূর্ব ধারনা করা যায় না।
ভাষা গবেষকদের মতে, কোন ভাষার সক্রিয় ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৫০ হাজারের কম হলে, সেই ভাষার মৃত্যু সন্নিকটে। তবে চট্টগ্রামী ভাষার ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১ কোটি ৩০ লক্ষেরও বেশি। তাই এটি একটি শক্তিশালী ভাষা হয়ে রয়েছে।
তবে যথাযথ চর্চার অভাবে, সমৃদ্ধ এই ভাষা ও ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। এর কয়েকটি কারণ হলোঃ
- শিক্ষার হার বৃদ্ধি ও আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
- ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসারের ফলে বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের সংমিশ্রণ।
- অন্যান্য ভাষা মানুষদের সাথে তুলনামূলক বেশি মিলন-মিশ্রণ।
- উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা।
- ঐতিহাসিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক কিংবা ভৌগোলিক কারণে।
- বেতার, পত্রিকা, ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের প্রসার ইত্যাদি।
এ সকল কারণে অন্যান্য ভাষা উপভাষার মতোই চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষারও ব্যবহার কমে যাচ্ছে। অনেকেই মনে করেন আঞ্চলিক ভাষা ভদ্র সমাজের ভাষা নয়। ফলে তারা নিজে এবং এ যুগের শিশুর প্রমিতা বাংলা ভাষা চর্চা করে। এথনোলগ এর প্রতিবেদন অনুযায়ী ভাষভাষী জনগোষ্ঠীর হিসেবে সেরা ১০০ টি ভাষার মধ্যে চাঁটগাঁইয়া উপভাষার বর্তমান অবস্থান ৮৮ তম, যা পড়বে ৬৭ তম ছিল। তাই বলা যায়, আধুনিকতার টানাপোড়েনে এই ভাষাও একদিন বিলীন হয়ে যেতে পারে।
শেষকথা
চাটগাঁইয়া ভাষা বঙ্গদেশের অন্যতম প্রাচীন ভাষা। সাহিত্যিক ও ঐতিহাসিক দিক থেকে বাংলাদেশের অন্য কোন অঞ্চলে এই ভাষার স্বরূপ পাওয়া যায় না। তবে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ এই ভাষার প্রতি আন্তরিকতা প্রকাশ করলেও অনেকেই নেতিবাচক মনোভাবও পোষণ করে। বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষা বৈচিত্র্য টিকিয়ে রাখতে আমাদের সকলেরই উচিত নিজ নিজ আঞ্চলিক ভাষা সগৌরবে চর্চা করা।