আমরা বাঙালি, বাংলাকে ভালোবাসি। কিন্তু আমাদের ভালোবাসার এই অতি প্রিয় ভাষা সম্পর্কে রয়েছে অনেক অজানা ইতিহাস। বাংলা ভাষার উদ্ভব কোন ভাষা থেকে তা জানার কৌতূহল রয়েছে সকল বাঙালির মনে।
পৃথিবীতে ভাষার উৎপত্তি হয়েছে লক্ষ বছর পূর্বে। পৃথিবীর সর্ব প্রাচীন ভাষা কোনটি ছিল এবং বাংলা ভাষার উদ্ভব কোন ভাষা থেকে তার সঠিক তথ্য আজও এক অজানা রহস্য। তবে ভাষাবিজ্ঞানীদের ধারণা অনুযায়ী ৭,০০০ বছর পূর্ব পর্যন্ত ধারণা লাভ করা যায়।
আদিকালের বিভিন্ন অঞ্চলে মনের ভাব প্রকাশের নানান রীতি ও ভাষা ছিল। তখন থেকেই অঞ্চল ভেদে তৈরি হয় বিভিন্ন প্রাকৃত ভাষা। কাল পরিবর্তনের সাথে সাথে ভাষার বিভিন্ন শাখা প্রশাখা তৈরি হয়ে আজকের বাংলা ভাষা এসেছে। বর্তমান বাংলা ভাষার উদ্ভব কোন ভাষা থেকে, বাংলা ভাষার ইতিহাস, কাল, বিবর্তনের ধারাবাহিকতা ও বর্তমান অবস্থার তথ্য থাকছে আজকের আলোচনায়।
বাংলা ভাষা
বাংলা ভাষা (Bangla Language) দক্ষিণ এশিয়ার পূর্বপ্রান্তের ইন্দো-আর্য ভাষা পরিবারের একটি জনপ্রিয় ভাষা। সংস্কৃত, পালি ও প্রাকৃত ভাষার এবং ভাষা পরিবারের বিবর্তনের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষার উদ্ভব হয়েছে।
মাতৃভাষী মানুষের সংখ্যা বিবেচনায় ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে বাংলা ভাষা। মোট ব্যবহারকারী সংখ্যা বিবেচনায় বাংলা পৃথিবীর ষষ্ঠ বৃহত্তম ভাষা। বাংলাদেশ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসামের বরাক উপত্যকা, ত্রিপুরা, বঙ্গোপসাগরের আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে প্রধান তথ্য ভাষা ও অন্যতম ব্যবহৃত ভাষা বাংলা।
এছাড়া ভারতের বিহার, মেঘালয়, মিজোরাম, ওড়িশা, ঝাড়খন্ডতে বহু বাংলাভাষী মানুষ রয়েছে। হিন্দি ভাষার পর ভারতের সবচেয়ে বেশি প্রচলিত ভাষা বাংলা।
এছাড়াও মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, আমেরিকা সহ পৃথিবীর সর্বত্রই কম-বেশি বাংলাভাষী মানুষ রয়েছে। সারাবিশ্বে বাংলাভাষী মানুষের পরিমাণ প্রায় ৩০ কোটি। দিন দিন তা বেড়েই চলেছে। তবে বাংলা ভাষার উদ্ভব কোন ভাষা থেকে সে ইতিহাস অনেকেরই অজানা।
বাংলা ভাষার কাল
বাংলা ভাষার উৎপত্তি থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত বাংলা ভাষার কালকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-
(১) বাংলা ভাষার প্রাচীন যুগ
এ ভাষার সময়কাল ১০০০ খ্রিষ্টাব্দ -১৪০০ খ্রিষ্টাব্দ। চর্যাপদ, ভক্তিমূলক গান প্রাচীন বাংলা ভাষায় সময়ের লিখিত নিদর্শন। তখন আমি, তুমি ইত্যাদি সর্বনাম পদ এবং ইলা, ইবা, ইত্যাদি ক্রিয়া-বিভক্তির আবির্ভাব ঘটেছে।
(২) বাংলা ভাষার মধ্য যুগ
এ ভাষার সময়কাল ১৪০০ খ্রিষ্টাব্দ – ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ। চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন এই সময়কালের গুরুত্বপূর্ণ লিখিত নিদর্শন। যৌগিক ক্রিয়ার প্রচলন, ফারসি ভাষার প্রভাব, শব্দের শেষে ‘অ’ ধ্বনির বিলোপ ইত্যাদি এই সময়ের সাহিত্যে লক্ষ্য করা যায়।
কোনো কোনো ভাষাবিদ এই যুগকে আদি ও অন্ত্য – এই দুই ভাগে ভাগ করেন। যা বিশ্লেষণ করলে ধারণা পাওয়া যায় বাংলা ভাষার উদ্ভব কোন ভাষা থেকে।
(৩) আধুনিক বাংলা ভাষা
এ ভাষার সময়কাল ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত। এই সময় ক্রিয়া ও সর্বনাম পদের সংক্ষেপণ ঘটে। যেমন তাহার = তার; করিয়াছিল = করেছিল ইত্যাদি।
এভাবেই কালের পরিক্রমায় আজকের বাংলা ভাষা এসেছে।
বাংলা ভাষার উদ্ভব কোন ভাষা থেকে?
বাংলা ভাষাকে আজকের এই পর্যায়ে আসতে পাড়ি দিতে হয়েছিল কয়েক হাজার বছরের পথ। ভারত উপ-মহাদেশের প্রাচীন ভাষা গুলোকে বলা হয় প্রাচীন আর্য ভাষা। তৎকালীন ভারতবর্ষে বসবাসকারী মানুষের মনের ভাব প্রকাশ করার মূল মাধ্যম ছিলো প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষা।
প্রাচীন আর্যভাষার নির্দিষ্ট কোনো কাঠামো ছিল না। পরবর্তীতে খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ অব্দে রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় প্রয়োজনে ব্যবহার করার জন্য ভাষা বিষয়ক পন্ডিতগত এর একটি লিখিত রূপ প্রনয়ন করার চেষ্ঠা করেছিল। এই আর্য ভাষা রূপান্তরিত হয় বৈদিক ভাষায় বেদের শ্লোক লিখনেরও নজির বহন করে।
এভাবে প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষার শতাব্দীর পর শতাব্দী কাটতে থাকে। আঞ্চলিকতার প্রভাবে মূলভাষাটি চাপা পড়তে থাকে এবং ভিন্ন ভিন্ন প্রাকৃত ভাষার উৎপত্তি হয়।
বাংলা ভাষার উদ্ভব কোন ভাষা থেকে তা জানতে চলে যেতে হবে যীশু খ্রিস্টের জন্মের পূর্ব সময়ে। তখনই ভারতীয় আর্য ভাষার ৩ টি স্তর পাওয়া যায়। যথা-
(১) বৈদিক বা বৈদিক সংস্কৃত ভাষা
এটি ভারতীয় আর্য ভাষার প্রথম স্তর। খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ অব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৮০০ অব্দ পর্যন্ত এই ভাষা প্রচলিত ছিল।
(২) সংস্কৃত ভাষা
ভারতীয় আর্য ভাষার প্রথম স্তর বৈদিক সংস্কৃত থেকে পর্যায়ক্রমিকভাবে সংস্কৃত ভাষার ব্যুৎপত্তি হয়। ধারণা করা হয়, খ্রিস্টপূর্ব ৮০০ অব্দের সময়কাল থেকে এটি বিধিবদ্ধ হতে থাকে। খ্রিস্টপূর্ব ৪৫০ অব্দের দিকে তৎকালীন ব্যাকরণবিদ পাণিনির মাধ্যমে এটি চূড়ান্তভাবে বিধিবদ্ধ হয়।
(৩) প্রাকৃত ভাষা
প্রাচীন ভারতবর্ষে সাধারন মানুষের কথ্যভাষা ছিল এই প্রাকৃত ভাষা। পরবর্তীকালে ১,০০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এ সকল ভাষাগুলো লিখিত ও কথ্যরূপে প্রচলন ছিল। সংস্কৃত ভাষা সৃষ্টির পর থেকে বিভিন্ন নতুনত্বের সৃষ্টি হয়। ফলে প্রাকৃত ভাষার ব্যুৎপত্তি ঘটে। প্রাকৃত ভাষার সর্বশেষ স্তরের নাম হয় অপভ্রংশ। যার অর্থ বিকৃত হয়ে যাওয়া। ভাষার বিকৃতির মাধ্যমেই তৈরি হতো নতুন ভাষা।
এভাবেই প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষা থেকে কালক্রমে বৈদিক সংস্কৃত, সংস্কৃত, প্রাকৃত, অপভ্রংশ। তারপর অপভ্রংশ থেকে তৈরি হয়েছে ভারত উপমহাদেশের নানান আধুনিক ভাষা। যেমন- বাংলা, হিন্দি, মারাঠি, পাঞ্জাবি ইত্যাদি। বাংলা ভাষার উদ্ভব কোন ভাষা থেকে তা এসকল ভাষার ইতিহাস থেকেও জানা যায়।
বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন
বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন- চর্যাগীতিকোষ অথবা চর্যাপদ। চর্যাপদ আবিষ্কারের আগে খনার বচন, ময়না মতীর গান, গোরক্ষবিজয় এগুলো কে বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন বলা হত। তবে ১৯০৭ সালে তা ভুল প্রমাণিত হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ও সংস্কৃত বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের- ‘নেপাল রয়্যাল লাইব্রেরি’ থেকে “চর্যাচর্যবিনিশ্চয়ে” নামের একটি পুঁথি খুঁজে পান। যা লেখা ছিল বাংলা ভাষায়। তারই সম্পাদনায় ৪৭টি পদবিশিষ্ট পুথিটি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ দ্বারা প্রকাশিত হয়। এর নামকরণ করা হয়েছিল- ‘হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা বৌদ্ধগান ও দোঁহা।’
বাংলা ভাষার বুৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ
বাংলা ভাষার উদ্ভব কোন ভাষা থেকে, তার ইতিহাস খুবই ব্যাপক। ভাষা গবেষকদের মতে আজ থেকে প্রায় লক্ষ বছর পূর্বে পৃথিবীতে ভাষার উদ্ভব হয়। যা প্রাচীন আফ্রিকার মানুষগন যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতেন। ধীরে ধীরে তা সমগ্র পৃথিবী ব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন স্থানে গিয়ে ভাষার প্রকৃতি ও বদলাতে থাকে। এভাবে ভাষার অসংখ্য শাখা-প্রশাখা হয়।
যুগে যুগে সৃষ্টি হতে থাকে নতুন নতুন ভাষাগোষ্ঠী। যেমন- ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা, আফ্রো-এশীয় ভাষা, অস্ট্রো-এশীয় ভাষা, চীনা-তিব্বতি ভাষা, মালয়-পলিনেশীয় ভাষা ইত্যাদি।
বাংলাসহ নিকটস্থ অন্যান্য ভাষা বংশের মূলে ছিল ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা। হারিয়ে যাওয়া সেই প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষাও ছিল ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবংশের সদস্য। এই ভাষা বংশের ভৌগলিক অবস্থান ছিল ইউরোপের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে এবং বৃহত্তর দক্ষিণ এশিয়ায়। যদিও বর্তমানে এর অবস্থান সারা পৃথিবী জুড়েই। বর্তমানের বাংলা সহ গ্রিক, ফার্সি, হিন্দি, ইংরেজি, ল্যাটিন ও অন্যান্য ভাষার আদি রূপ ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাই ছিল।
ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষামূল খ্রিস্টপূর্ব ৫০০০ অব্দ থেকেই ধীরে ধীরে বিকৃত হয়ে যায়। তারপর এই ভাষা পরিবারের পরবর্তী রূপ অ্যান্টোলিন, ইন্দো-ইরানীয় ইত্যাদি ভাষা কালক্রমে সৃষ্টি হতে থাকে।
ধারণা করা হয়, খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ অব্দের দিকে এসকল ভাষার বিকাশ ঘটেছিল। বাংলা ভাষার উদ্ভব কোন ভাষা থেকে- এ প্রসঙ্গে অনেক ভাষা গবেষক বলেন- পূর্ব ইউরোপ এবং পশ্চিম এশিয়া অঞ্চলের সমভূমিতে ঘুরে বেড়ানো যাযাবর উপজাতি থেকে তার প্রসার।
ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাভাষীদের ভারতবর্ষে আগমন
খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ অব্দ থেকে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের ভাষাগুলো ব্যবহারকারী মানুষগণ ইউরোপ ছাড়িয়ে আটলান্টিক মহাসাগরের উপকূল ও ভূমধ্যসাগরের উত্তর উপকূলের দিকে আসতে থাকে। পারস্য ও ভারত জয় করে তারা ছড়িয়ে পড়ে সমস্ত এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে। একইসাথে অন্যদিকে সেন্টু অধিবাসীগণ পূর্ব ও পশ্চিম দিকে ছড়িয়ে পড়ে।
খ্রিস্টপূর্ব ১,০০০ অব্দের দিকে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাভাষীদের মধ্যে ইন্দো-আর্য ও ইন্দো-ইরানীয় – এ দুটি ভাষা শাখা আলাদা হয়।
ভারতবর্ষে আধুনিক বাংলা ভাষার প্রচলন
ভারত উপমহাদেশের সবচেয়ে পুরাতন ভাষা প্রাচীন প্রাকৃত। সেখান থেকে আধুনিক প্রাকৃত রূপ লাভ করে। আধুনিক প্রাকৃত থেকে গড়ে ওঠে অনেক শাখা ভাষা। যেমন- গৌড়ী প্রাকৃত, মাগধী প্রাকৃত ইত্যাদি ভাষার জন্ম হয়। এসকল প্রাকৃত ভাষা বিশ্লেষণ করে বাংলা ভাষার উদ্ভব কোন ভাষা থেকে তা জানা যায়।
এই ভাষার আরো রূপ পরিবর্তিত হয়ে গঠিত হয় অপভ্রংশ। অপভ্রংশ থেকে জন্ম হয় উড়িষ্যার ‘উড়িয়া’ ভাষা, আসামের ‘অহমিয়া’ ভাষা, ভারতের হিন্দি-উর্দু ভাষা ও তৎকালীন ভারতবর্ষে (বর্তমানে বাংলাদেশ ও ভারতের কিছু অংশ) বাংলা ভাষা।
সংস্কৃত ভাষা এবং আধুনিক বাংলা ভাষা তখন সর্বসাধারণের মুখের ভাষা ছিল না। এটি ছিল হিন্দুদের ধর্মীয় ভাষা। ব্রাহ্মণ-ভট্টাচার্য ছাড়া এ ভাষা চর্চার কারো অধিকার ছিল না। তবে সাধারণ মানুষ বাংলা ভাষার সেই গোড়াপত্তন কে ধরে রেখেছিল। পরবর্তীতে ১২০৩ সালে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজী এবং মাত্র ১৭ জন ঘোড়ু-সওয়ার নিয়ে হিন্দু-ব্রাহ্মণ্য রাজা লক্ষণ সেনকে পরাজিত করেন। ফলে বাংলা ভাষা নতুন করে মুক্তি পায়। দেশের সর্বস্তরের মানুষ তার ব্যবহার ও শিক্ষা অর্জন করতে থাকে।
পলাশীর যুদ্ধ ও ইংরেজ শাসন
বাংলা ভাষার উদ্ভব কোন ভাষা থেকে তা উপরোক্ত আলোচনায় স্পষ্ট হয়েছে। তবে পরবর্তীতে মুসলিম বাঙালি শাসকদের প্রায় সাড়ে ৫০০ বছরের শাসন ব্যবস্থাকে ভেঙে দেয়। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়ে ইংরেজদের হাতে শোচনীয় পরাজয় হয় নবাব সিরাজউদ্দৌলা ও মুসলিম শাসনের। শুরু হয় ইংরেজ শাসনামল।
এ সময় খ্রিস্টান, মিশনারি ও সংস্কৃত পন্ডিতরা বাংলা ভাষা থেকে আরবি, ফার্সি, তুর্কি শব্দসহ বাংলা ভাষার আঞ্চলিক শব্দও বিতাড়িত করার উদ্যোগ নেয়। এটি ছিল তাদের বাংলাকে বিশুদ্ধ করার অপপ্রচার। বরং তার সাথে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল সংস্কৃত ভাষার শব্দসমষ্টি।
কিন্তু ইংরেজ আমলেই ১৯১১ সালে সর্বপ্রথম নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব দেন। এবং বাংলাকে শিক্ষাব্যবস্থায় প্রয়োগ করতে বলেন। ১৯১৮ সালে শান্তিনিকেতনে অনুষ্ঠিত সর্বভারতীয় সম্মেলন।
সেখানে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে ভাষাপণ্ডিত ড. মুহম্মদ শহীদউল্লাহ বলেছিলেন- “শুধু ভারত কেন, সমগ্র এশিয়া মহাদেশেই বাংলা ভাষার স্থান হবে সর্বোচ্চ। ভাব-সম্পদ ও সাহিত্যগুণে বাংলা ভাষা এশীয় ভাষাগুলোর মধ্যে অদ্বিতীয়।”
বাংলা ভাষার উদ্ভব কোন ভাষা থেকে তা স্পষ্ট হলেও বাংলার উপর নানা রকম ঘাত প্রতিঘাত আসতে থাকে।
ভাষা আন্দোলন ও বাংলা ভাষার স্বীকৃতি
১৯৪৭ সালে ইংরেজ শাসনের অবসান ঘটে এবং ভারতবর্ষ বিভাজন হয়। ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি দেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। পাকিস্তানের দুইটি অংশ থাকে- পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান। স্বাধীন দেশ হওয়ার পরও পূর্ব বাংলার মানুষের অন্যান্য অধিকারের পাশাপাশি মাতৃভাষার অধিকার কেড়ে নিতে চায় পশ্চিম পাকিস্তান।
১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত ভাষা সংগ্রাম চলতে থাকে। তারপর ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালি জাতি ভাষার জন্য আত্মত্যাগ করে। তাদের রক্তের বিনিময়ে ১৯৫৬ সালের পূর্ব বাংলার মানুষের জন্য অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা স্বীকৃতি পায়। ১৯৭১ সালে বাংলা ভাষাপ্রেমী জাতির নতুন সার্বভৌমত্বের উন্মেষ ঘটে বাংলাদেশ নামে।
পরবর্তীতে ১৯৯৯ সালে ভাষা শহীদদের ও বাংলা ভাষার মহত্ত্ব বিবেচনায় ও যথোপযুক্ত কারণে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে।
প্রাচীন বাংলা ভাষা পরিবার
আজকের বাংলা ভাষার উদ্ভব কোন ভাষা থেকে এসেছে – তার অন্যতম উত্তর – প্রাচীন বাংলা ভাষা পরিবার থেকে। বাংলা ভাষা পরিবারের মূলে থাকা প্রাচীন ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা থেকে আজকের বাংলা ভাষায় আসতে পেরিয়ে গেছে কয়েক হাজার বছর। প্রাচীন বাংলা ভাষা পরিবারের বিবর্তনের ধারাবাহিকতা নিচে তুলে ধরা হলো:
প্রাচীন ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা
সকল ভাষা পরিবারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ভাষা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা। পৃথিবীর সর্বমোট ৪৬ শতাংশ বা প্রায় ৩৬০ কোটি মানুষের প্রথম ভাষা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাসমূহ মূলত পশ্চিম এবং দক্ষিণ ইউরেশিয়ার একটি স্থানীয় ভাষা পরিবার।
ইরানীয় মালভূমি এবং উত্তর ভারতীয় উপমহাদেশের ভাষাসমূহের সাথে অধিকাংশ ইউরোপীয় ভাষাসমূহ নিয়ে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবার গঠিত। বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম কথিত ভাষা সমূহ হলো- ইংরেজি, হিন্দুস্তানি, রুশ, পর্তুগিজ, জার্মান, স্পেনীয়, বাংলা, ফরাসি, ফার্সি, পাঞ্জাবি ইত্যাদি। এ সকল ভাষা গুলো ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত।
ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারকে অনেক শাখা বা উপ-পরিবারে ভাগ করা হয়েছিল। যেগুলোর মধ্যে ৮ টি শাখা এখনও টিকে আছে। এগুলো হলো- ইন্দো-ইরানীয়, ইতালীয়, আর্মেনীয়, আলবেনীয়, বাল্টো-স্লাভীয়, হেলেনীয়, কেল্টীয়, জার্মানীয়। এছাড়াও ইতিহাস থেকে খুঁজে পাওয়া বাকি ছয়টি শাখা বর্তমানে বিলুপ্ত।
প্রতিটি ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাই তৈরি হয়েছে একটি প্রাগৈতিহাসিক ভাষা থেকে। যা প্রত্ন-ইন্দো-ইউরোপীয় হিসাবে পুনর্নিমিত করা হয়েছে। সেই ভাষাটি নব্যপ্রস্তর যুগ থেকে নবব্রোঞ্জ যুগের মধ্যবর্তী সময়ে বলা হত বলে ধারণা করা হয়। এই ভাষার ভৌগোলিক অবস্থান নিয়ে বহু অনুমান করা হয়েছে যার মধ্যে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য অনুকল্পটি ছিলো কুর্গান অনুকল্প। কুর্গান অনুকল্প প্রায় ৩০০০ খ্রিষ্টপূর্বের ইয়াম্নায়া সংস্কৃতির সাথে সংযোগ স্থাপন করেছিল।
ব্রোঞ্জ যুগে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের ভাষাগুলোর লিখিত সাক্ষ্য পাওয়া যায়। যদিও প্রত্ন-ইন্দো-ইউরোপীয় মানুষদের কোনো পুরানো লিখিত লিপি পাওয়া যায় না। তবুও তার সাংস্কৃতিক ইতিহাসের মাধ্যমে ভাষা লিপি পাওয়া যেতে পারে।
ঐতিহাসিক ভাষা বিজ্ঞানের জন্য ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই ভাষা রয়েছে দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ লিপিবদ্ধ ইতিহাস। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাসমূহের মধ্যে সম্পর্কের বিশ্লেষণ ১৯শ শতাব্দীতে ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞানের একটি শিক্ষাগত বিষয় ছিল। এখান থেকেই বোঝা যায় বাংলা ভাষার উদ্ভব কোন ভাষা থেকে হয়েছে।
ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের শাখা সমূহ
ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের আটটি শাখা বর্তমানে টিকে আছে। এ সকল শাখা সমূহের ভৌগোলিক ও সদস্য তথ্য নিচে তুলে ধরা হলো-
(১) ইন্দো-ইরানীয় ভাষা পরিবার – শ্রীলঙ্কা, ইরান ও উত্তর ভারত উপমহাদেশে অবস্থিত ভাষা ও উপভাষা সমূহ।
(২) আলবেনীয় ভাষা পরিবার – বর্তমানে শুধু আলবেনীয় ভাষা সদস্য রয়েছে।
(৩) আর্মেনীয় ভাষা পরিবার – বর্তমানে শুধু আর্মেনীয় ভাষা সদস্য রয়েছে।
(৪) জার্মানীয় ভাষা পরিবার – উত্তর আমেরিকা, উত্তর ইউরোপ, অশেনিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকায় অবস্থিত ভাষা ও উপভাষা।
(৫) ইতালীয় ভাষা পরিবার – দক্ষিণ আমেরিকা ও দক্ষিণ ইউরোপে অবস্থিত ভাষা ও উপভাষা।
(৬) কেল্টীয় ভাষা পরিবার – পশ্চিম ইউরোপের কিছু এলাকায় অবস্থিত ভাষা ও উপভাষা।
(৭) গ্রিক-হেলেনীয় ভাষা পরিবার – বর্তমানে শুধু গ্রিক সদস্য বাকি রয়েছে।
(৮) বাল্টীয়-স্লাভীয় ভাষা পরিবার – রাশিয়া ও উত্তর-পূর্ব ইউরোপে অবস্থিত ভাষা ও উপভাষা।
উপরোক্ত তালিকা থেকেই স্পষ্ট যে, বাংলা ভাষার উদ্ভব কোন ভাষা থেকে।
এথনোলগ দ্বারা তৈরিকৃত একটি পরিসংখ্যানে হিসাব অনুযায়ী ৪৪৫টি চলমান ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ বা প্রায় ৩১৩ টি ভাষাই ইন্দো-ইরানি শাখার অন্তর্ভুক্ত।
ইন্দো-ইরানীয় ভাষা পরিবার
ইন্দো-ইরানীয় ভাষা পরিবারটি ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের একটি উপভাষা পরিবার। এটি ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের শ্রীলঙ্কা, ইরান ও উত্তর ভারত উপমহাদেশে অবস্থিত ভাষা ও উপভাষা সমূহ নিয়ে গঠিত। বর্তমানে এটি আর্য ভাষা নামেও পরিচিত।
এই ইন্দো-ইরানীয় উপভাষা পরিবারকে আবার ৪টি প্রধান শাখায় ভাগ করা হয়। এগুলো হলো-
- ইন্দো-আর্য ভাষা পরিবার
- ইরানীয় ভাষা পরিবার
- দার্দীয় ভাষা পরিবার
- নুরিস্তানীয় দার্দীয় ভাষা পরিবার
ইন্দো-আর্য ভাষা পরিবার ও আজকের বাংলা ভাষা
ইন্দো-আর্য ভাষাসমূহ হলো ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের সবচেয়ে বড় সদস্য ইন্দো-ইরানীয় ভাষাসমূহের একটি শাখা। স্থানীয়ভাবে ইন্দো-আর্য জনগোষ্ঠী ধারা এই ভাষাকে কথ্য ভাষা হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এই ইন্দো-আর্য ভাষার ধারাবাহিকতায় জানা যায় বাংলা ভাষার উদ্ভব কোন ভাষা থেকে। বর্তমানে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ও নেপালে এই ভাষা ব্যবহৃত হয়।
এছাড়াও পশ্চিম এশিয়া, ক্যারিবীয় অঞ্চল, ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকা, পলিনেশিয়া ও অস্ট্রেলিয়াতে কিছু সংখ্যক বসবাসকারী ইন্দো-আর্য ভাষায় কথা বলে।
এসআইএল ইন্টারন্যাশনাল (ISL International) – এর ২০০৫ সালের প্রাক্কলন অনুযায়ী ইন্দো-আর্য ভাষা আছে ২০৯ টি। মাতৃভাষা হিসাবে ব্যবহারকারীর সংখ্যা অনুযায়ী বৃহৎ ভাষাগুলি হলো-
- হিন্দি-উর্দু,
- বাংলা, পাঞ্জাবি,
- মারাঠি,
- গুজরাটি,
- রাজস্থানী,
- ভোজপুরি,
- ওড়িয়া,
- মৈথিলী,
- সিন্ধি,
- নেপালি,
- ছত্তিশগড়ি,
- সিংহলি,
- অসমীয়া ও
- রোমানি।
সব মিলিয়ে ইন্দো-আর্য ভাষাসমূহের মাতৃভাষীর সংখ্যা প্রায় ৯০ কোটি। বর্তমানে তা প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে।
পূর্ব ইন্দো-আর্য ভাষা থেকে বাংলা ভাষা
পূর্বের ইন্দো-আর্য ভাষাকে কয়েকটি উপ শাখায় ভাগ করা যায়। নিচে সেই ভাষাগুলো এবং বাংলা ভাষার উদ্ভব কোন ভাষা থেকে তা তুলে ধরা হলো-
উত্তরাঞ্চল আর্য
এই শ্রেণীর প্রধান ভাষা নেপালি ভাষা। এছাড়াও গাড়োয়ালি, কুমায়োনি এই শ্রেণীর অন্তর্গত।
উত্তর-পশ্চিমী আর্য
সিন্ধি, পাঞ্জাবী এবং ডোগরি ভাষা এই পরিবারের অন্তর্ভুক্ত।
দ্বৈপ্য ইন্দো আর্য
ভারত ও পাকিস্তান সীমান্তের কাশ্মীর অঞ্চলে এই ভাষা পরিবারের উপশাখার ভাষাসমূহ প্রচলিত। এদের মধ্যে কাশ্মীরি ভাষা অন্যতম বেশি ব্যবহৃত ভাষা।
পূর্বী আর্য
ভাষা পরিবারের এই উপ শাখাতেই বাংলা ভাষা অন্তর্ভুক্ত। এছাড়াও ওড়িয়া, অসমীয়া এবং ভোজপুরি এই শাখারই। বাংলা ভাষার উদ্ভব কোন ভাষা থেকে, তার ইতিহাসের অন্যতম ধারা এটি।
দক্ষিণী আর্য
সিংহলি, মারাঠি, ধিবেহী ভাষা এই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত।
কেন্দ্রীয় আর্য
ভারতীয় উপমহাদেশের হিন্দুস্থানী ভাষা সমূহ এই ভাষা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। হিন্দি ও উর্দু এবং এদের সাথে সম্পৃক্ত ভাষা সমূহও এর অন্তর্ভুক্ত।
পশ্চিমী আর্য
রাজস্থানী, মারোয়াড়ী, গুজরাটি এবং রোমানি ভাষা এই ভাষা শাখার অন্তর্ভুক্ত।
বাংলা ভাষার উপভাষাসমূহ
বাংলা ভাষার প্রধান কয়েকটি উপভাষা নিচে তুলে ধরা হলো:-
- বঙ্গালী উপভাষা
- রাঢ়ী উপভাষা
- ঝাড়খণ্ডী উপভাষা
- বরেন্দ্রী উপভাষা
- রাজবংশী উপভাষা
(১) বঙ্গালী উপভাষা
এটি বাংলাদেশের প্রধান উপভাষা। ঢাকা বিভাগ, খুলনা বিভাগ, ময়মনসিংহ বিভাগ, বৃহত্তর কুমিল্লা, বরিশাল বিভাগ, নোয়াখালীর বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে এই উপভাষায় কথা বলা হয়। বাংলা ভাষাভাষী মানুষের প্রধান ভাষার বিবেচনায় এই উপভাষাই সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়।
বঙ্গালী উপভাষার বৈশিষ্ট্য
- উ – ও (সুতা – সোতা), ও – উ (দোষ – দুষ), এ – অ্যা (কেন – ক্যান ) ধ্বনিতে পরিবর্তন ঘটে।
- গুল, গুলাইন দিয়ে এই উপভাষার বহুবচন পদ গঠিত হয়। যেমন- বাত গুলাইন খাও।
- গৌণ কর্ম কালকে ‘রে’ বিভক্তি প্রযুক্ত হয়। যেমন- আমারে বলো ক্যান।
বাংলা ভাষার উদ্ভব কোন ভাষা থেকে তা বিশ্লেষণের পর এই উপভাষাটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
(২) রাঢ়ী উপভাষা
পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব বর্ধমান, বাঁকুড়া (পূর্ব), হুগলী, হাওড়া, কলকাতা, উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা, নদীয়া ও মুর্শিদাবাদ জেলায় এই উপভাষার প্রচলন লক্ষ করা যায়। এই উপভাষাকে ভিত্তি করে প্রমিত বাংলা গঠন করা হয়েছে।
রাঢ়ী উপভাষার বৈশিষ্ট্য
- শব্দের যেকোনো স্থলে ব্যবহৃত অ কে ও রূপে উচ্চারণ লক্ষ করা যায়। যেমন- পাগল থেকে পাগোল।
- শব্দে ব্যবহৃত ন কে ল রূপে এবং ল কে ন রূপে উচ্চারণ লক্ষ করা যায়। যেমন- নয়ন থেকে লয়ন, লুচি থেকে ধুতি।
- কর্তৃ-কারকের বহুবচনে- গুলি, গুলো এবং অন্য কারকের বহুবচনে ‘দের’ বিভক্তির প্রয়োগ লক্ষ করা যায়। যেমন- গাছগুলো, প্রানীদের।
(৩) ঝাড়খণ্ডী উপভাষা
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম মেদিনীপুর, বীরভূম, পশ্চিম বর্ধমান জেলা, ঝাড়গ্রাম, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, ঝাড়খণ্ডের বোকারো, পূর্ব ও পশ্চিম সিংভূম জেলা এবং ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ জেলাতে এই উপভাষার প্রচলন রয়েছে।
ঝাড়খণ্ডী উপভাষার বৈশিষ্ট্য
- এ ভাষায় প্রায় সর্বত্রই ও-কার লুপ্ত হয়ে অ-কারে পরিণত হয়। যেমন- ভালো – ভাল, লোক – লক, মোটা – মটা, অঘোর – অঘর।
- ক প্রত্যয়ের প্রয়োগ অনেক বেশি লক্ষ্য করা যায়। যেমন- করবেক, বলবেক ইত্যাদি।
- নামধাতুর ব্যবহার অনেক বেশি লক্ষ্য করা যায়। যেমন- জাড়াচ্ছে।
(৪) বরেন্দ্রী উপভাষা
উত্তরবঙ্গের মালদহ, বাংলাদেশের দক্ষিণ দিনাজপুর এবং রাজশাহী বিভাগের লোকমুখের উপভাষা হলো বরেন্দ্রী উপভাষা।
বরেন্দ্রী উপভাষার বৈশিষ্ট্য
- অপ্রত্যাশিত স্থানে ‘র’ লোপ পায়। যেমন- আম থেকে রাম, রস থেকে অস।
- গৌণকর্মে কে ও ক বিভক্তি দেখা যায়। যেমন- হামাকে দাও।
(৫) রাজবংশী উপভাষা
বরেন্দ্রী ও বঙ্গালী উপভাষার মিশ্রণে এই উপভাষাটি গড়ে উঠেছে। পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, উত্তর দিনাজপুর, গোয়ালপাড়া, আসামের বঙাইগাঁও, কোকড়াঝাড়, বাংলাদেশের রংপুর বিভাগ এর কিছু জেলায় এই উপভাষাটি ব্যবহার করা হয়।
রাজবংশী উপভাষার বৈশিষ্ট্য
- র – ড় এবং ন – ল এর বিপর্যয় লক্ষ করা যায়। যেমন- শাড়ি – শারি, জননী – জলনী।
- শব্দের আদিতে শ্বাসাঘাতের ফলে অ থাকলে আ রূপে উচ্চারিত হয়। যেমন- অসুখ থেকে আসুখ, কথা থেকে কাথা।
- যৌগিক ক্রিয়াপদে আঞ্চলিক ভাষায় খোয়া ধাতুর ব্যবহার আছে। যেমন- রাগ করা = আগ খোয়া।
উপরোক্ত বাংলা ভাষার উপভাষা গুলোই আমাদের বর্তমান কথ্য ভাষা। এগুলোর গঠন থেকেই বুঝা যায়- বাংলা ভাষার উদ্ভব কোন ভাষা থেকে।
বাংলা ভাষার লিখিত রূপ
বাংলা ভাষার লিখিত রূপকে ২ ভাগে ভাগ করা হয়। যথা-
- সাধু ভাষা। সাধু ভাষা সংস্কৃত / তৎসম শব্দবহুল।
- চলিত ভাষা। চলিত ভাষা তদ্ভব ও দেশী-বিদেশী শব্দবহুল।
বাংলা ভাষার ব্যাকরণের উৎপত্তি
১৭৭৮ সালে ন্যাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেড নামে একজন ভাষাতত্ত্ববিদ এবং প্রাচ্যবিদ দ্বারা বাংলা ভাষার ব্যাকরণের উৎপত্তি হয়। ‘বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ এ গ্রামার’ নামে সর্বপ্রথম বাংলা ভাষার ব্যাকরণ বই গঠিত হয়। তৎকালীন গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংসের অনুরোধে ন্যাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেড বইটি রচনা করেন।
তখন থেকেই বাংলা ভাষার ব্যাকরণ বইয়ের ব্যবহার ও প্রচলন সমগ্র ছড়িয়ে পড়ে। ব্যাকরণ বিশ্লেষণের মাধ্যমেই বাংলা ভাষার উদ্ভব কোন ভাষা থেকে তা বোঝা যায়। তাছাড়া বাংলা ভাষাকে বিভিন্ন উপভাষায় ভাগ করতেও ব্যাকরণ প্রয়োজন।
বাংলা ভাষার উৎপত্তি সম্পর্কে বিভিন্ন মনীষীদের মতামত
বাংলা ভাষার উদ্ভব কোন ভাষা থেকে, তা নিয়ে বিভিন্ন মতভেদ রয়েছে। ভাষার ইতিহাস অতি প্রাচীন হওয়ায় সঠিক মত নির্বাচন করা কঠিন। বাংলা ভাষার উৎপত্তি সম্পর্কে ভাষা গবেষকরা বলেন-
ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মত
পূর্ব মাগধী অপভ্রংশ থেকে বাংলা, আসামি ও ওড়িয়া ভাষার উদ্ভব হয়েছে। তাই আসামি ও ওড়িয়ার সাথে বাংলার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্- এর মত
প্রাকৃত ভাষার অন্যতম অংশ গৌড়ী প্রাকৃত। তার মত অনুযায়ী, গৌড়ী প্রাকৃতের পরিণত অবস্থা গৌড় অপভ্রংশ থেকে বাংলা ভাষার উৎপত্তি হয়েছে।
শেষকথা
বাংলা ভাষার উদ্ভব কোন ভাষা থেকে তা নিয়ে আজও রয়েছে নানা মতভেদ। তবে কালক্রমে হাজারো বাধা বিপত্তি পেরিয়ে এই বাংলা ভাষার উৎপত্তি। বাংলা ভাষা যেমন সুমধুর, তেমনি পৃথিবীর বহু মানুষের মাতৃভাষা, মুখের ভাষা। হাজার বছরের ইতিহাস জুড়ে বাংলা ভাষা পেয়ে আসছে বহু মানুষের ভালোবাসা।