বাংলার ইতিহাসে ঘটে যাওয়া গৌরবোজ্জ্বল্য অংশ ভাষা আন্দোলন। ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতির বহু বছরব্যাপী বিস্তার প্রতিক্রিয়া। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন হলেও এর সূচনা হয় ১৯৪৭ সাল থেকেই। তবে পাকিস্তানি শোষণের বিরুদ্ধে বাংলা ভাষার পক্ষে প্রথম বক্তব্য দেন কে তা অনেকেরই অজানা।
বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবির সূচনা থেকেই বাঙালি জাতির মনে উন্মেষ ঘটেছে মহান স্বাধীনতার।
তাই বাংলা ভাষায় কথা বলা বাঙালি জাতি হিসেবে ভাষা সম্পর্কিত তথ্য জানা আমাদের অবশ্য কর্তব্য। পাকিস্তানি স্বৈরাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে বাংলা ভাষার পক্ষে প্রথম বক্তব্য দেন কে, সাধারণ পরিচয় এবং ভাষা আন্দোলনে তার বক্তব্যের প্রভাব সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য থাকছে ধারাবাহিকভাবে।
রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার প্রথম প্রস্তাবকারী কে?
রাষ্ট্রভাষা বাংলার প্রথম প্রস্তাবকারী ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাজনের পর থেকেই যখন বাংলাকে নিয়ে চারিদিকে ষড়যন্ত্র চলতে থাকে, তখন নতুন করে বাঙালি জাতির মনে প্রেরণা যোগায় পাকিস্তানি সংসদ সদস্যের বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি। পাকিস্তানি শিক্ষা ব্যবস্থা, প্রশাসনিক কার্যক্রম, সংবিধান, মুদ্রা ও ডাকটিকেট সহ বিভিন্ন স্থান থেকে বাংলা ভাষাকে নিশ্চিহ্ন করার প্রয়াস চলতে থাকে।
এসময় পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মাতৃভাষা, বাংলা ভাষার সম্মান রক্ষায় এবং পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষা-ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য সর্বপ্রথম পার্লামেন্টে প্রস্তাব রাখেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে অধিবেশনের সকল কার্যবিবরণী ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলা ভাষাতেও রাখার প্রস্তাব করেছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত।
যদিও পাকিস্তানি সরকার প্রধান লিয়াকত আলী খান সাম্প্রদায়িকতা বিবেচনা করে এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন তবুও এর ফলে বাঙালি জাতির মনে জ্বলে ওঠে স্বাধীনতা প্রাপ্তির আগুন।
পাকিস্তানি পার্লামেন্টে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বক্তব্য
২৫ শে ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানি গণপরিষদে বাংলা ভাষার পক্ষে প্রথম বক্তব্য দেন কে- তা আমাদের কাছে স্পষ্ট। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের সেই বক্তব্যের কিছু গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল নিম্নরূপ-
গণপরিষদের অধিবেশনে সদস্যদের উর্দু বা ইংরেজি বক্তৃতা দেওয়ার প্রস্তাব সংশোধনী করে বাংলাকেও এর অন্তর্ভুক্ত করা হোক। পাকিস্তানের ৬ কোটি ৯০ লাখ মানুষের মধ্যে ৪ কোটি ৯০ লাখ মানুষ পূর্ব পাকিস্তানের এবং দেশের প্রায় ৬১ ভাগ মানুষের মুখের ভাষা বাংলা। বাংলাকে সংবিধান ও শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে মুছে দিলে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রসমাজে ধ্বংসের সৃষ্টি হবে। তারা রাতারাতি অশিক্ষিত এবং চাকরির অযোগ্য হয়ে যাবে।
এছাড়াও সরকারি কাগজে, ডাকটিকেট, মুদ্রায়- বাংলা ভাষার ব্যবহার যুক্ত না করায় বিরোধিতা করেন তিনি। সর্বশেষ, তিনি বলেন- পাকিস্তানের অধিকাংশ জনসংখ্যাই বাঙালি, তাই বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের সকল কার্যাবলিতে ব্যবহার করা এবং পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত।
উপরোক্ত আলোচনায়, বাংলা ভাষার পক্ষে প্রথম বক্তব্য দেন কে এবং তার কৃতিত্ব স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যায়।
ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বাংলাকে প্রথম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে পাকিস্তানি গণপরিষদে প্রতিক্রিয়া
ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বক্তব্যের পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানি থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ভূপেন্দ্র কুমার দত্ত, শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, প্রেমহরি বর্মন এই প্রস্তাবকে সমর্থন জানান। তবে মুসলিম লীগের সকল সদস্যরা তমিজুদ্দিন খানের নেতৃত্বে একসাথে প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন।
খাজা নাজিমুদ্দিন প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বলেন- পূর্ব বাংলার অধিকাংশ মানুষের পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু হোক। এছাড়াও পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এই প্রস্তাবকে পাকিস্তানের বিভেদ সৃষ্টির অপচেষ্টা এবং উর্দুকে লক্ষ কোটি মুসলমানের ভাষা উল্লেখ করে বলেন- পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কেবলমাত্র উর্দুই হতে পারে।
ভাষা নিয়ে নানা তর্ক-বিতর্কের পরে ভোটের মাধ্যমে প্রস্তাবনার সংশোধনীটি বাতিল হয়ে যায়। বাংলা ভাষার পক্ষে প্রথম বক্তব্য দেন কে, এবং তা বাতিল করার খবর শুনে- সংসদের বাইরে প্রস্তাবনা বাতিল করাকে ঘিরে সর্বত্র বাঙালি জাতির বিরোধীতামূলক আন্দোলন শুরু হয়।
বাংলা ভাষা আন্দোলনে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের অবদান
ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের সংসদের আবেদনটি বাতিল করা হলেও ঢাকায় তখন আন্দোলনের প্রতিক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। পরের দিন ২৬ শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের উদ্যোগে ঢাকার অধিকাংশ শিক্ষার্থী ক্লাস বর্জন করে। ২৯ ফেব্রুয়ারি ঘোষিত হয় ধর্মঘট, সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে চলে প্রতিবাদ দিবস ও ধর্মঘট পালন।
এভাবে জায়গায় জায়গায় মিছিল আন্দোলন চলতে থাকে এবং তাদের থামাতে পুলিশের লাঠিচার্জ, আঘাত, গ্রেফতার, অত্যাচারও চলতে থাকে। বাঙালি জাতি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানায় বার বার। তবে তা প্রত্যাখ্যাত হতে থাকে। ১৯৫১ সালে আবারো পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দুর ঘোষণা শুনে, পুনর্জাগরণ হয় ভাষা আন্দোলনের। একইভাবে চলতে থাকে ১৯৫২ সালেও।
পরবর্তীতে একুশে ফেব্রুয়ারি হরতালের ডাক দিলে পাকিস্তানি সরকার হরতাল, আন্দোলন, সমাবেশ নিষিদ্ধ করে ১৪৪ ধারা জারি করেন এবং একুশে ফেব্রুয়ারিতে তীব্র আন্দোলনে ভাষা শহীদদের রক্তের বিনিময়ে বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষার সম্মান পায়। ১৯৫২ ভাষা আন্দোলন একটি বিস্তর প্রতিক্রিয়া হলেও, বাংলা ভাষার পক্ষে প্রথম বক্তব্য দেন কে এবং তার প্রভাব সম্পর্কে জানেন না অনেকেই।
বাংলা ভাষার পক্ষে প্রথম সৈনিক-ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের সাধারণ পরিচয়
ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত একজন বাঙালি আইনজীবী, সমাজকর্মী ও বাংলা ভাষা আন্দোলনের ভাষা সৈনিক। তিনি মূলত একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন। ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতের এবং ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাজনের পর পাকিস্তানের রাজনীতিতে তার অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য।
ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ১৮৮৬ সালের ২ নভেম্বর ত্রিপুরা (বর্তমান কুমিল্লা) জেলার রামরাইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা জগবন্ধু দত্ত। তিনি ছিলেন মুনসেফ কোর্টের সেরেস্তাদার। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ১৯০৪ সালে নবীনগর হাই স্কুল হতে প্রবেশিকা, ১৯০৮ সালে কলকাতা রিপন কলেজ হতে বি.এ এবং ১৯১০ সালে একই কলেজ হতে বি.এল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
প্রাথমিক পর্যায় থেকেই তিনি সমাজকল্যাণমূলক কাজে জড়িত থাকতেন। বিভিন্ন সময় বন্যায়, দুর্ভিক্ষে অসহায়দের পাশে দাঁড়াতেন তিনি। তিনি ১৯৩৬ সালে ত্রিপুরা (বর্তমানে কুমিল্লা) জেলা বোর্ডের সদস্য নির্বাচিত হন, ১৯৩৭ সালে তিনি বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন,১৯৪৬ সালের নির্বাচনে তিনি কংগ্রেস দলের পক্ষে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে তিনি বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার পথে অগ্রসর করতে ব্যাপক অবদান রাখেন। বাঙালি জাতি আজও- বাংলা ভাষার পক্ষে প্রথম বক্তব্য দেন কে, তাকে ভুলে যায়নি।
শেষকথা
১৯৫২ সালের বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান সৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। তিনি বাঙালি জাতির মুখের ভাষা রক্ষা করার প্রথম দাবিদার। পার্লামেন্ট বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপন হওয়ায় মনে সাহস পেয়ে সাধারণ জনগণ ও ছাত্রসমাজ এগিয়ে আসে। তাই বাংলা ভাষার পক্ষে প্রথম বক্তব্য দেন কে, এবং তার অবদানকে স্মরণ করে শ্রদ্ধা জানায় বাঙালি জাতি।