মানব সভ্যতার আদিকাল থেকেই মানুষ তার প্রয়োজনে আবিষ্কার করেছে অনেক কিছু। প্রয়োজনীয়তা মানুষকে এনে দিয়েছে আজকের আধুনিক সভ্যতায়। সভ্যতার বিকাশে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার গুলোর একটি হলো ভাষা। অর্থপূর্ণভাবে মনের ভাব প্রকাশ করার জন্যই ভাষার উৎপত্তি।
ভাষার ব্যবহার ছাড়া সভ্যতার বিকাশ মানব জীবনের একটি মুহূর্তও বর্তমানে কল্পনা করা যায় না। সাহিত্য, ইতিহাস, আধুনিকতায় অপরিহার্য এই ভাষা কাকে বলে এবং ভাষার প্রকারভেদ ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য থাকছে আজকের আলোচনায়।
ভাষা কাকে বলে বা ভাষা কি?
ভাষা (Language) হলো মানুষের যোগাযোগের প্রাথমিক মাধ্যম। মনের ভাব প্রকাশ করার জন্য মানুষ বাক যন্ত্রের সাহায্যে যেসব অর্থবোধক ধ্বনী উচ্চারণ করে, তাকে ভাষা বলে।
মানুষের মনের ভাব প্রকাশ করার সবচেয়ে সহজ মাধ্যম ভাষা। ভাষাকে নানাভাবে সংজ্ঞায়িত করা গেলেও ভাষা সুনির্দিষ্ট কোন সংজ্ঞা নেই। পৃথিবীতে প্রায় ৭ হাজারেরও বেশি ভাষা রয়েছে। প্রতিটি ভাষাভাষী মানুষের কাছেই ভাষা ভিন্ন, ভাষার গঠন ভিন্ন, ভাব প্রকাশের ধরন ভিন্ন এবং ভাষার সংজ্ঞাও ভিন্ন।
তবে ভাষা শুধুমাত্র মৌখিকভাবেই মনের ভাব প্রকাশ করে না। লিখিতভাবে, অঙ্গভঙ্গির ইশারায় ইত্যাদি উপায়ে মনের ভাব প্রকাশ করাও ভাষার আরেকটি রূপ। তাই, ভাষাকে সঠিকভাবে সংজ্ঞায়িত করে বলা যায়- মৌখিক শব্দ, লিখিত শব্দ কিংবা অঙ্গভঙ্গির ইশারায় অর্থবোধক ভাবে মনের ভাব প্রকাশ করে যোগাযোগের একটি প্রতিটি মাধ্যম হলো ভাষা।
ভাষার বিভিন্ন সংজ্ঞা
ভাষা কাকে বলে এ নিয়ে বিভিন্ন ভাষাবিজ্ঞানী এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ নানা রকম সংজ্ঞা প্রদান করে গেছেন। তাদের মতে ভাষা হলো নিম্নরূপ-
১। ড. মোহাম্মদ এনামুল হক, ভাষাকে সংজ্ঞায়িত করে বলেন-
“মানুষ বাগযন্ত্রের সাহায্যে সমাজভুক্ত জনগণের বোধগম্য যে সমস্ত ধ্বনি বা ধ্বনিসমষ্টি উচ্চারণ করে, সে সমস্ত ধ্বনি বা ধ্বনিসমষ্টিকে ভাষা বলা হয়।”
২। ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ, ভাষাকে সংজ্ঞায়িত করে বলেন-
“মনুষ্য জাতি যেসব ধ্বনি বা ধ্বনিসমষ্টির সাহায্যে মনের ভাব প্রকাশ করে তাকে ভাষা বলা হয়।”
৩। ড. সুকুমার সেন, ভাষাকে সংজ্ঞায়িত করে বলেন-
“মানুষের উচ্চারিত, অর্থবহ বহুজনবোধ্য ধ্বনিসমষ্টি-ই ভাষা।”
৪। ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, ভাষাকে সংজ্ঞায়িত করে বলেন-
“মনের ভাব-প্রকাশের জন্য, বাকযন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত ধ্বনি দ্বারা নিষ্পন্ন, কোনো বিশেষ জনসমাজে ব্যবহৃত, স্বতন্ত্রভাবে অবস্থিত, তথা বাক্যে প্রযুক্ত, শব্দসমষ্টি কে-ই ভাষা বলা হয়।”
৫। ভাষাবিজ্ঞানী স্টার্টেভান্ট, ভাষাকে সংজ্ঞায়িত করে বলেন-
“মানুষ যখন কিছু ধ্বনি বা শব্দের সাহায্যে পারস্পরিক মনের কথাটি বুঝতে পারে, তখন তা ভাষা হয়।
৬। ড. মোহাম্মদ আব্দুল হাই, ভাষাকে সংজ্ঞায়িত করে বলেন-
“এক এক সমাজের সকল মানুষের উচ্চারিত অর্থবোধক ধ্বনিসমষ্টি-ই ভাষা।”
এছাড়াও ভাষা কাকে বলে, ভাষার প্রকারভেদ, ভাষার বৈশিষ্ট্য নিয়ে অনেক মতামত ব্যক্ত করে গেছেন ভাষাবিজ্ঞানীরা।
ভাষার মূল উপাদান গুলো কি কি
ভাষার মূল উপাদান হচ্ছে ধ্বনি। এটিকে ভাষার ক্ষুদ্রতম এককও বলা হয়। ভাষা কাকে বলে এই প্রসঙ্গে- সাধারণত কন্ঠ নিঃসৃত ও উচ্চারিত অর্থবোধক ধ্বনির সমষ্টিই ভাষা। ধ্বনির লিখিত উপাদানই বর্ণ।
তবে, যে কোন ভাষার মৌলিক উপাদান মূলত চারটি। যথা-
- ধ্বনি (Sound)
- শব্দ (Word)
- বাক্য (Sentence)
- অর্থ (Meaning)
একইভাবে, একটি ভাষার ব্যাকরণের মৌলিক অংশও চারটি। যথা- ধ্বনিতত্ত্ব, শব্দতত্ত্ব, বাক্যতত্ত্ব ও অর্থতত্ত্ব।
ভাষার বৈশিষ্ট্য সমূহ
ভাষা কাকে বলে – তা বিবেচনা করলে নিম্নোক্ত ভাষার বৈশিষ্ট্যগুলো পরিলক্ষিত হয়-
- ভাষা এক প্রকার ধ্বনি বা ধ্বনির সমষ্টি।
- বাক যন্ত্রের সাহায্যে কণ্ঠ নিঃসৃত ধ্বনির সাহায্যে সৃষ্ট শব্দই ভাষা।
- যেকোনো ধ্বনি বা শব্দসমষ্টি ভাষা নয়। শুধুমাত্র অর্থপূর্ণ ধ্বনি বা শব্দই ভাষা।
- পৃথিবীর প্রতিটি ভাষাতেই ব্যাকরণের ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ।
- প্রতিটি ভাষারই নিজস্ব ক্ষেত্রে স্বাধীন ও সার্বভৌম অবস্থান থাকে।
- ধ্বনি, শব্দ, পদ, বাক্য, ইত্যাদির বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ গঠনকে রক্ষা করে ভাষা।
- এটি বক্তব্যের অন্তর্গত রূপকে প্রকাশ করে।
- ভাষা মনের ভাব আদান-প্রদানের মাধ্যম।
- ভাষা একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভাব প্রকাশে ব্যবহৃত হয়।
- ভাষা হল মানুষের স্বেচ্ছাকৃত আচরণ ও অভ্যাসের সমষ্টি।
- ভাষা মানুষের স্বভাব, সভ্যতা এবং সংস্কৃতিকে প্রকাশ করে।
- দেশ, জাতি, কাল ও পরিবেশ ভেদে ভাষা পরিবর্তনশীল।
- সকল ভাষার শব্দ ও বাক্য গঠনরীতি প্রায় অনুরূপ।
বিশ্বের প্রতিটি ভাষাতেই এসকল বৈশিষ্ট্য গুলো পরিলক্ষিত হয়।
ভাষার প্রকারভেদ
ভাষার সাধারণত দুটি রূপ রয়েছে। যথা-
- মৌখিক ভাষা বা কথ্য ভাষা
- লিখিত বা লেখ্য ভাষা
মৌখিক ভাষা বা কথ্য ভাষা কাকে বলে
আমরা যে ভাষায় বাক যন্ত্রের সাহায্যে কথা বলি, একে অপরের সাথে ভাব বিনিময় করে আবেগ অনুভূতি প্রকাশ করি, তাকে মৌখিক ভাষা বা কথ্য ভাষা বলা হয়। এক কথায়, যে ভাষা মুখে বলে প্রকাশ করা হয় তাকে মৌখিক ভাষা বলে।
মৌখিক ভাষা বা কথ্য ভাষার প্রকারভেদ- দুই প্রকার। যথা-
- আঞ্চলিক ভাষা
- সর্বজনীন ভাষা
আঞ্চলিক ভাষা কাকে বলে
পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের ভাষা ভিন্ন। ভৌগলিক ব্যবধান, সামাজিক অবস্থা, যোগাযোগ ব্যবস্থা, ধর্ম ইত্যাদি প্রভাবে একটি অঞ্চলের ভাষা থেকে অন্য অঞ্চলের ভাষা ভিন্ন হয়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ভেদে ভাষার এই বৈচিত্র্যকেই আঞ্চলিক ভাষা বলে। আঞ্চলিক ভাষা একটি মূলভাষাকে বিভিন্ন রূপে প্রকাশ করে তাই একে উপভাষাও বলা হয়।
যেমন- নোয়াখালী জেলার গ্রাম্য অঞ্চলে ‘টাকা’ কে বলা হয়- ‘টেকা’। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ‘ছেলে’ শব্দটিকে বলা হয়- ছেমড়া, পোলা, বেটা, পুত। একইভাবে ‘মেয়ে’ শব্দটিকে বলা হয়- মাইয়া, ছেড়ি, ছেমড়ি, পুরি। এভাবে অঞ্চল ভেদে একই অর্থবোধক শব্দ ভিন্ন ভাষায় প্রকাশ পায়।
আঞ্চলিক ভাষার বৈশিষ্ট্য
- আঞ্চলিক ভাষা বিশেষ কোন অঞ্চলের মানুষের ব্যবহৃত ভাষা।
- আঞ্চলিক ভাষা স্ব-স্ব এলাকার মানুষের উচ্চারণ ও বাক্য গঠন রীতির উপর নির্ভরশীল।
- আঞ্চলিক ভাষা একটি মৌখিক ভাষা। তবে, লিখিত রূপেও এর প্রয়োগ করা যায়।
- এটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের মানুষের লোক-সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সাথে সম্পৃক্ত।
- আঞ্চলিক ভাষায় কিছু শব্দ সাধুরীতি বা চলিত রীতিতে গৃহীত হয়।
- আঞ্চলিক ভাষা পরিবর্তনশীল।
- আঞ্চলিক ভাষার রূপ অকৃত্রিম।
- আঞ্চলিক ভাষা গণসাহিত্য তৈরির উপযোগী।
- কোন অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষা ব্যাকরণের কঠিন নিয়ম মেনে চলে না।
সর্বজনীন ভাষা কাকে বলে
একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের সকল মানুষের মৌলিক ভাষাই সর্বজনীন ভাষা। যেমন- বাংলাদেশের সকল মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে, তাই এটি বাংলাদেশের সর্বজনীন ভাষা।
একইভাবে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষের জন্য ঐ দেশের প্রধান রাষ্ট্রীয় ভাষা একটি সর্বজনীন ভাষা। অন্যদিকে, ইংরেজি একটি আন্তর্জাতিক ভাষা হওয়ায় এটি সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য সর্বজনীন ভাষা।
লিখিত বা লেখ্য ভাষা কাকে বলে
আমরা যে ভাষায় বিভিন্ন বর্ণমালা/প্রতীক/সাংকেতিক চিহ্ন ব্যবহার করে বই-পুস্তক, চিঠি-পত্র বা অন্যান্য তথ্য ও ভাব লিখে প্রকাশ করি, তাকে লিখিত বা লেখ্য ভাষা বলা হয়। এক কথায়, যে ভাষা লিখে প্রকাশ করা হয় তাকে লিখিত ভাষা বলে।
লিখিত বা লেখ্য ভাষার প্রকারভেদ- দুই প্রকার। যথা-
- সাধু ভাষা
- চলিত ভাষা
সাধু ভাষা কাকে বলে
যে ভাষা রীতিতে ক্রিয়াপদ ও সর্বনাম পদ পূর্ণরূপে ব্যবহৃত হয় এবং শব্দগুলো সন্ধিবদ্ধ ও সমাসবদ্ধ হয় তাকে সাধু ভাষা বলে। সাধু ভাষা বাংলা গদ্যের প্রাচীন মার্জিত ভাষা। ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সাধু ভাষাকে সমগ্র বঙ্গদেশের সম্পত্তি বলে আখ্যায়িত করেন এবং এই ভাষাকে সংজ্ঞায়িত করে বলেন- “সাধারণ গদ্য-সাহিত্যে ব্যবহৃত বাংলা ভাষাকে সাধু ভাষা বলে।”
যেমন-
- জন্মিলে মরিতে হবে,
- যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখ তাই
- যৌবনে যখন পৃথিবী সুন্দর ছিল, যখন প্রতি পুষ্পে পুষ্পে সুগন্ধ পাইতাম, প্রতি নক্ষত্রে চিত্রা-রোহিণীর শোভা দেখিতাম, প্রতি মনুষ্য-মুখে সরলতা দেখিতাম, প্রতি পত্রমর্মরে মধুর শব্দ শুনিতাম।
সাধু ভাষার বৈশিষ্ট্য
- সাধু ভাষায় অনুসর্গ, অসমাপিকা ক্রিয়াপদ, সমাপিকা ক্রিয়াপদ এবং সর্বনাম পদ পূর্ণাঙ্গ রূপে ব্যবহৃত হয়। যেমন- হইতে, করিলে ইত্যাদি।
- সাধু ভাষায় সমাসবদ্ধ ও সন্ধি যুক্ত দীর্ঘ শব্দের প্রাধান্য বেশি।
- সাধু ভাষায় সংস্কৃত বা তৎসম শব্দের প্রয়োগ বেশি। যেমন- গগন, গৃহ, তৃণ, হস্ত, বৃক্ষ ইত্যাদি।
- এই ভাষা মার্জিত, ভদ্র এবং সর্বজনবোধ্য।
- সাধু ভাষা অনেকাংশেই কৃত্রিম ভাষারীতি অনুসরণ করে।
- সাধু ভাষা রীতিতে সংস্কৃত সংখবাচক শব্দের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। যেমন- দশম, একাদশ, দ্বাদশ, উনবিংশ ইত্যাদি।
- সাধু ভাষার পদবিন্যাস সুনির্দিষ্ট এবং সুনিয়ন্ত্রিত।
- সাধু ভাষা বক্তৃতা ও নাটকের সংলাপের অনুপযোগী।
- এই ভাষা আভিজাত্য ও গাম্ভীর্যের প্রতীক।
- এই ভাষায় সংস্কৃত অব্যয়ের ব্যবহার হয়।
- সাধু ভাষারীতিতে ঋণাত্মক শব্দ, স্বরসঙ্গতি, অভিশ্রুতি, আপনিহিতি, সমীভবন ইত্যাদির ব্যবহার নেই।
- সাধু ভাষায় বহুভাষন পরিলক্ষিত হয়।
চলিত ভাষা কাকে বলে
যে ভাষায় ক্রিয়াপদ ও সর্বনাম পদ সংক্ষিপ্ত আকারে বিদ্যমান থাকে এবং ছোট সন্ধি ও সমাস যুক্ত হয়, তাকে চলিত ভাষা বলে। বাংলা ভাষাকে কৃত্রিমতা থেকে মুক্ত করে সকলের জন্য সহজ সাবলীল করে তোলাই উদ্দেশ্যেই সৃষ্টি হয় চলিত ভাষার। বর্তমানে যে ভাষা রীতি সর্বত্র ব্যবহৃত হয় তা-ই চলিত ভাষা।
যেমন-
- তারা মাঠে খেলছে।
- সেই স্কুলে যাচ্ছে।
- ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ছিল বাংলা ভাষা আন্দোলন।
চলিত ভাষার বৈশিষ্ট্য
- চলিত ভাষায় অনুসর্গ, সর্বনাম পদ, সমাপিকা ক্রিয়া ও অসমাপিকা ক্রিয়া সংক্ষিপ্ত রূপে ব্যবহৃত হয়।
- চলিত ভাষায় দেশি-বিদেশি বা তদ্ভব শব্দ বেশি ব্যবহৃত হয়। যেমন- ঘর, বাড়ি, হাত ইত্যাদি।
- এ ভাষার পদবিন্যাস ও বাক্যের গঠন বিশেষ প্রকৃতির এবং সুনিয়ন্ত্রিত ও সুনির্দিষ্ট নয়।
- চলিত ভাষায় সন্ধি ও সমাসবদ্ধ শব্দ ভেঙে লেখা হয়।
- চলিত ভাষা তুলনামূলক হালকা ও সহজে বোধগম্য।
- চলিত ভাষায় সংস্কৃত সংখ্যাবাচক শব্দের ব্যবহার নেই।
- এ ভাষা রীতিতে বিভক্তির সংক্ষিপ্ত ব্যবহৃত হয়। যেমন- হতে, দিয়ে ইত্যাদি।
- চলিত ভাষা ব্যাকরণের কঠিন নিয়ম মেনে চলেনা, তাই এটি পরিবর্তনশীল।
- বক্তৃতা, নাট্য সংলাপ ও আলাপচারিতায় চলিত ভাষা উপযুক্ত।
- চলিত ভাষায় স্বরসঙ্গঁতি, অভিশ্রুতি, অপনিহিতি, ও সমীভবনের প্রয়োগ বেশি।
- এ ভাষায় ঋণাত্মক ও দ্বৈত শব্দের প্রাধান্য বেশি।
- চলিত ভাষা শিক্ষিত ভদ্র সমাজের মৌখিক ও লেখ্য ভাষা।
ভাষার কাজ কি
ভাষা কাকে বলে- তার সংজ্ঞা থেকেই বোঝা যায়, ভাষা প্রধান কাজ হলো মনের ভাব প্রকাশ করা। এছাড়াও ভাষার বেশ কয়েকটি প্রধান কাজ রয়েছে। যেমন-
- ভাষার মানুষের আনন্দ-অনুভূতি, আবেগ, রাগ, অভিমান ইত্যাদি প্রকাশ করে।
- ভাষার মাধ্যমে সংস্কৃতির সম্প্রসারণ ও সমন্বয় ঘটে।
- ভাষা বার্তা বহন ও প্রেরনের মাধ্যমে নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য পূরণ করে।
- ভাষার মাধ্যমে একজনের সাথে অন্যজনের যোগাযোগ স্থাপন হয়।
- একটি জাতির সভ্যতা ও সংস্কৃতি তুলে ধরতে ভাষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
- জ্ঞান অর্জন, তথ্য রক্ষণাবেক্ষণ, সাহিত্যচর্চা ইত্যাদি প্রয়োজনে ভাষা অপরিহার্য।
- ভাষা মানুষের দেশ, জাতি, ধর্ম ইত্যাদি পরিচয় বহন করে।
- ভাষা মানুষের আদেশ-নিষেধ, গুরুত্বপূর্ণ কার্য সম্পাদনে বিশেষ প্রভাব ফেলে।
- ভাষার মাধ্যমে একটি পরিবার ও একটি সমাজের মধ্যে সুসম্পর্কে গড়ে উঠে।
- মানুষের জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে ভাষার ব্যবহার বেঁচে থাকাকে সহজ করে দেয়।
বিশ্বের নানান ভাষা
বর্তমান পৃথিবীতে প্রায় ৭,১০০ টিরও বেশি ভাষা রয়েছে। তার মধ্যে মাত্র ২৩ টি ভাষায় কথা বলে পৃথিবীর অর্ধেকেরও বেশি জনসংখ্যা। বর্তমান বিশ্বে- বাংলা, হিন্দি-উর্দু, ইংরেজি, আরবি, চীনা, স্পেনীয়, রুশ, পর্তুগিজ, জাপানি, ফরাসি ও জার্মান এই ১১ টি বিশ্বের সর্বাধিক প্রচলিত ভাষা। বিভিন্ন দেশের ভাষার নাম ভিন্ন তবে ভাষা কাকে বলে- তার ব্যাখ্যা অনুরূপ।
বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ভাষাভাষীর দেশ পাপুয়া নিউ গিনি ও ইন্দোনেশিয়া। পাপুয়া নিউগিনিতে প্রায় ৮৫০ টি এবং ইন্দোনেশিয়াতে প্রায় ৬৭০ টি ভাষায় কথা বলেন স্থানীয়রা।
পৃথিবীর সর্বত্রই ভাষার ব্যবহার পরিবর্তিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। কিছু কিছু অধিবাসীদের আঞ্চলিক ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে বংশধরদের অভাবে। অনেক ভাষা মিশে যাচ্ছে সমজাতীয় ভাষার সাথে। সমীক্ষা অনুযায়ী, প্রতি ১৫ দিনে একটি করে ভাষা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে পৃথিবী থেকে।
বাংলা ভাষা কাকে বলে
বাঙালি জাতি বা বাংলাদেশিরা মনের ভাব প্রকাশ করার জন্য যে ভাষায় কথা বলে তাকে বাংলা ভাষা বলে। বাংলা ভাষায় পৃথিবীর চতুর্থ সবচেয়ে বেশি কথিত ভাষা। বর্তমান পৃথিবীতে প্রায় ৩০ কোটিরও অধিক মানুষের মাতৃভাষা বাংলা। বাংলাকে ঘিরে রয়েছে একটি বিস্তর ইতিহাস। ইন্দো-ইউরোপীয় বা আর্য ভাষা থেকে শুরু করে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন সহ নানা বাধা পেরিয়ে এসেছে আজকের বাংলা ভাষা। তাই মাতৃভাষা না হয়েও অনেক মানুষের প্রিয় ভাষা বাংলা ভাষা।
বাংলা ভাষার ইতিহাস
বাংলা ভাষার উৎপত্তি হয়েছে ইন্দো-ইউরোপীয় বা আর্য ভাষা থেকে। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষারীতিতে বিশ্বের প্রায় ৪৬ ভাগ মানুষ কথা বলে। ধারণা করা হয়, আনুমানিক ২৫০০ খ্রিস্টপূর্বে রাশিয়ার উরাল পর্বতের পাদদেশ থেকে আর্য ভাষাভাষী মানুষ পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।
এই আর্য ভাষা থেকে ভাষার দশটি শাখা তৈরি হয়। তন্মধ্যে ইন্দো-ইরানীয় ভাষা একটি। এর একটি অংশ হয় ভারতীয় আর্য ভাষা। এর থেকে মাগধী অপভ্রংশ, তারপর পূর্বী শাখা। এই শাখা থেকে বঙ্গ অসমীয়া এবং ওড়িয়া ভাষার সৃষ্টি হয়। অবশেষে, বঙ্গ অসমীয়া ভাষা থেকে তৈরি হয় আজকের বাংলা ভাষা।
বাংলা ভাষার উন্নয়ন ও বিকাশ
বাংলা ভাষার উৎপত্তি থেকে বর্তমান অবস্থা পর্যন্ত তিনটি পর্বে ভাগ করা হয়েছে। যথা-
- প্রাচীন বাংলা ভাষা (৯৫০-১৩৫০ খ্রিষ্টাব্দ)
- মধ্য বাংলা ভাষা (১৩৫০-১৭৬০ খ্রিষ্টাব্দ)
- আধুনিক বাংলা ভাষা (১৭৬০ খ্রিস্টাব্দ থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত)
ভাষা কাকে বলে এবং ভাষার প্রকারভেদ নিয়ে বিস্তৃত ইতিহাস রয়েছে। ধারাবাহিকভাবে, কালক্রমে বাংলা ভাষার রূপ পরিবর্তিত হতে হতে বর্তমানে এই ভাষার বর্ণমালা ও শব্দে পরিণত হয়েছে। উন্নাসিক মুসলমানদের কাছে বাংলা ভাষার নাম ছিল ‘হিন্দুয়ানি ভাষা’।
বাংলা ভাষাকে কালের বিবর্তনে কেউ বলেছেন ‘লোকভাষা’, কেউ বলেছেন ‘প্রাকৃত’ কারও মতে আবার ‘লৌকিক ভাষা’। অধিকাংশ লেখক এই ভাষাকে বলেছেন ‘দেশি ভাষা’ এবং কিছু সংখ্যক লেখক ‘বঙ্গভাষা’, ‘বাঙ্গালা’ বলে উল্লেখ করেছেন বাংলা ভাষাকে। ভারতবর্ষে বাংলার বাইরে এর নাম ছিল ‘গৌড়িয়া’। বর্তমানে আধুনিক যুগে এই ভাষাকে আমরা বলি বাংলা ভাষা।
শেষকথা
ভাষা জীবন ধারণের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান গুলোর একটি। দৈনন্দিন জীবনে ভাষা ছাড়া একটা পদক্ষেপও চিন্তা করতে পারিনা আমরা। হোক সেটা মৌখিক, লিখিত কিংবা অঙ্গভঙ্গির ইশারায়। ভাষা কাকে বলে, ভাষার প্রকারভেদ ও বৈশিষ্ট্য ইত্যাদির একটি বৃহৎ ব্যাখ্যা রয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন জাতির ভাষা ভিন্ন হলেও ভাষার মৌলিক কাজ একইভাবে মনের ভাব প্রকাশ করা।