ভাষার দুটি রুপ। একটি হলো লৈখিক বা লেখ্য ভাষা, যা লেখায় ব্যবহার করা যায়। আর অন্যটি হলো মৌখিক বা কথ্য ভাষা, যে ভাষায় লিখিত কোনো রুপ নেই। বাংলা ভাষায়ও এ দুটি রুপ বিদ্যমান। তবে প্রাচীন কাল থেকে বাংলা ভাষাভাষী মানুষেরা মনের ভাব প্রকাশের জন্যে ভাষার কথ্য রুপটি ব্যবহার করতো। কিন্তু সেসময় বাংলা ভাষা গবেষকরা, সাহিত্য রচনায় একটি মার্জিত এবং উৎকর্ষপূর্ণ ভাষার প্রয়োজনবোধ করেন। সাহিত্য রচনায় ব্যবহৃত এসব ভাষার সাথে মানুষের মুখের ভাষার বিস্তর পার্থক্য লক্ষ্য করা যেতো। নানান অঞ্চলের মানুষ নানান ভাবে কথা বললেও সাহিত্যে এরকম হয়না। যেমন, বাংলাদেশের নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, সিলেট, এসব অঞ্চলের মানুষের ভাষা প্রকৃত বাংলা থেকে পরিবর্তিত হয়ে অন্য একটি রুপ নিয়েছে। এগুলোও বাংলা ভাষা, তবে লেখার ক্ষেত্রে এই ভাষাগুলো ব্যবহার হয়না। যদি কোনো লেখক, পরিবেশ বোঝানোর ক্ষেত্রে এই ভাষাগুলো ব্যবহার করেন, তাহলে তিনি তা করতে পারেন। কিন্তু এই ভাষাগুলো সাহিত্যে সর্বজন স্বীকৃত নয়।
বাংলা ভাষায় প্রাচীন এবং মধ্যযুগে সাহিত্য রচিত হতো কবিতায়। বাংলা ভাষায় মানুষ গদ্য রীতিতে তাদের মনের ভাব প্রকাশ করলেও দীর্ঘদিন সাহিত্য প্রকাশের মাধ্যম ছিলো কবিতা। তবে বাংলা গদ্যের প্রচলন শুরু হওয়ার প্রথমদিকে বাংলা গদ্যের বিশেষ একটি রুপ সাহিত্যে ব্যবহৃত হয়েছিল। বাংলা ভাষার এই রুপটির নাম হলো সাধু ভাষা। সেসময়ও বাংলা ভাষাভাষী মানুষেরা মনের ভাব প্রকাশে কথ্য রীতির ব্যবহার করতো। কিন্তু সাহিত্যের উৎকর্ষতা বৃদ্ধির জন্যে ভাষার কৃত্রিম একটি রূপ ব্যবহার করে সাহিত্যে প্রয়োগ করা হয়। সে সময় প্রখ্যাত লেখকগণের ধারণা ছিলো, সাহিত্যের ভাষা হবে দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত ভাষা থেকে পৃথক, এবং মার্জিত।
যার কারণে বাংলা ভাষায় দুটি ভাষা রীতির প্রচলন শুরু হয়। একটি সাহিত্যের জন্যে এবং অন্যটি মুখের ভাষার জন্যে। এ দুটি ভাষা রীতির মধ্যে পার্থক্য থাকার কারণে, সাহিত্যের ভাষাকে কৃত্রিম বলে বিবেচনা করা হয়। সাহিত্যে ব্যবহৃত এই ভাষাকে বাস্তবভিত্তিক করে তুলতে, এবং কৃত্রিমতা দূর করে মুখের ভাষার কাছাকাছি আনতেই এক সময় সাহিত্যে কথ্যরীতির ব্যবহার শুরু হয়। বর্তমানে বেশিরভাগ সাহিত্যেই কথ্য রীতি ব্যবহার করা হয়। সাহিত্যে বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় এমন সময়টা হয়তো খুব বেশি দূরে নয়, যখন সাধু রীতিকে প্রাচীন একটি রুপ হিসেবে গণ্য করা হবে। এবং চলিত রীতির আধিপত্য সর্বত্র বিরাজ করবে।
বাংলা ভাষায় গদ্য রীতিতে ভাষার রুপ দুইটিঃ
১. সাধু ভাষা, এবং
২. চলিত ভাষা।
সাধু ভাষা
সাধারণত যে ভাষায় ক্রিয়াপদ এবং সর্বনাম পদ সম্পূর্ণরুপে ব্যবহৃত হয়, তাকে সাধু ভাষা বলে। সাধু ভাষা হলো বাংলা লেখ্য ভাষার প্রাচীন একটি রুপ। এর নবীন এবং প্রচলিত ভাষার অন্য একটি রুপ হলো চলিত ভাষা। সাধু ভাষা অনেকটা ধ্রুপদী বৈশিষ্ট্যের, এবং চলিত ভাষা থেকেও কিছুটা কম প্রাঞ্জল। “সাধু” শব্দের অর্থ মার্জিত বা শিষ্ট। আর এই শব্দটি প্রথম ব্যবহার করা হয় রাজা রামমোহন রায়ের “বেদান্ত গ্রন্থ” রচনাটিতে। সাধু ভাষা ব্যবহারের সময় চলিত ভাষার মিশ্রণকে দূষণীয় মনে করা হয়। কারণ এক ভাষারীতির সাথে অন্য ভাষার মিশ্রণকে বলা হয় “গুরু চন্ডালী দোষ”। তবে তা কবিতার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। আর তাই, বাংলা ভাষায় ক্রিয়াপদ এবং সর্বনাম পদের পূর্ণ এবং ব্যকরণসিদ্ধ উপাদান ব্যবহার করে ইংরেজি সাহিত্যের পদবিন্যাস অনুসরণ করে যে সর্বজন গৃহীত গদ্য রীতি বাংলা সাহিত্যে প্রচলিত হয়, তাকে সাধু ভাষা বলে। যেমন, তাহারা বই পড়িতেছে, বরফ এখনো গলিল না।
চলিত ভাষা
সাধারণত যে ভাষায় ক্রিয়াপদ এবং সর্বনাম পদ সংক্ষিপ্ত আকারে ব্যবহৃত হয়, তাকে চলিত ভাষা বলে। তদ্ভব শব্দ, ক্রিয়াপদ ও সর্বনাম পদের সংক্ষিপ্ত রুপ, এবং লেখকের মনোভাব অনুযায়ী যে পদবিন্যাস অনুসরণ করে স্বচ্ছন্দ, চটুল এবং সবার গ্রহণযোগ্য, মানুষের মুখের ভাষার কাছাকাছি যে ভাষার প্রচলন হয়েছে, তাই চলিত ভাষা। এই চলিত ভাষা বাংলাদেশের উত্তরাংশ, কলকাতা এবং ভাগীরথী নদীর তীরবর্তী অঞ্চলের শিক্ষিত মানুষের মুখের ভাষার আদলে গড়ে উঠেছে। চলিত গদ্যের স্বার্থক ব্যবহারের জন্যে প্রমথ চৌধুরী এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কে চলিত ভাষার স্বার্থক রুপকার বলা হয়। যেমন, তারা বই পড়ছে, বরফ এখনো গললো না।
সাধু এবং চলিত ভাষার মধ্যে পার্থক্য
বাংলা ভাষার সাধু এবং চলিত রুপের মধ্যে যেমন প্রকৃতিগত সাদৃশ্য রয়েছে, তেমনি পার্থক্যও রয়েছে।
সাধু ভাষা | চলিত ভাষা |
১. উনিশ শতকের শুরুর দিকে সংস্কৃত ভাষা অনুযায়ী লেখকগণ সাহিত্যের যে গদ্য ভাষা তৈরি করে, তা হলো সাধু ভাষা। | ১. বিশ শতকের শুরুর দিকে প্রমথ চৌধুরীর আহবানে বাংলাদেশের উত্তরাংশ এবং কলকাতা ও ভাগীরথী নদীর দুই তীরবর্তী শিক্ষিত মানুষের ভাষার আদলে যে ভাষা তৈরি হয়, তা হলো চলিত ভাষা। |
২. সাধারণত যে ভাষায় সাহিত্য রচিত হয়, যা মার্জিত, এবং যা সর্বজন গৃহীত, তাই সাধু ভাষা। | ২. শিক্ষিত সমাজে প্রচলিত ভাষাই সাধারণত চলিত ভাষা। |
৩. সাধু ভাষা ব্যকরণের সুনির্দিষ্ট নিয়ম অনুসরণ করে চলে। | ৩. চলিত ভাষার সুনির্দিষ্ট এবং সুনির্ধারিত কোনো ব্যকরণ এখনো তৈরি হয়নি। |
৪. সাধু ভাষায় সর্বনাম পদ সম্পূর্ণরুপে ব্যবহৃত হয়। যেমন, তাহার, ইহার, কাহাকে, ইহাকে ইত্যাদি। | ৪. চলিত ভাষার সর্বনাম পদ হয় সংক্ষিপ্ত। যেমন, তার, এর, কাকে, একে ইত্যাদি। |
৫. সাধু ভাষায় ক্রিয়াপদগুলো পূর্ণরুপে ব্যবহৃত হয়৷ যেমন, খাইতে, খাইতেছিলাম, করিতেছিল ইত্যাদি। | ৫. চলিত ভাষায় ক্রিয়াপদগুলো সংক্ষিপ্তরুপে ব্যবহৃত হয়। যেমন, খেতে, খাচ্ছিলাম, করছিলো ইত্যাদি। |
৬. বাংলা ভাষায় সাধু ভাষা প্রাচীন। | ৬. বাংলা ভাষায় চলিত ভাষা অপেক্ষাকৃত নবীন এবং আধুনিক। |
৭. সাধু ভাষা গুরুগম্ভীর ও আভিজাত্যপূর্ণ। | ৭. চলিত ভাষা সহজ ও সাবলীল। এ ভাষায় মানুষ মনের ভাব প্রকাশ করে। |
৮. সাধু ভাষায় তৎসম শব্দের প্রয়োগ বেশি। যেমন, অভ্যন্তর, চন্দ্র, অঙ্গ, বৃন্ত, কাষ্ঠ, দর্পণ, চর্ম, সৌষ্ঠব ইত্যাদি। তবে এ ভাষায় তদ্ভব ও দেশি বিদেশি শব্দের ব্যবহারও নিষিদ্ধ নয়। | ৮. চলিত ভাষায় তদ্ভব ও দেশি বিদেশি শব্দের প্রাধান্য বেশি। যেমন, শরীর, গঠন, চাঁদ, বোঁটা, ভিতর, কাঠ, চামড়া, আয়না ইত্যাদি। তবে এ ভাষায় তৎসম শব্দের ব্যবহারও নিষিদ্ধ নয়। |
৯. সাধু ভাষায় সন্ধি সমাসের ব্যবহার এবং প্রাধান্য অনেক লক্ষ্য করা যায়। যেমন, রাজপুত্রহস্তে, কাষ্ঠাহরণে, রাজাজ্ঞা ইত্যাদি। | ৯. চলিত ভাষায় সন্ধি সমাসের বর্জন বা তা ভেঙে ভেঙে ছোট করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এ ভাষায় সন্ধি সমাসকে তদ্ভব রুপ দেওয়ার প্রবণতাও লক্ষ্য করা যায়। যেমন, কাঠ, আনতে, রাজপুত্তুরের হাতে, রাজার হুকুম ইত্যাদি। |
১০. সাধু ভাষায় সচরাচর কর্মবাচ্যের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। যেমন, পথিকের কোন দস্যুলক্ষণ দৃষ্ট হইলোনা। | ১০. চলিত ভাষায় সংস্কৃত ভাষা অনুসরণ করে এমন কর্মবাচ্যের ব্যবহার একেবারেই নেই। উলটো ভাববাচ্যের ব্যবহারই বেশি। যেমন, পথিকের কোন দস্যু লক্ষণ দেখা গেলো না। |
১১. সাধু ভাষা সাধারণত অপরিবর্তনীয়। | ১১. চলিত ভাষা সাধারণত পরিবর্তনশীল। |
১২. সাধু ভাষা যেকোনো দৈনন্দিন কথোপকথনে, যেকোনো নাটকের সংলাপ কিংবা বক্তৃতায় ব্যবহারের অনুপযোগী। | ১২. চলিত ভাষা যেকোনো দৈনন্দিন কথোপকথন, যেকোনো নাটকের সংলাপ বা বক্তৃতায় ব্যবহারের উপযোগী। |
১৩. সাধু ভাষায় স্বরসঙ্গতি, অপিনিহিতি, সমীভবন, অভিশ্রুতি ইত্যাদির ব্যবহার নেই। যেমন বিলাতি, ধূলা, জালিয়া, করিল, লিখা, গল্প, উনান ইত্যাদি। | ১৩. চলিয় ভাষায় স্বরসঙ্গতি, অপিনিহিতি, সমীভবন, অভিশ্রুতি ইত্যাদির ব্যবহার অনেক। যেমন, লেখা, বিলিতি, উনুন, কইর্যা, জেলে, গপ্প। |
১৪. সাধু ভাষায় বাক্যের পদবিন্যাস সুনির্দিষ্ট এবং সুনির্ধারিত। মানে বাক্যের প্রথমে উদ্দেশ্য এবং পরে বিধেয় থাকে। সাধু ভাষায় ক্রিয়াপদ সাধারণত বাক্যের শেষে ব্যবহৃত হয়। যেমন, সম্মুখে এক ক্ষুদ্র প্রান্তর দেখিতে পাইলাম। | ১৪. চলিত ভাষায় বাক্যের পদবিন্যাস অনেক সময় পরিবর্তিত হয়। এবং বাক্যে ক্রিয়াপদ স্বাধীনভাবে ব্যবহার করা যায়। যেমন, দেখতে পেলাম সামনে এক ছোট্ট মাঠ। |
১৫. সাধু ভাষায় দুরূহ তৎসম শব্দের ব্যবহারও লক্ষ্য করা যায়। তবে সাধু ভাষায় এক সময়ে ব্যবহার হয়েছে, এমন অনেক শব্দই বর্তমানে অপ্রচলিত। যেমন, অপার্যমানে, নিষণ্ণ, অত্রত্য ইত্যাদি। | ১৫. চলিত ভাষায় দুরূহ তৎসম শব্দের ব্যবহার নেই বললেই চলে। যেমন, এখানের, অক্ষমতার কারণে না পারলে বা না পারায়, অবস্থিত, ইত্যাদি। |
সাধু ভাষা এবং চলিত ভাষার একটি উদাহরণ
সাধু ভাষা
“প্রাঞ্জলতা রচনার বড় গুণ। তুমি যাহা লিখিবে লোকে পড়িবামাত্র যেন তাহা বুঝিতে পারে। যাহা লিখিলে, লোকে যদি তাহা না বুঝিতে পারে, তবে লেখা বৃথা, তবে অনেক লেখক এই কথা মনে রাখেন না। কতকগুলি নিয়ম আর কতকগুলি কৌশল মনে রাখিলে রচনা খুব প্রাঞ্জল করা যায়। দুই রকমই বলিয়া দিতেছি।”
-বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (রচনার শিল্পগুণ)
চলিত ভাষা
“প্রাঞ্জলতা রচনার বড় গুণ। তুমি যা লিখবে লোকে পড়ামাত্র যেন তা বুঝতে পারে। যা লিখলে, লোকে যদি তা না বুঝতে পারে, তবে লেখা বৃথা, কিন্তু অনেক লেখক এই কথা মনে রাখে না। কতগুলো নিয়ম আর কতগুলো কৌশল মনে রাখলে রচনা প্রাঞ্জল করা যায়। দু রকমই বলে দিচ্ছি।”