সাধু ভাষা বাংলা ভাষা বৈচিত্রের অন্যতম প্রধান অংশ। সাধু ভাষা কাকে বলে, সাধু ভাষার ইতিহাস, উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ, রূপ, ব্যবহার, সাধু ও চলিত ভাষার পার্থক্য সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য থাকছে এই আলোচনায়।
উদ্ভব হওয়ার পর থেকে সাধু ভাষা পরিচিত হয়ে উঠতে দীর্ঘদিন লেগেছিল। রাজা রামমোহন রায়ের মাধ্যমে এই ভাষার নামকরণ হয়েছে। তবে ভাষা নিয়ে সর্বপ্রথম কাজ করেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তাই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর – কে বলা হয় বাংলা সাধু ভাষার জনক।
সাধু ভাষা কাকে বলে এবং বাংলা সাধু ভাষার সেই উৎপত্তি থেকে আজকের ধারাবাহিকতা পর্যন্ত বিস্তারিত তথ্য জানুন এখানে।
সাধু ভাষা কাকে বলে?
যে ভাষারীতিতে ক্রিয়াপদ ও সর্বনাম পদ পূর্ণরূপে ব্যবহৃত হয় এবং শব্দগুলো সমাসবদ্ধ ও সন্ধিযুক্ত থাকে, তাকে সাধু ভাষা বলে।
সাধু ভাষা সংস্কৃত ভাষাকে অনুসরণ করে। এটি বাংলার প্রাচীন গদ্যের মার্জিত ভাষা। ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সাধু ভাষাকে সমগ্র বঙ্গদেশের সম্পত্তি বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি এই ভাষাকে সংজ্ঞায়িত করে বলেন- “সাধারণ গদ্য-সাহিত্যে ব্যবহৃতত বাঙ্গালা ভাষাকেই সাধু ভাষা বলে।”
যেমন- তিনি হাঁটিতে হাঁটিতে ভাবিতে লাগিলেন, যুবসমাজে কিভাবে কল্যান বহিয়া আনা যাইবে।
সাধু ভাষার বৈশিষ্ট্য
- সাধু ভাষায় অনুসর্গ ও সর্বনাম পদ পূর্ণাঙ্গ রূপে ব্যবহৃত হয়।
- সমাপিকা ক্রিয়া ও অসমাপিকা ক্রিয়া পূর্ণাঙ্গ রূপে ব্যবহৃত হয়।
- সমাসবদ্ধ ও সন্ধি যুক্ত দীর্ঘ শব্দ বেশি দেখা যায়।
- অনেক বেশি কৃত্রিম ভাষারীতি অনুসরণ করে।
- এই ভাষায় সংস্কৃত অব্যয়ের ব্যবহার রয়েছে।
- পদবিন্যাস গুলো সুনির্দিষ্ট এবং সুনিয়ন্ত্রিত।
- তৎসম বা সংস্কৃত শব্দের প্রয়োগ রয়েছে। যেমন- হস্ত, বৃক্ষ ইত্যাদি।
- এই ভাষা ভদ্র, সর্বজনবোধ্য ও মার্জিত।
- সাধু ভাষা রীতিতে সংস্কৃত সংখ্যাবাচক শব্দের ব্যবহার রয়েছে। যেমন- নবম, একাদশ, দ্বাদশ, উনবিংশ ইত্যাদি।
- বক্তৃতা, নাট্য-সংলাপ ও মুখের ভাষার জন্য উপযুক্ত ভাষা নয়।
- আভিজাত্য, প্রাচীনত্ব ও গাম্ভীর্যের প্রতীক।
- এই ভাষারীতিতে ঋণাত্মক শব্দ, স্বরসঙ্গতি, সমীভবন ইত্যাদির ব্যবহার নেই।
- এই ভাষায় বহুভাষন লক্ষ করা যায়।
বাংলার সাধু ভাষা
বাংলা সাধু ভাষা কাকে বলে বা সাধু ভাষা কি, তা ১৮০০ সালের দিকে প্রকাশিত হয়। প্রথম নাম প্রকাশিত হয় রাজা রামমোহন রায়ের মাধ্যমে। তিনি তার ‘বেদান্ত গ্রন্থ’ রচনাটিতে ‘সাধু ভাষা’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। ‘সাধু’ শব্দের অর্থ হলো মার্জিত, শিষ্ট, ভদ্র ইত্যাদি। এই ভাষায় বাংলা ভাষার মার্জিত রূপ প্রকাশ পায়। বাংলা লেখ্য গদ্যের অপেক্ষাকৃত প্রাচীন রূপ হলো সাধু ভাষা। এই ভাষা অনেকটা ধ্রুপদী বৈশিষ্ট্যের অধিকারী।
এই ভাষার নবীন ও প্রচলিত রূপটি হলো চলিত ভাষা। সাধু ভাষা চলিত ভাষা থেকে কম প্রাঞ্জল। বাংলা ভাষায় সাধু ও চলিত/ প্রমিত ভাষার মিশ্রণকে দূষনীয় বলা হয়। লেখার সময় বাংলা ভাষার সাধু ও চলিত রীতি একই লেখায় ব্যবহার করাকে গুরুচণ্ডালী দোষ বলা হয়। তবে বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে সাধু ও চলিত ভাষা সংমিশ্রনে ব্যবহার করতে দেখা যায় অনেক কবিকেই।
আধুনিক বাংলা ভাষায় সাধু ভাষা প্রায় বিলুপ্ত। গণমানুষের জীবনে এই ভাষার ব্যবহার একদমই দেখা যায় না। সেই সাথে সাহিত্যেও এর ব্যবহার কমেছে অনেকাংশে।
সাধু ভাষার ইতিহাস
সাধু ভাষা বাংলা ভাষার এক অনন্য অংশ। এর ইতিহাসের সূচনা হয়েছে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে। তবে এর প্রাচীনতা ছিল ব্যাপক। প্রাচীন বাংলা ভাষার সূচনা হয়েছিল ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠী থেকে।
সংস্কৃত, পালি ও প্রাকৃত ভাষার মধ্য দিয়ে পর্যায়ক্রমিকভাবে বাংলা ভাষার দিকে ধাবিত হতে থাকে। প্রাচীন ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা থেকে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠী। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠী থেকে ইন্দো-আর্য ভাষা পরিবার। তারপর ইন্দো-আর্য ভাষার অনেকগুলো শাখার মধ্যে পূর্বী আর্য ভাষা শাখা। সেখান থেকে আধুনিক বাংলা ভাষার উৎপত্তি।
বাংলা ভাষার আধুনিক যুগ শুরুর পর তার ক্রমবিকাশের প্রথম অবদান রেখেছিল ১২০৩ সালে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজীর মাধ্যমে সেন বংশের বিজয়। তখন থেকে বাংলায় মুসলিম শাসন পরিচালিত হয় ও বাংলা ভাষার প্রসার হয়। পরবর্তীতে পলাশীর যুদ্ধের সময় ১৭৫৭ সালে ইংরেজদের হাতে শোচনীয় পরাজয় হয় নবাব সিরাজউদ্দৌলা ও মুসলিম শাসনের। যার ফলে বাংলায় ইংরেজ শাসন শুরু হয়।
কিন্তু বাংলার প্রসার তখনও থেমে রয়নি। ইংরেজ শাসনামলেই শুরু হয়েছিল বাংলা সাহিত্যের স্বর্ণযুগ। তখনও প্রকাশিত হয়নি সাধু ভাষা কি/ সাধু ভাষা কাকে বলে।
সাধু ভাষার উৎপত্তি
বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগের সূচনা হয় ১৮০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে। তখন থেকে বাংলা ভাষার সাহিত্যের মধ্যে সাধু ভাষার উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু সাধু ভাষার কোন পরিচয় তখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
আধুনিক বাংলা ভাষার ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী, ‘সাধুভাষা’ শব্দটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেছিলেন রাজা রামমোহন রায়। তিনি তার ‘বেদান্ত গ্রন্থ’ নামে একটি রচনায় ১৮১৫ সালে প্রথম ‘সাধুভাষা’ শব্দটি ব্যবহার করেন। ধীরে ধীরে তা বাংলা সাহিত্যে ব্যাপক প্রসারলাভ করতে থাকে।
১৮০০ খ্রিস্টাব্দের পূর্বেই তৎকালীন পর্তুগিজ ধর্মযাজক মানোএল দ্যা আসসুম্পসাঁউ এর রচিত কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদে লেখায় সাধু ভাষার অল্প কিছু প্রয়োগ দেখা গিয়েছিল। তবে সেখানে পরিপূর্ণ সাধু ভাষার রূপ পরিলক্ষিত হয়নি।
উনিশ শতকের প্রথমার্ধে তৎকালীন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজকে কেন্দ্র করে বাংলা গদ্য চর্চা শুরু করা হয়েছিল। মূলত মহাবিদ্যালয়ের পাঠ্য পুস্তক প্রণয়ন করতে উইলিয়াম কেরি ও তার অন্যান্য সহকর্মীরা গদ্যের প্রয়োজন উপলব্ধি করেন। তখন থেকেই তাদের প্রচেষ্টায় বাংলা গদ্যের আবির্ভাব হয়।
বাংলা গদ্যে সাধু ভাষার ব্যবহার ছিল ব্যাপক। বিদেশি সাহিত্যিকদের দ্বারাই এর চর্চা প্রসারিত হয়েছিল। তবে এই ভাষার আদর্শ রূপ লাভ করতে থাকে তৎকালীন বাংলার দেশীয় পন্ডিতদের মাধ্যমেই। বাংলার বহু সাহিত্যিক ও পণ্ডিতরা বাংলা গদ্য ও সাধু ভাষায় অনেক সাহিত্য রচনা করেছেন। ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়সহ আরো যোগ বিখ্যাত দেশীয় পণ্ডিতরা তাদের লেখায় এই ভাষার আদর্শ রূপ তুলে ধরেন।
সাধু ভাষার ক্রমবিকাশ
১৮১৫ সালে রাজা রামমোহন রায়ের ‘বেদান্ত গ্রন্থ’ নামে প্রকাশিত রচনায় ‘সাধুভাষা’ শব্দটি ব্যবহার হওয়ার পর থেকেই এর ক্রমবিকাশ হতে থাকে। কিন্তু সাধু ভাষা কাকে বলে এবং রাজা রামমোহন রায় কোন ধরনের ভাষারীতিকে বিশেষভাবে ইঙ্গিত করেছেন তা স্পষ্ট নয়।
ধারণা করা হয়, যারা সংস্কৃত ভাষায় কথা বলতো তাদের ভাষার ব্যুৎপত্তি বোঝাতে একে সাধু ভাষা বলা হয়েছিল। ১৮০০ সালের দিকে অনেকেরই ভাষা ছিলো সংস্কৃতমূলক ও সংস্কৃত অনুসারী। তাদের ভাষাকেই ইঙ্গিত করেছিলেন রাজা রামমোহন রায়।
সাধু ভাষার ব্যুৎপত্তি হলেও তার সঠিক গঠন ও রূপ তখনো বিকশিত হয়নি। তবে পরবর্তীকালে বহুদিন পর বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সাধু ভাষার গঠন নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করেন। তিনি তার ‘বাঙ্গালা ভাষা’ নামে একটি প্রবন্ধে সাধু ভাষা নিয়ে মন্তব্য উল্লেখ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন,
“কিছুকাল পূর্বে দুইটি পৃথক ভাষা বাংলায় প্রচলিত ছিলো। একটির নাম সাধু ভাষা, অপরটির নাম অপর ভাষা। অপ্রচলিত সংস্কৃত শব্দগুলো বাংলা ক্রিয়াপদের আদিম রূপের সঙ্গে সাধু ভাষায় যুক্ত হতো।”
তিনি সাধু ভাষার উদ্দেশ্যে আরও বলেন- “সংস্কৃতপ্রিয়তা এবং সংস্কৃত অনুকারিতার কারণে বাংলা সাহিত্য দুর্বল, শ্রীহীন ও নিরস হয়ে উঠেছে। অকারণে ঘরের পরিবর্তে গৃহ, পাতার পরিবর্তে পত্র, মাথার পরিবর্তে মস্তক ব্যবহার করা উচিত নয়।”
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের এই সকল মন্তব্য থেকে বোঝা যায়- তৎকালীন সাধু ভাষার রূপ গড়ে উঠেছিল তৎসম শব্দের বেশি প্রয়োগে। তাতে তদ্ভব ও অর্ধ তৎসম শব্দের প্রয়োগ কম ছিল। তবে পরবর্তীতে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রমুখ ব্যক্তিত্বের রচনার মধ্য দিয়ে সাধু ভাষার আধুনিক বিকাশ লাভ হয়। সাধু ভাষা ক্রমে সংস্কৃত ভাষারীতির অপ্রয়োজনীয় প্রয়োগ থেকে বেরিয়ে আসতে থাকে।
পরবর্তীকালে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যে ভাষাটি অনুসরণ করে সাহিত্যকর্ম রচনা করেছেন তাকে আমরা প্রকৃত সাধু ভাষা বলে থাকি। ধীরে ধীরে সাধু ভাষা বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কথ্য ভাষার কাছাকাছি রূপ লাভ করে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাধু গদ্যরীতি পর্যবেক্ষণ করলে সাধু ভাষাকে তৎকালীন বাঙ্গালীদের মুখের ভাষায় বলা চলে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৪ সালের পূর্বে তার লেখনীতে চলতি ভাষা ব্যবহার করেননি। তবে তার গদ্যরীতি ধীরে ধীরে চলতি ভাষার কাছাকাছি চলে এসেছিল।
ধীরে ধীরে সাধু ভাষার ক্রিয়া ও সর্ব নামের আদিম রূপ বিকৃত হতে থাকে। এবং তা চলতি বাংলার নিকটবর্তী প্রকাশ ভঙ্গি অনুসরণ করতে থাকে।
উনিশ শতকে সাহিত্যের বৈপ্লবিক যুগে বাংলা সাহিত্যের গদ্য অবলম্বন করেছিল সংস্কৃত ভাষার আরেক রূপ সাধু ভাষায়। তবে আজ সেই বহুল প্রচলিত ভাষা প্রায় বিলুপ্ত। সাধু ভাষারীতি কখনোই বাঙালির মুখের ভাষা ছিল না। ছিলনা আনুষ্ঠানিকভাবে কথাবার্তার ভাষা। এর ব্যবহার সীমাবদ্ধ ছিল সাহিত্য রচনার মধ্যেই, যা আজ শুধু পুস্তকের মধ্যেই ব্যবহারযোগ্য। সেই আলোকেই আমরা জানতে পারি – সাধু ভাষা কাকে বলে।
সাধু ভাষার রূপ
১৮১৫ সালের পর থেকে ১৯ শতক জুড়ে বাংলা গদ্যের প্রসারকাল ছিল। তখন সাধু ভাষার দুটি রূপ প্রকাশিত হয়েছিল। যথা-
- বিদ্যাসাগরী সাধু ভাষা।
- বঙ্কিমী সাধু ভাষা।
বিদ্যাসাগরী সাধু ভাষা মূলত প্রসার হয়েছিল ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও অক্ষয় কুমার দত্তের গদ্যের সাহায্যে। তাদের এই ভাষারীতি ছিল সংস্কৃত শব্দবহুল। সাধারণত তাদের লেখায় অসংস্কৃত শব্দ পরিহারের চেষ্টা করা হতো।
বঙ্কিমী সাধু ভাষায় প্রধান প্রসারকারী ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তার ভাষা সংস্কৃত শব্দবহুল হলেও কিছুটা সহজ ছিল। একইসাথে তার লেখনীতে অসংস্কৃত শব্দেরও ব্যবহার ছিল। বঙ্কিমচন্দ্রের সেই লেখার রীতি অনুসরণ করেছেন অনেকেই।
দ্বীনেশচন্দ্র সেন, মীর মোশারফ হোসেন, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, ইসমাইল হোসেন সিরাজী প্রমুখ সাহিত্যিকগণ গ্রন্থাবলী রচনা করেছেন। এছাড়া আরো অনেকেই সমসাময়িক নানা সাহিত্যে কমবেশি বঙ্কিমী সাধু ভাষা ব্যবহার করেছে।
সাধু ভাষার ব্যবহার
বিশিষ্ট সাহিত্যিকগণের ধারাবাহিকতায় একসময় সাধু ভাষা বাংলার আদর্শ লেখ্য ভাষা হয়ে ওঠেছিল। সমগ্র বাংলায় তখন গদ্য লেখনিতে এবং চিঠি পত্রে সাধু ভাষা বহুল ব্যবহৃত হতো। সরকারি কাজকর্মে ব্যবহারের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত ভাষা হয়ে উঠেছিল সাধু ভাষা। বিশেষ করে আইন সংশ্লিষ্ট কাগজপত্রে এর প্রয়োগ ছিল সবচেয়ে বেশি।
কিন্তু বিংশ শতাব্দীর শেষ দিক থেকে বর্তমান সময়ে সাধু ভাষার ব্যবহার প্রায় বিলীন। শুধুমাত্র মৌখিক ব্যবহারের জন্যই নয়, বরং প্রাতিষ্ঠানিক লেখনীতে, চিঠি, গল্প এমনকি নানারকম সাহিত্যেও এর ব্যবহার নেই।
সাধু ভাষা ও চলতি ভাষার পার্থক্য
উনিশ শতকে সাধু ভাষার যেমন প্রচলন ছিল, বর্তমানে তেমনি চলিত ভাষার প্রচলন। সাধু ভাষা ও চলিত ভাষার মধ্যে ভাষারূপ, গঠন, প্রয়োগ, ব্যবহার, অনুসর্গ, পদবিন্যাস, ক্রিয়াপদের নানা পার্থক্য লক্ষণীয়।
সাধু ভাষা কাকে বলে এবং এর বৈশিষ্ট্য বিবেচনা করলেই চলিত ভাষায় সাথে পার্থক্য পাওয়া যায়। নিচে সাধু ও চলিত ভাষার পার্থক্য তুলে ধরা হলো:
সাধু ভাষা | চলিত ভাষা |
যে ভাষারীতিতে ক্রিয়াপদ ও সর্বনাম পদ পূর্ণরূপে ব্যবহৃত হয় এবং শব্দগুলো সমাসবদ্ধ ও সন্ধিযুক্ত থাকে, তাকে সাধু ভাষা বলে। | যে ভাষারীতিতে ক্রিয়াপদ ও সর্বনাম পদ সংক্ষিপ্ত রূপে ব্যবহৃত হয় এবং ছোট সন্ধি ও সমাসযুক্ত থাকে, তাকে চলিত ভাষা বলে। |
অনুসর্গ ও সর্বনাম পদ পূর্ণাঙ্গ রূপে ব্যবহৃত হয়। | অনুসর্গ ও সর্বনাম পদ সংক্ষিপ্ত রূপে ব্যবহৃত হয়। |
সমাপিকা ক্রিয়া ও অসমাপিকা ক্রিয়া পূর্ণাঙ্গ রূপে ব্যবহৃত হয়। | সমাপিকা ও অসমাপিকা ক্রিয়া ছোট আকারে ব্যবহৃত হয়। |
সমাসবদ্ধ ও সন্ধি যুক্ত দীর্ঘ শব্দ বেশি দেখা যায়। | সন্ধি ও সমাসবদ্ধ শব্দ ভেঙে ছোট আকারে লেখা হয়। |
অনেক বেশি কৃত্রিম ভাষারীতি অনুসরণ করে। | চলিত ভাষা অকৃত্রিম কথ্য ভাষা। |
এই ভাষায় সংস্কৃত অব্যয়ের ব্যবহার রয়েছে। | সংস্কৃত অব্যয়ের ব্যবহার নেই। |
এই ভাষা ভদ্র, সর্বজনবোধ্য ও মার্জিত প্রাচীন ভাষারীতির। | চলিত ভাষা আধুনিক শিক্ষিত ভদ্র সমাজের মৌখিক ও লেখ্য ভাষা। |
তৎসম বা সংস্কৃত শব্দের প্রয়োগ রয়েছে। | তদ্ভব শব্দ বেশি ব্যবহৃত হয়। |
সাধু ভাষা ব্যাকরণের কঠিন নিয়ম মেনে চলে। | চলিত ভাষা ব্যাকরণের কঠিন নিয়ম মেনে চলেনা। |
এই ভাষারীতিতে ঋণাত্মক শব্দ, স্বরসঙ্গতি, সমীভবন ইত্যাদির ব্যবহার নেই। | ঋণাত্মক ও দ্বৈত শব্দ, স্বরসঙ্গঁতি, অভিশ্রুতি, অপনিহিতি, ও সমীভবনের প্রয়োগ বেশি। |
সাধু ভাষা সুনির্দিষ্ট ও অপরিবর্তনশীল। | চলিত ভাষা পরিবর্তনশীল। |
পদবিন্যাস গুলো সুনির্দিষ্ট এবং সুনিয়ন্ত্রিত। | এই ভাষার পদবিন্যাস ও বাক্যের গঠন সুনিয়ন্ত্রিত ও সুনির্দিষ্ট নয়। |
সংস্কৃত সংখ্যাবাচক শব্দের ব্যবহার রয়েছে। | সংস্কৃত সংখ্যাবাচক শব্দের ব্যবহার নেই। |
বক্তৃতা ও নাটকের সংলাপের জন্য উপযুক্ত ভাষা নয়। | বক্তৃতা, নাট্য সংলাপ ও আলাপচারিতায় চলিত ভাষা উপযুক্ত। |
সাধু ভাষা আভিজাত্য, প্রাচীনত্ব ও গাম্ভীর্যের প্রতীক। | চলিত ভাষা তুলনামূলক হালকা, আধুনিক ও সহজে বোধগম্য। |
সাধু ভাষা কাকে বলে, এর রূপ ও শব্দ ভেদে চলিত ভাষার সাথে বিভিন্ন পার্থক্য রয়েছে। নিচে তা তুলে ধরা হলো:
অব্যয় পদে পার্থক্য
অব্যয় পদে তৎকালীন সাধু ভাষা ও বর্তমান চলিত ভাষার শব্দরূপে পার্থক্য:
সাধুভাষা – চলিত ভাষা
হইতে – হতে
অপেক্ষা – চেয়ে
পূর্বেই – আগেই
সহিত – সাথে
ক্রিয়াপদে পার্থক্য
ক্রিয়াপদে তৎকালীন সাধু চলিত ভাষার শব্দরূপে পার্থক্য:
সাধুভাষা – চলিত ভাষা
পার হইয়া – পেরিয়ে
করিবার – করার
করিতেছি – করতেছি/ করছি
গড়িয়াছেন – গড়েছেন
করিয়াছিলেন- করেছিলেন
ফিরিয়া -ফিরে
ছড়াইলে – ছড়ালে
বলিয়াছেন – বলেছেন
দেখিয়া – দেখে
করিয়া – করে
লাগিয়াছিল – লেগেছিল
বিশেষ্য পদে পার্থক্য
বিশেষ্য পদে তৎকালীন সাধু চলিত ভাষার শব্দরূপে পার্থক্য:
সাধুভাষা – চলিত ভাষা
গৃহ- ঘর
শুষ্ক – শুকনো
সুতা – সুতো
জুতা – জুতো
মস্তক- মাথা
তুলা -তুলো
বিশেষণ পদে পার্থক্য
বিশেষন পদে সাধু চলিত ভাষার শব্দরূপে পার্থক্য:
সাধুভাষা – চলিত ভাষা
কিয়ৎক্ষণ – কিছুক্ষণ
বন্য – বুনো
অতিশয় – অত্যন্ত
সর্বনাম পদে পার্থক্য
সর্বনাম পদে তৎকালীন সাধু চলিত ভাষার শব্দরূপে পার্থক্য:
সাধুভাষা – চলিত ভাষা
উহা -ওটা
উহারা – ওরা
তিনি- সে
তাহাকে – তাকে
তাহার – তার
তাহাদের – তাদের
তাহাকে – তাকে
উহাকে – ওকে
সাধু ভাষার বিলোপসাধন
বর্তমানে শুধুমাত্র পুরাতন কিছু কাগজসমূহে সংস্কার না করায় সাধু ভাষা টিকে রয়েছে। বিশেষ করে জমির দলিলে এখনো সাধু ভাষা ব্যবহৃত হয়। সাধু ভাষা কাকে বলে তা আজ শুধু পুস্তকের প্রয়োজনেই জানতে হয়।
উপনিবেশিক যুগ থেকেই বিখ্যাত লেখকগণ সহজবোধ্যতার জন্য চলিত ভাষাকেই আদর্শ মনে করতেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথমে সাধু ভাষায় লিখতে সাতসন্দ বোধ করলেও পরবর্তীতে চলিত ভাষাকেই বেছে নেন। সাধারণ ভাষা একসময় টিকে থাকতে পারবে না এ নিয়ে বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ পূর্বেই ইঙ্গিত করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার এক গ্রন্থে বলেছিলেন-
এক-যে ছিল রাজা, তার দুই ছিল রানী,সুয়োরানী আর দুয়োরানী। তেমনি বাংলাবাক্যাধীপেরও আছে দুই রানী-একটাকে আদর করে নাম দেওয়া হয়েছে সাধু ভাষা;আর একটাকে কথ্য ভাষা,কেউ বলে চলতি ভাষা।
আভিজাত্যের জন্য সাধু ভাষাকে সুয়োরানির সঙ্গে তুলনা করেছেন। সুয়োরানী ঠাঁই দেয় দুয়োরানীকে গোয়ালঘরে। কিন্তু গল্পের পরিণামের দিকে দেখি সুয়োরানী যায় নির্বাসনে , টিকে থাকে একলা দুয়োরানী রানীর পদে।
এখানে তিনি বুঝাতে চেয়েছেন সাধু ভাষা একসময় বিলুপ্ত হবে এবং চলিত ভাষাই লোকমুখে টিকে থাকবে। বর্তমানে সর্বত্রই চলিত ভাষার প্রয়োগ। সাধু ভাষার ব্যবহার নেই বললেই চলে।
সাধু ভাষার উদাহরণ
সাধু ভাষার বৈশিষ্ট্য সমৃদ্ধ উদাহরণ নিচে তুলে ধরা হলো:
অদ্য যাহা হৃদয় মাঝে ভালো লাগিতেছে না, দশ বৎসর পরে তাহার স্মৃতি ভাল লাগিবে। অদ্য যাহা মনঃসুখ বলিয়া স্বীকার করিতেছি না, কল্য আর তাহা জুটিবে না। যুবার যাহা অগ্রাহ্য ভাবিয়া থাকে, বৃদ্ধের নিকট তাহা দুষ্প্রাপ্য। দশ বৎসর পূর্বে যাহা আপনিই আসিয়া জুটিয়াছিল আপনার কাছে, তখন তাহাকে হয়তো আদর দেন নাই, এখন আর তাহা জুটিবার না, সেই জন্য তাহার স্মৃতিই সুখদ হইয়া রইয়াছে।
সাধু ভাষা কাকে বলে এবং এর বৈশিষ্ট্য বিবেচনা করলেই দৈনন্দিন প্রয়োজনে এর ব্যবহার সম্ভব।
শেষকথা
সাধু ভাষা বাংলার মানুষের ঐতিহ্যের, প্রাচুর্যের ও গৌরবের ভাষা। সাধু ভাষা বাংলা ভাষার আভিজাত্য প্রকাশ করে। বস্তুত সাধু ভাষায় এখন আর ব্যবহার উপযোগী নয়। তবুও সাধু ভাষার মাঝে রয়েছে সাহিত্য রচনার অপার সৌন্দর্য।
উপরোক্ত আলোচনায় সাধু ভাষা কাকে বলে এবং সাধু ভাষা সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য রয়েছে। সাহিত্যের অঙ্গনে এই ভাষা টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করতে হবে। তবেই বাংলা ভাষার বৈচিত্র সমহিমায় টিকে থাকবে।