নোয়াখালী ভাষা সম্পর্কে বিস্তারিত

নোয়াখালী ভাষা সম্পর্কে বিস্তারিত

নোয়াখালী ভাষা বা নোয়াখাইল্লা ভাষা হলো বাংলাদেশের নোয়াখালী অঞ্চলের মানুষের প্রধান উপভাষা। বিভিন্ন জেলার আঞ্চলিক ভাষার মধ্যে এটি অনেক বেশি আকর্ষণীয়, বৈচিত্র্যপূর্ণ এবং নাট্যাভিনয়ে অন্যতম উপযোগী ভাষা। এই ভাষায় হাস্যরসাত্বক এবং কৌতুকপূর্ণ ভাব রয়েছে, যা বহু নোয়াখালীয় ভাষার নাটক, চলচ্চিত্র ও লোকগানে ফুটে উঠে। তাই বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মানুষেদের নোয়াখালী ভাষা সম্পর্কে বিস্তারিত জানার কৌতুহল অনেক বেশি।

কয়েক শত বছর আগে থেকেই এই ভাষা বাংলার বুকে স্থান করে নিয়েছে। বাংলার সাথে এবং বাংলার অন্যান্য উপভাষার সাথে ব্যাপক মিল থাকায়, নোয়াখাইল্লা ভাষাকে বাংলার উপভাষা বলা হয়। বাংলাদেশের সকল অঞ্চলের মানুষের কাছে নোয়াখালীয় উপভাষার বৈচিত্র্য তুলে ধরতে, নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষার ইতিহাস, ভাষা বৈচিত্র্য, উপভাষিক বৈচিত্র্য, ব্যাকরণ, লিখন পদ্ধতি, ভৌগলিক বিস্তার, নোয়াখালীর শব্দ, বাক্য ও লোকসাহিত্য ইত্যাদি বিষয় নিয়ে নোয়াখালী ভাষা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হলো এই নিবন্ধে।

সূচিপত্র

নোয়াখালী ভাষা

মানুষের মনের ভাব আবেগ, অনুভূতি, চিন্তা, চেতনা অভিব্যক্তি প্রকাশের প্রধান বাহন হলো নিজের মাতৃভাষা/ প্রাণের ভাষায়। নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষাই সেই অঞ্চলের মানুষের প্রাণের ভাষা। এটি বাংলার ভাষা বৈচিত্র্যের অন্যতম নান্দনিক শাখা। এটি প্রাচীন ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা-পরিবারের অন্তর্গত উপভাষীয় বাংলার একটি অংশ। বাংলাদেশের নোয়াখালী জেলা ছাড়াও চট্টগ্রাম, ভোলা, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লা ও চাঁদপুর জেলার কিছু অঞ্চলের মানুষ এই ভাষায় কথা বলে। তাছাড়া ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের প্রধান উপভাষা হিসেবে সাব্রুম, হৃষ্যমুখ, বিলোনিয়ায় নোয়াখাইল্লা ভাষা প্রচলিত রয়েছে।

নোয়াখালীর ভাষার নিজস্ব বর্ণমালা নেই বলে, এই ভাষা লিখতে বাংলা বর্ণমালা ব্যবহার করা হয়। নোয়াখালীর অভ্যন্তরীণ অঞ্চলভেদে এই ভাষার শব্দ উচ্চারণে কিছুটা তারতম্য দেখা যায়। ‘চাটখিল’ নামে এই ভাষার একটি উপভাষাও রয়েছে, যা বিশেষভাবে চাটখিল উপজেলার মানুষের মাঝে ব্যবহৃত। আনুষ্ঠানিকভাবে এই ভাষাটি ব্যবহৃত হয় না। তবে বাংলাদেশের জনপ্রিয় হাস্যরসাত্বক কৌতুক, নাট্যাভিনয়, সিনেমায় এর ব্যাপক ব্যবহার লক্ষণীয়।

প্রমিত বাংলা ভাষার সাথে এবং বরিশাল উপভাষার সাথে এর মিল থাকায় নোয়াখালীয় উপভাষাকে বাংলার একটি উপভাষা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এটি বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতির জনপ্রিয় একটি ভাষা। মধ্যযুগ থেকে এই উপভাষায় বহু সাহিত্য ও লোকসংগীত রচিত হয়েছে।

নোয়াখালী ভাষার ইতিহাস

বাংলাদেশের নোয়াখালী জেলার আঞ্চলিক ভাষার ইতিহাস প্রায় হাজার বছরের পুরনো। এই ভাষার ব্যুৎপত্তি, ক্রমবিকাশ ও নামকরণ নিয়ে ঐতিহাসিক নানান ঘটনা সংগঠিত হয়েছে। প্রাচীন সেই নোয়াখালী অঞ্চলের ভাষার উৎপত্তি থেকে বর্তমান সময় অব্দি নোয়াখালী উপভাষার ধারাবাহিক ইতিহাস নিচে তুলে ধরা হলোঃ

নোয়াখাইল্লা ভাষার ব্যুৎপত্তি

বৃহত্তর নোয়াখালী জেলার আঞ্চলিক ভাষার উৎপত্তির সঠিক ইতিহাস বর্তমান সময় অব্দি উদ্ভাবন করা যায়নি। এটি মূলত প্রাচীন ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবার থেকে পর্যায়ক্রমিকভাবে ইন্দো-ইরানীয় > ইন্দো-আর্য ভাষা শাখার > পূর্বাঞ্চলীয় উপশাখার > বাংলা-অসমীয়া ভাষার > উপভাষীয় বাংলার একটি সদস্য। বাংলা ভাষার সাথে এর ব্যাপক মিল থাকায়, ধারণা করা হয় বাংলা ভাষার উৎপত্তির সময়কাল থেকেই আঞ্চলিকভাবে এই ভাষারও ব্যুৎপত্তি হয়েছিল। 

নোয়াখালী অঞ্চলের উপভাষাটি মূলত প্রাচীন নোয়াখালী অঞ্চলের অন্যান্য উপভাষার সংমিশ্রণ থেকে উদ্ভূত হয়েছে। বর্তমান সময়ের নোয়াখালী অঞ্চলটি প্রাচীন বাংলার উপ-অঞ্চল গুলোর মধ্যে অন্যতম কনিষ্ঠ অঞ্চল।‌ নোয়াখালী অঞ্চলের সভ্যতা প্রায় ৩,০০০ হাজার বছর পূর্বে যাত্রা শুরু করেছিল। এটি ছিল প্রাচীন সমতট জনপদের একটি অংশ। বাংলাদেশের পূর্ব ও দক্ষিণ পূর্ব অঞ্চলের ব্রহ্মপুত্র নদীর মুখে বঙ্গ জনপদের প্রতিবেশী ছিল এই অঞ্চল। তাই এর প্রাচীনত্ব সম্পর্কে কোন সন্দেহ নেই।

বিদেশি ইতিহাসবিদ ওয়েবেস্টারের মতে, নোয়াখালী অঞ্চলের আদিবাসীরা মূলত বাংলার চন্ডাল, নমশূদ্র অথবা যোগী সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন। তারা ছিলেন এই অঞ্চলের প্রধান হিন্দু জাতি। প্রাচীনকালে নোয়াখালী অঞ্চলের অধিবাসীরা সংস্কৃত ভাষায় কথা বলতো। তারা বর্তমানকালীন নোয়াখালীর ভাষায় কথা বলতেন না, বরং তাদের মাঝে আদি কথ্যরীতি প্রচলিত ছিল। প্রায় ২ হাজার বছর পরে কালের বিবর্তনে সেই প্রাচীন অঞ্চলের ভাষা পরিবর্তিত হয়ে মধ্যযুগীয় নোয়াখাইল্লা ভাষার রূপ ধারণ করে। পরবর্তীতে ১৩ শতকে এসে এই অঞ্চলের ভাষা আধুনিক নোয়াখাইল্লা উপভাষার পূর্বসূরী হিসেবে রূপ লাভ করে।

নোয়াখালী ভাষার ক্রমবিকাশ 

খ্রিস্টীয় ৩০০০ বছর পূর্বে এই অঞ্চলের প্রাচীন সমতট জনপদের অবস্থান ছিল নোয়াখালী, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ফেনী, লক্ষ্মীপুর ও চাঁদপুর অঞ্চল জুড়ে। নোয়াখালী অঞ্চলের উল্লেখযোগ্য ইতিহাস শুরু হয় শিলুয়া ও ভুলুয়া গ্রামে সভ্যতার মধ্য দিয়ে। বাংলার সমতট জনপদ, পুন্ড্র ও হরিকেল অঞ্চলের বৌদ্ধ এবং হিন্দু রাজত্বের সময় ভুলুয়া ছিল আঞ্চলিকতার কেন্দ্রবিন্দু। এই ভুলুয়া বন্দর পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য ও যোগাযোগে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল।

১৩ শতকের দিকে এই ভুলুয়া অঞ্চলের পরিধি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। ভুলুয়া অঞ্চলের রাজারা সংস্কৃত ভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কিন্তু মুঘল শাসনামলের পূর্ব থেকে এই অঞ্চলে মুসলিমদের আগমন হয়। সেই সময়কাল থেকেই এই অঞ্চলের উপভাষায় আমূল পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। মধ্যযুগে ভুলুয়ায় মুঘলদের বিজয়ের পর সর্বত্র মুসলিম অভিবাসন প্রসারিত হয়। ফলে স্থানীয় উপভাষা আরবি এবং ফারসি ভাষার দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হতে থাকে এবং আঞ্চলিকতার টান ফুটে উঠে। 

১৭৭২ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর গভর্নর জেনারেল ‘ওয়ারেন হেস্টিংস’, এদেশে আধুনিক জেলা প্রশাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। তবে ১৭৭৩ সালে এই জেলা প্রথা প্রত্যাহার করা হয়। ১৭৮৭ সালে পুনরায় বাংলাদেশকে ১৪টি জেলায় ভাগ করে জেলা প্রশাসন ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়। তখন ভুলুয়া অঞ্চল ত্রিপুরা জেলার (বর্তমান কুমিল্লা) অন্তর্ভুক্ত ছিল। নোয়াখালীর মূল ভূখণ্ড, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, ভোলা, হাতিয়া, ত্রিপুরার কিছু অংশ, চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ ও মীরসরাই নিয়ে ছিল ভুলুয়া পরগনা।

১৮২১ সালে ভুলুয়া একটি স্বতন্ত্র জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ত্রিপুরা জেলা থেকে আলাদা হয়। পরবর্তীতে, ১৮৬৮ সালে ভুলুয়া জেলাকে নোয়াখালী জেলা নামকরণ করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায়, ভুলুয়ার সেই মধ্যযুগীয় আঞ্চলিক ভাষাকে আমরা নোয়াখালী ভাষা নামে চিহ্নিত করি।

নোয়াখাইল্লা ভাষার নামকরণের ইতিহাস 

নোয়াখাইল্লা আঞ্চলিক ভাষার নামকরণ করা হয়েছে এই অঞ্চলের ‘নোয়াখালী’ নাম থেকে। ভাষার নামই এই অঞ্চলের মানুষের কথিত ভাষার পরিচয় বহন করে। নোয়াখালী জেলার প্রাচীন নাম ভুলুয়া এবং এর সদর থানার পূর্ব নাম সুধারাম ছিল। গবেষকদের মতে মধ্যযুগে একবার ত্রিপুরার পাহাড় থেকে প্রবাহিত হওয়া ডাকাতিয়া নদীর স্রোতে ভুলুয়া অঞ্চলের উত্তর-পূর্বাঞ্চল তীব্রভাবে প্লাবিত হয়। এতে ফসলি জমি সহ সাধারণ জনগণের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।

ভুলুয়া অঞ্চলের এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য ১৬৬০ সালে একটি বিশাল খাল খনন করা হয়। এর প্রবাহ পথ ছিল ডাকাতিয়া নদী থেকে রামগঞ্জ, সোনাইমুড়ি ও চৌমুহনী হয়ে মেঘনা এবং ফেনী নদীর দিকে। খালটির খননকাজ সম্পন্ন হলে এর দৈর্ঘ্য হয় প্রায় ৬০ কিলোমিটার। বিশাল এলাকাজুড়ে খননকৃত এই খালকে ভুলুয়ার আঞ্চলিক ভাষায় ‘নোয়া খাল’ (নতুন খাল) বলা হতো। ধীরে ধীরে আঞ্চলিকতার টানে লোকমুখে এই অঞ্চলটি ‘নোয়াখালী’ হিসাবে পরিচিতি লাভ করে।

এই নোয়াখালীর নামানুসারে, এই এলাকার উপভাষাকে রূপান্তরিত বঙ্গীয় আকারে প্রকাশ করে ‘ইয়া’ প্রত্যয় যোগ করা হয়। এটি অপিনিহিত নামক ভাষাগত প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ‘নোয়াখাইল্লা’ নামে পরিচিতি পায়। সাম্প্রতিক পাকিস্তানি আমলের পূর্ব থেকে নোয়াখাইল্লা ভাষার নাম প্রচলিত রয়েছে।

নোয়াখালী ভাষা ও বাংলা উপভাষিক বৈচিত্র্য 

নোয়াখালীর ভাষাকে বাংলা ভাষার উপভাষা বলে বিভিন্ন ভাষাবিদ ও ইতিহাসবিদ মত প্রকাশ করেছেন। বিশেষজ্ঞদের কিছু মতবাদ নিচে উপস্থাপন করা হলোঃ

নোয়াখাইল্লা উপভাষা নিয়ে গ্রিয়ারসন- এর মতবাদ

১৯০৩ সালে জর্জ আব্রাহাম গ্রিয়ারসন, তার ‘লিঙ্গুইস্টিক সার্ভে অব ইন্ডিয়া’- গবেষণায় নোয়াখালীর উপভাষাকে চট্টগ্রাম ও আকিয়াবের উপভাষার পাশাপাশি একইসাথে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার উপভাষায় গোষ্ঠীবদ্ধ করেছেন।  

ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়- এর মতবাদ

১৯২৬ সালে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের ভাষা বিষয়ক গবেষণার ফলশ্রুতিতে, তিনি নোয়াখাইল্লাকে বাংলার উপভাষার পূর্বাঞ্চলীয় বঙ্গ গোষ্ঠীতে স্থান দিয়েছেন। এ বিষয়ে তিনি উল্লেখ করেন, সমস্ত বাংলা উপভাষা একে অপরের থেকে স্বাধীন ছিল। বাংলার বিভিন্ন পূর্ব উপভাষার সাথে মিলে নোয়াখাইল্লা উপভাষার রূপগত, উচ্চারণগত বৈশিষ্ট্য তৈরি হয়েছে। যা বাংলার (সমগ্র ভারতবর্ষের) অন্যান্য পশ্চিমী উপভাষায় নেই।

ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ’র মতবাদ

ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ নোয়াখাইল্লা উপভাষাকে বাংলা উপভাষা সমূহের পাশ্চত্য (গৌড়ী) শাখার বিপরীতে প্রাচ্য (বঙ্গীয়) শাখার অধীনস্থ করেছেন। নোয়াখালীয় উপভাষাটি এই অঞ্চলের অন্যান্য বাংলা আঞ্চলিক ভাষার সংমিশ্রণের ফলে তৈরি। বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষার সংযোজনই এই অনন্য ও স্বতন্ত্র বাংলা উপভাষার জন্ম দিয়েছে।

ভাষাবিদ পরেশ চন্দ্র মজুমদার- এর মতবাদ

১৯৯২ সালে ভাষাবিদ পরেশ চন্দ্র মজুমদার উপভাষার শ্রেণীবিভাগের কথা উল্লেখ করে, নোয়াখাইল্লা উপভাষাকে প্রাচ্য (বঙ্গীয়) শাখার পূর্বদেশী উপ-শ্রেণির অধীনস্থ করেছেন। 

উপরোক্ত সকল গবেষকদের মতামত অনুযায়ী বলা যায়, নোয়াখালী অঞ্চলের ভাষাটি বাংলা ভাষার উপভাষা শ্রেনীর বঙ্গীয় শাখার অন্তর্ভুক্ত একটি ভাষা।

নোয়াখালী ভাষার বৈচিত্র্য

নোয়াখালী অঞ্চলের ভাষা বাংলা ভাষার একটি বৃহৎ উপভাষা। তবে অন্য ভাষার উপভাষা হয়েও এর নিজস্ব কিছু আঞ্চলিক রূপ/ নোয়াখাইল্লা ভাষারও উপভাষা রয়েছে। বৃহত্তর নোয়াখালী অঞ্চলের বিভিন্ন উপজেলা/ এলাকায় এই ভাষার উচ্চারণে কিছু পার্থক্য দেখা যায়। 

২০ শতকের শুরুর দিকে, আইরিশ ভাষাবিদ জর্জ আব্রাহাম গ্রিয়ারসন, তার ‘লিঙ্গুইস্টিক সার্ভে অব ইন্ডিয়া’- ভাষাভিত্তিক গবেষণার কাজে দুটি নোয়াখাইল্লা লোককবিতা সংগ্রহ করেছিলেন। তন্মধ্যে, একটি ছিল নোয়াখালীর মূল ভূখণ্ডের উপকূলে অবস্থিত হাতিয়া দ্বীপ থেকে এবং অপরটি ছিল বর্তমান লক্ষীপুর জেলার অন্তর্গত রামগঞ্জ এলাকা থেকে সংগৃহীত। তিনি বাংলা অঞ্চলে বাংলা ভাষার উপভাষার মাঝেও বৈচিত্র্য খুঁজে পেয়েছিলেন এই লোককবিতার মাধ্যমে। 

প্রমিত/ শুদ্ধ বাংলা ভাষায়- ‘একজন মানুষের দুটি ছেলে ছিল’, এই বাক্যটিকে বৃহত্তর নোয়াখাইলীর বিভিন্ন অঞ্চলে যে ভিন্ন ভিন্ন রূপে ব্যবহার করা হয়, তা নিচে তুলে ধরা হলোঃ

বিভিন্ন অঞ্চলে নোয়াখালীয় উপভাষার ব্যবহারআঞ্চলিক ভাষায় বাক্য
প্রকৃত নোয়াখাইল্লা (গ্রিয়ারসনের মতবাদ অনুযায়ী)একজন মেনশের দুগা হোলা আছিল।
নোয়াখালীর হাতিয়া দ্বীপ অঞ্চলএকজন মাইনসের দুগা হোলা আছিল।
নোয়াখালীর ছাগলনাইয়া অঞ্চলএকজনের দুই হোলা আছিল।
নোয়াখালীর রামগঞ্জ অঞ্চলএকজনের দুই হুত আছিল।
বৃহত্তর নোয়াখালীর ফেনী অঞ্চলডিম মেনশের দুগা হোলা আছিলো।

নোয়াখালী ভাষার লিখন পদ্ধতি

নোয়াখাইল্লা ভাষার নিজস্ব কোন লিখন পদ্ধতি/বর্ণমালা আবিষ্কৃত হয়নি। এটি বাংলা ভাষার একটি উপভাষা হওয়ায় এই ভাষার লিখন পদ্ধতি হিসেবে বাংলা বর্ণমালা ব্যবহার করা হয়। বাংলা ভাষার আঞ্চলিক উপভাষা গুলো প্রাতিষ্ঠানিক বা সরকারি কর্মকান্ডে ব্যবহার করা হয় না বলে, এর লিখন পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়নি।

বাংলাদেশের শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা বর্ণমালা ব্যবহার করেই প্রমিত বাংলায় শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালিত হয়। ঐতিহাসিক কাল থেকে নোয়াখালী জেলায় এবং বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের কিছু অংশে লিখন পদ্ধতি হিসেবে সিলেটি নাগরী লিপি ব্যবহার করা হতো। বিংশ শতাব্দীর শেষভাগ পর্যন্ত এর ব্যবহার থাকলেও বর্তমানে তা শুধুমাত্র গ্রন্থ ও পুঁথিতে লক্ষণীয়। তাই নোয়াখালী অঞ্চলের উপভাষিক বৈচিত্র্য ফুটিয়ে তুলতে এই বাংলা বর্ণমালার ব্যবহারই যথেষ্ট।

নোয়াখালী ভাষার ভৌগোলিক বিস্তার

নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষা মধ্যযুগে সমগ্র ভুলুয়া অঞ্চলজুড়ে, অর্থাৎ নোয়াখালীর মূল ভূখণ্ড, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, ভোলা, হাতিয়া, ত্রিপুরার কিছু অংশ, চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ ও মীরসরাই এলাকাতে বিস্তৃত ছিল। বর্তমানে সেই অঞ্চলগুলো একটির সাথে আরেকটি সংযুক্ত হয়ে ভৌগোলিকভাবে ভিন্ন নামে পরিচিত। 

২১ শতকে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগের নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষ্মীপুর জেলা এবং হাজীগঞ্জের উপ-জেলার কিছু অংশের মানুষের প্রধান কথ্য ভাষা হলো নোয়াখালীয় উপভাষা। এছাড়া নোয়াখালী জেলার পার্শ্ববর্তী কুমিল্লার লাকসাম, চৌদ্দগ্রাম, চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ, চট্টগ্রামের মিরসরাই, দক্ষিণ চাঁদপুরের কিছু মানুষের কথ্য ভাষাও এটি। 

১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ বিভাজনের আগে ও পরে নোয়াখাইল্লা ভাষাভাষীদের অনেকেই ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে চলে গিয়েছিল। বর্তমানে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের দক্ষিণ অংশে, বিশেষ করে দক্ষিণ ত্রিপুরা, সিপাহিজালা এবং গোমতি জেলার কিছু অংশে এই ভাষায় কথা বলা হয়। দক্ষিণ ত্রিপুরার সাব্রুম, বিলোনিয়া, হৃষ্যমুখ অঞ্চলেরও প্রধান কথ্য ভাষা হলো নোয়াখালী ভাষা। এছাড়াও ছোট কিছু অঞ্চলে, যেমন- শান্তিরবাজার, নাটুনবাজার, বারপাথারি, কাঠালিয়া, ত্রিশনা, গার্জি, জোলিবাড়ি, বৈখোড়া, সাতচাঁদ, কারবুক, চন্দ্রপুর ইত্যাদি এলাকাতেও এই ভাষা প্রচলিত। 

ভারতীয় উপমহাদেশের বাইরে, নোয়াখালীর প্রবাসীরা ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্যে অভিবাসী হিসেবে বাস করে। আদিবাসী ত্রিপুরী, চাকমা, মারমা, রেয়াং ইত্যাদি উপজাতিদের অনেকেই এই ভাষা ব্যবহার করে। ‘ভাষা ব্যবহারকারীর সমীক্ষা ২০১১’ অনুযায়ী প্রায় ৭ মিলিয়ন বা ৭০ লক্ষ মানুষ নোয়াখালীয় উপভাষায় কথা বলেন। গত ১২ বছরে এর ব্যবহারকারীর সংখ্যা অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। গবেষকদের মতে, বর্তমানে বাংলাদেশ ও ভারত সহ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে প্রায় ১ কোটিরও বেশি মানুষ নোয়াখাইল্লা ভাষায় কথা বলেন।

নোয়াখালী ভাষার ব্যাকরন

নোয়াখালীর ভাষায় বাক্যের গঠন প্রকৃতি ও শব্দ শৈলী প্রায় শুদ্ধ বাংলা ভাষার মতোই। তবে বাংলা ভাষা থেকে আলাদা করার জন্য আর কিছু বৈশিষ্ট্য ও উপভাষিক ব্যাকরনের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। প্রমিতা বাংলা ভাষা এবং অন্যান্য ইন্দো-আর্য ভাষা থেকে নোয়াখাইল্লা উপভাষাকে আলাদা করার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো ‘প’ ও ‘ফ’ এর স্থলে ‘হ’ রূপে ব্যবহার করা হয়। এরকম আরো বহু উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে। নিচে নোয়াখালীর ভাষার উল্লেখযোগ্য ব্যাকরণিক দিকগুলো তুলে ধরা হলোঃ

  • ব্যঞ্জন ধ্বনি রূপান্তরের ক্ষেত্রে ‘হ’-কারীভবন ব্যবহৃত হয়। যেমন: পানি > হানি।
  • মহাপ্রাণ ধ্বনির অল্পপ্রাণতা দেখা যায়। যেমন: ঘুম > গুম, ঘাম > গাম, ভালো > বালা ইত্যাদি।
  • অঘোষ ধ্বনির ঘোষভাব দেখা যায়। যেমন: কাঁঠাল > কাঁডল, মাটি > মাডি, আজকে > আইজগা ইত্যাদি।
  • শব্দ উচ্চারণে নাসিক্যভবন রূপ লক্ষ্য করা যায়। যেমন: খাবো না > খাইতান্ন, কোথায় > কোনাই, আপনি > আন্নে ইত্যাদি।
  • কিছু কিছু শব্দ উচ্চারণের সময় বর্ণ লোপ ভিন্নরূপ ধারণ করে। যেমন: আমি > আঁই, বেপারি > বেরি, হাজী সাহেব > আজি সাব, নারিকেল > নাইল ইত্যাদি।
  • স্বরধ্বনির রূপান্তরের ক্ষেত্রে অপনিহিতির ব্যবহার হতে দেখা যায়। যেমন: জানিয়া > জানি, শুনিয়া > হুনি ইত্যাদি।
  • উচ্চারণের ক্ষেত্রে স্বরসংকোচ ও ব্যাপকভাবে লক্ষ্য করা যায়। যেমন: ননদ > নন্দ, নিরালা > নিরল ইত্যাদি।

মারাঠি ভাষার পঞ্চমী ও সপ্তমী বিভক্তির সঙ্গে এই অঞ্চলের অনুরূপ বিভক্তির সামঞ্জস্য বিদ্যমান। যেমন: নোয়াখাইল্লা- হিয়ানতুন মনি বাড়িত আইলো। মারাঠি- তেথুন মনি ঘরিত আলা। এখানে, মারাঠি ভাষা ও নোয়াখাইল্লা ভাষার সপ্তমী বিভক্তিযুক্ত ‘বাড়িত’ ও ‘ঘরিত’ শব্দে পদদ্বয়ের শেষে ত ধ্বনির ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।

এছাড়াও প্রমিত বাংলা ভাষার সাথে নোয়াখাইল্লা উপভাষার আরো বহু ব্যাকরণিক ভিন্নতা বিদ্যমান রয়েছে।

নোয়াখালী ভাষার আকর্ষণীয় শব্দ 

বাংলাদেশের বৃহত্তর নোয়াখালী অঞ্চল বন্দর এলাকা হওয়ায়, প্রাচীনকাল থেকেই নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের যুগদীয়া এবং সুধারামের শান্তাসিতা সমুদ্র বন্দর ব্যবসা-বাণিজ্যে সমৃদ্ধ ছিলো। সেই সুবাদে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষ বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে এখানে আসতেন। সেই সময়ে পণ্য আমদানি-রপ্তানির সাথে আমদানি-রপ্তানি হয়েছে নানান দেশের ভাষাও। নোয়াখালী অঞ্চলের ভাষার সাথে মিশে গেছে অসমীয়া, পর্তুগীজ, আরবি, ফারসি, ইংরেজি, ল্যাটিন, গ্রীক ভাষা ও তাদের বহু শব্দ।

নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষার কিছু আকর্ষণীয় শব্দ ও শুদ্ধ বাংলার সাথে তার পার্থক্য নিচে তুলে ধরা হলোঃ

প্রমিত বাংলা ভাষা নোয়াখাইল্লা ভাষা
পানিহানি
আমিআঁই
গর্ভবতীখোন্দতি
স্বভাবখাইচ্চৎ
হিংসুকহিন্নারিয়া
ছেলেহোলা/হুত
শশুরহোর
শাশুড়িহড়ি
ডিমবয়জা
আপনি আন্নে
তোমারতোঁয়ার
তারহেতির
চিরুনিকাঁই
শয়তানিখন্নাশি
কিকিয়া
কোথায়কোঁনাই
পেঁপেহাবিয়া/ হাইয়া
বেগুনবাইয়ুন
হাঁটতেআঁইটতে
পাঠ্যাং
সৌন্দর্য্যডক
পুকুরহুইর
সাঁতার কাটাহাচুরুন
করেছেকরি আলাইছে
শুয়ে পড়োহুতি যা
মজারহোয়াদের
ব্যথাবিষ
একটাঅজ্ঞা

নোয়াখালী ভাষায় কথোপকথন

শুদ্ধ বাংলা ভাষা এবং নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষার বাক্য গঠন রীতি প্রায় একই। তবে শব্দগত এবং উচ্চারণের নানা ভিন্নতাই এটিকে প্রমিত বাংলা থেকে আলাদা করেছে। নোয়াখাইল্লা উপভাষার কিছু বাক্য ও প্রমিত বাংলা ভাষার সাথে পার্থক্য নিচে তুলে ধরা হলোঃ

প্রমিত বাংলা ভাষা নোয়াখাইল্লা ভাষা
আমাদের কথ্য ভাষা নোয়াখাইল্লা।আংগো মুহের বাষা নোয়াখাইল্লা।
আমাকে একটা কলম কিনে দাও।আঁতেল অজ্ঞা হলম কিনি দেও।
একটি জীবিত মহিষ পানিতে পড়ে গেছে।এগ্গা জ্যাঁতা ভৈঁস হানিত হড়ি গেছে।
আপনি এখন কোথায় যাবেন।আন্নে হনে কোঁনাই যাইবেন।
পাকা আম খেতে অনেক মজার।ফাকনা আম খাইতে অনেক হোয়াদের।
তোমার সাঁতার কাটা শিখতে হবে।তোয়ার হাচুরুন হিগন লাগবো।
পেঁপে স্বাস্থ্যের জন্য ভালো।হাইয়াগুন শইলেল লাইগ্গা বালা।
আমাকে এক গ্লাস পানি দাও তো।আঁরে এক গেলাস হানি দেইচ্চাইন।
আমার মনে হয় পাঁচ টাকা নিয়েছে।আঁত্তুন লাগে যেন হাঁস টাহা লই আলাইছে।

নোয়াখালী ভাষা শিক্ষা

বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষা গুলোর মধ্যে, অন্যতম বৈচিত্র্যপূর্ন ভাষা হলো নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষা। এই ভাষার মধ্যে অনেক বেশি আঞ্চলিকতা, হাস্যরসাত্মক ও কৌতুকপূর্ণ ও নাটকীয় ভাব থাকায় সারাদেশের মানুষ এই ভাষার প্রতি আকৃষ্ট হয়। অনেকেই কথার ছলে আঞ্চলিকতার স্বাদ নিতে এই ভাষা শিখে। শিক্ষিত সমাজের অনেকেই আবার নিজের অঞ্চলের ভাষাকে প্রকৃত উচ্চারণের সাথে উপস্থাপনা করতে এই ভাষা শিখতে চায়। 

নোয়াখালী উপভাষা শিক্ষার জন্য বেশি বেশি নোয়াখালী ও শব্দ জানতে হবে এবং নিয়মিত চর্চা করতে হবে। নতুন নতুন শব্দ শেখার জন্য সাহায্য নিতে পারেন নিম্নোক্ত বইগুলো থেকেঃ

  • বাংলা একাডেমী কর্তৃক প্রকাশিত- “বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান।” রচয়িতা- ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। (অনলাইনে এই অভিধানের পিডিএফ (PDF) কপি পাওয়া যায়)
  • “বৃহত্তর নোয়াখালী অঞ্চলের ভাষা বৈচিত্র‌্য পরিপ্রেক্ষিত ধ্বনিতত্ত্ব।” রচয়িতা- মোহাম্মদ নেয়ামত উল্যাহ ভূঁইয়া। 

এসকল বইয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপে কিংবা অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নোয়াখালী ও বন্ধুদের সাথে ভাষা চর্চা করেও নোয়াখালী ভাষা শিখতে পারবেন।

নোয়াখাইল্লা ভাষায় সাহিত্য 

নোয়াখালী অঞ্চলের শক্তিশালী লোক ঐতিহ্য কয়েক শতাব্দী থেকেই অনেক বেশি সমৃদ্ধ। নোয়াখালী অঞ্চলে প্রাচীন ভুলুয়ার রাজারা সংস্কৃত ভাষী ছিলেন। তখন থেকেই এই অঞ্চলে অনেক বেশি সাহিত্য সাধনা হতো। পরবর্তীতে ইসলামী শাসন ব্যবস্থার আগমন হলে নতুন রূপে আঞ্চলিক ভাষায় লোকসাহিত্য রচিত হতে থাকে। নোয়াখালীর আঞ্চলিক লোক সাহিত্যের মধ্যে পুঁথি, লোকসংগীত, প্রবাদ-প্রবচন, শোলক/ ধাঁ-ধা, নাট্যাভিনয় ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। 

আধুনিক কালে নোয়াখালী ভাষার ব্যবহার

নোয়াখালী অঞ্চলের মানুষের প্রধান কথ্য ভাষা নোয়াখাইল্লা উপভাষা হলেও, দিন দিন এর ব্যবহার কমে যাচ্ছে। আঞ্চলিক ভাষা হওয়ায় প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকান্ডে, আদালতে বা আইনসভায়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, কর্মস্থলে কিংবা জনসম্মুখে নোয়াখাইল্লা ভাষার কোনো আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি নেই। বাংলাদেশের আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা, শিক্ষিত ও অভিজাত গোষ্ঠীরা তাদের কথ্য ভাষায় মাধুর্যের জন্য প্রমিত বাংলা ভাষা ব্যবহার করে। 

রাজনৈতিক কর্মকান্ডেও এই উপভাষার ব্যবহার তেমন দেখা যায় না। নোয়াখালীর সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যগত ঘটনার সাথেও অন্তর্নিহিতভাবে বাংলা ভাষার প্রমিত রূপ মিশে গেছে। শুধুমাত্র নোয়াখালীয় জনগণের মাঝে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায়ই এর ব্যবহার সবচেয়ে বেশি। নতুন প্রজন্মের শিশুদেরকে স্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এবং শিশুদের অভিভাবকগণ প্রমিত বাংলা ভাষায় কথা বলতে উৎসাহিত করে। কারন প্রমিত/ শুদ্ধ বাংলা ভাষা এটি বাংলাদেশে সরকারি ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রধান ব্যবহৃত ভাষা। তাছাড়া এটি দেশের সকল অঞ্চলের মানুষের সাথে যোগাযোগের জন্য উপযোগী।

বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ নোয়াখালীর ভাষা নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করেন, যা এই ভাষার মর্যাদা ক্ষুন্ন করে। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও এই ভাষা নিয়ে হাসি-তামাসা ও ঠাট্টা-বিদ্রপ করা হয়। নোয়াখাইল্লা উপভাষা ব্যবহারকারীদের মধ্যে স্বল্প সংখ্যক মানুষ এখনো গর্ববোধ করে এই আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করে। অন্যরা এই ভাষা ব্যবহার করলেও মাঝে মাঝে ভাষাগত হীনমন্যতা অনুভব করেন।

শেষকথা 

বাংলাদেশের সবচেয়ে আকর্ষণীয় এবং চাঞ্চল্যকর কয়েকটি ভাষার মধ্যে নোয়াখালী ভাষা অন্যতম। এই ভাষার ইতিহাস সুদীর্ঘকালীন না হলেও, এর ব্যুৎপত্তির পর পেরিয়ে গেছে কয়েক শত বছর। বর্তমানে শুধুমাত্র নোয়াখালী অঞ্চলের স্থানীয়দের মাঝেই এই ভাষার ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। সামাজিকতার দোহাই দিয়ে মানুষ নিজের ঐতিহ্য ও আন্তরিকতাকে হারিয়ে ফেলছে প্রতিনিয়তই। তাই হয়তো কোন এক সময় প্রকৃত নোয়াখাইল্লা ভাষা শুধু পরিবারের প্রবীনদের মাঝেই শুনতে পাওয়া যাবে।

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *