সিলেটি ভাষা সম্পর্কে বিস্তারিত

সিলেটি ভাষা সম্পর্কে বিস্তারিত

সিলেটি ভাষা বাংলার বুকে ছড়িয়ে থাকা ভাষাগুলোর মধ্যে অন্যতম জনপ্রিয় আঞ্চলিক ভাষা। মূলত সিলেটের ভাষা বাংলা ভাষার একটি উপভাষা। তবে সিলেটের নিজস্ব ভাষাও রয়েছে, যার নাম সিলেটি-নাগরী ভাষা। এটি প্রাচীন ইন্দো-আর্য ভাষা পরিবারের অন্যতম সদস্য ভাষা। সিলেট দেশের অন্যতম সেরা পর্যটন অঞ্চল হওয়ায় সিলেটি ভাষা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানতে আগ্রহী মানুষের সংখ্যা নিতান্তই কম নয়।

বর্তমানে সিলেটি-নাগরী ভাষা পৃথিবীর ৯৭ তম বৃহৎ ভাষা এবং এর ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৬০ লক্ষ। এই ভাষার নামানুসারে সিলেটের বন্দর বাজারে একটি চত্ত্বর রয়েছে, যা ‘নাগরী চত্ত্বর’ নামে পরিচিত। সিলেটের ভাষাকে সিলেট্টি, সিলোটীয়া, সিলেটি বাংলা, ছিলটি ইত্যাদি নামেও অভিহিত করা হয়।

সিলেটি ভাষা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য, যেমন: সিলেট জেলার ভাষা, সিলেটের ভাষার ইতিহাস, ভাষার নামকরণ, শ্রেণীবিভাগ, লিখন পদ্ধতি, ভৌগোলিক বিস্তার, নাগরী লিপি, এই ভাষার শব্দ, বাক্য, প্রবাদ-প্রবচন, শেখার উপায় ও বিভিন্ন উপজাতির ভাষা ইত্যাদি থাকছে এই নিবন্ধে।

সূচিপত্র

সিলেটের ভাষা

বাংলাদেশের বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের মানুষের প্রধান ভাষা সিলেটি/ সিলেটি-নাগরী ভাষা। এই ভাষাকে বাংলা ভাষার আঞ্চলিক রূপ হিসেবে ধারনা করা হলেও প্রকৃতপক্ষে এটি একটি স্বতন্ত্র ভাষা। সিলেটি-নাগরী ভাষা সিলেটে বসবাসকারীদের প্রাথমিক মাতৃভাষা। এই ভাষা ও বাংলা ভাষার মূলনীতির মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। সিলেটি-নাগরী ভাষা পূর্বাঞ্চলীয় এবং বাংলা ভাষার প্রমিত রীতি নদীয়া বা পশ্চিমাঞ্চলীয়। তাই এটি বাংলা ভাষা থেকে আলাদা এবং প্রাচীন একটি ভাষা। 

বর্তমানে বাংলাদেশের বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের জনসংখ্যা প্রায় ১ কোটি ১০ লক্ষ। বিশাল এই জন সমুদ্রের মধ্যে প্রায় ১ কোটি মানুষই সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে। তাছাড়া সিলেটের নিকটস্থ অঞ্চল, ভারতের আসাম রাজ্যের বরাক উপত্যকা ও হোজাই জেলা এবং পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে সিলেটিয়ান ভাষাভাষীদের বসবাস রয়েছে।

বাংলা ভাষা ও সিলেটি-নাগরী ছাড়াও সিলেটে বসবাসকারীরা পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করে। এছাড়াও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা পাহাড়ি এই অঞ্চলে বহু ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী তাদের নিজস্ব ভাষায় কথা বলে জীবন পরিচালনা করে।

সিলেটি-নাগরী ভাষার ইতিহাস

শত গবেষণার পরও বর্তমান সময় অবধি সিলেটি-নাগরী ভাষার উৎপত্তির সঠিক সময় নিশ্চিত করা যায়নি। এই ভাষা শুধু সিলেট অঞ্চলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের ত্রিপুরা, মেঘালয় ও আসামের বহু মানুষের মুখের ভাষাও সিলেটি-নাগরী ভাষা। তবে সর্বপ্রথম কোন অঞ্চলে এই ভাষার প্রচলন হয়েছে, তার সঠিক তথ্য নির্ধারণ করা যায়নি। সর্বোপরি, এটি যে একটি প্রাচীন ভাষা, তা নিয়ে কোন মতভেদ নেই। 

বর্তমান সময়ের বিভিন্ন ভাষা গবেষকদের মাঝে সিলেটি ভাষার উৎপত্তি নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মতামত পাওয়া যায়। মূলত সিলেটের আঞ্চলিক ভাষা অতি পূর্ব থেকেই এই অঞ্চলের মানুষের ব্যবহৃত ভাষা ছিল। এটি ছিল তাদের নিজস্ব ভাষা এবং বাংলা ভাষা থেকে আলাদা/ স্বতন্ত্র একটি ভাষা। তবে প্রাথমিকভাবে এই ভাষার সঠিক নামকরণ হয়নি। পরবর্তীকালে এই ভাষার বর্ণমালা উদ্ভাবনের মাধ্যমে ভাষার আত্মপ্রকাশ ও বিকাশ হয়েছিল। নিচে সিলেটি ভাষার প্রচলন সম্পর্কে বিভিন্ন ভাষা গবেষকদের মতামত তুলে ধরা হলোঃ

ডা. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে সিলেটি ভাষার প্রচলন 

মধ্যযুগীয় বিখ্যাত সুফি ব্যক্তিত্ব হযরত শাহজালাল (রহ.) ১৫ শতকের দিকে ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য সিলেট অঞ্চলে এসেছিলেন। তিনি ইসলাম প্রচারের জন্য ধর্মগ্রন্থ/ বাণী নিয়ে এসেছিলেন, যা ছিল সিলেটিয়ান ভাষা থেকে ভিন্ন আরবি ভাষায় বর্ণিত। তখন সিলেট অঞ্চল শ্রীহট্ট নামে পরিচিত ছিল। এবং সেই সময়ে সিলেটের ভাষাকে পূর্ব শ্রীহট্টীয়া, জৈন্তিয়াপুরি বা উজানিয়া ভাষা হিসেবে ডাকা হতো। ভিন্ন দেশ থেকে আগত হওয়ায় এবং ভিন্ন ভাষাভাষী মানুষ হওয়ায় হযরত শাহজালাল (রহ.) এবং তার সাথে আগত ৩৬০ জন সুফি ব্যক্তিত্ব/সাহাবীরা সঠিকভাবে ধর্ম প্রচার করতে পারছিলেন না।

ভাষাগত বিভেদ এর পাশাপাশি সিলেট অঞ্চলের বাসিন্দাদের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থা তখন পর্যাপ্ত ছিল না। ফলে শ্রীহট্টের মানুষের সাথে ইসলাম প্রচারের পাশাপাশি যোগাযোগ রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ে। এই বিষয়কে কেন্দ্র করে, ইসলাম প্রচারক সুফী ব্যক্তিত্বদের সাথে স্থানীয় অধিবাসীদের মনের ভাব বিনিময়ের সহজার্থে ‘নাগরী লিপির’ উদ্ভাবন হয়েছিল। এই নাগরী লিপি ছিল অত্যন্ত সহজ এবং সকলের জন্য বোধগম্য। ফলে সুফী ব্যক্তিত্বদের ইসলাম প্রচার করা এবং শ্রীহট্টের মানুষের তা বুঝতে পারা সহজ হয়ে উঠেছিল। 

মূলত নাগরী লিপিতে রচিত অধিকাংশ সাহিত্যই সুফিবাদের উপর লেখা। তাই ডা. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় এই ধারণা পোষণ করেন।

অধ্যাপক মুহম্মদ আসাদ্দর আলী ও সৈয়দ মোস্তফা কামালের মতে সিলেটি ভাষার প্রচলন

অধ্যাপক মুহম্মদ আসাদ্দর আলী ও সৈয়দ মোস্তফা কামাল, তাদের গবেষণা অনুযায়ী সিলেটের আঞ্চলিক ভাষার প্রচলন সম্পর্কে মত প্রকাশ করেন। সেই মতে, মধ্যযুগীয় জটিল বাংলা বর্ণমালার বিকল্প হিসেবে চতুর্দশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে সিলেটি নাগরী লিপির উদ্ভাবন হয়েছিল। 

হাইপোথিসিস ডক্টর আহমেদ হাসান দানীর মতে সিলেটি-নাগরী ভাষার প্রচলন

তিনি বলেন, সিলেটি বর্ণমালার প্রচলন করেছিল আফগানরা। ১৪ শতকের মাঝামাঝি সময়ে আফগানরা সিলেটে বসতি স্থাপন করেছিল। তখন সিলেট অঞ্চলের অন্যান্য মানুষদের ভাষা ভিন্ন থাকায় যোগাযোগের বিঘ্ন ঘটতো। যোগাযোগ সহজ করার জন্য সিলেটি নাগরী লিপির প্রচলন করা হয়। তার এই মতবাদের দাবির পক্ষে আফগান মুদ্রা উপস্থাপন করা হয়। কারণ, আফগান মুদ্রার লিখিত বর্ণমালা গুলোর সিলেটি নাগরী লিপির সাথে অনেকটাই মিল রয়েছে।

সিলেটের ভাষার নামকরণ 

সিলেট অঞ্চলের মানুষের ব্যবহৃত ভাষা বলে, সিলেট শহরের নামানুসারে ‘সিলেটি ভাষা’ নামটির উৎপত্তি হয়েছিল। মধ্যযুগে, সিলেটিদের এই ভাষাকে পূর্ব শ্রীহট্টীয়া, জৈন্তিয়াপুরি বা উজানিয়া ভাষা বলা হতো। 

১২০৩ খ্রিস্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খলজী বঙ্গবিজয়ের মাধ্যমে এই অঞ্চলে মুসলিম সমাজ ব্যবস্থার সূত্রপাত ঘটিয়েছিলেন। তখনকার সময়ে মুসলিম শাসকগণ তাদের দলিলপত্র ও অন্যান্য মূল্যবান কাগজে পূর্বকালের ‘শ্রীহট্ট’ নামের পরিবর্তে ‘সিলাহেট’, ‘সিলহেট’ ইত্যাদি নাম লিখতেন। যা পরবর্তীতে বিকৃত হয়ে সিলেট শহরের নামকরণ হয়েছে।

ব্রিটিশ শাসনামলে সিলেট জেলার প্রধান বাণিজ্যিক এলাকা ছিলো সিলেট শহর। ইউরোপীয় এবং অন্যান্য দেশের সাথে এই অঞ্চলের ব্যাপক বাণিজ্য হতো। ১৯০৩ সালের গ্রিয়ারসনের মত অনুযায়ী, সিলেট শহরের নাম অনুসারে ইউরোপীয়রা এই অঞ্চলের স্থানীয় ভাষাকে সিলেটিয়া নামে অভিহিত করতো। বর্তমানেও সিলেটের ভাষাকে আরো বিভিন্ন নামে ডাকা হয়ে থাকে। যেমন- সিলেট্টি, সিলোটীয়া, সিলেটি বাংলা, ছিলটি ইত্যাদি।

সিলেটের আঞ্চলিক ভাষার শ্রেণীবিভাগ

সমগ্র সিলেট অঞ্চল জুড়ে সিলেটিয়ান ভাষার উচ্চারণ একইরকম নয়। সমগ্র জেলার ভাষা অভিন্ন এই ধারনাটি ভূল। সাধারণত শ্রীহট্টিয়া শব্দটি দিয়ে জেলার পশ্চিম ও দক্ষিণের উপভাষাকে একই অর্থে ভুলভাবে প্রয়োগ করা হয়।

সিলেট-কামরূপ অঞ্চলের ভাষার মধ্যে উপ-অঞ্চল ভেদে সিলেটের ভাষার বৈচিত্র্য ও বিভিন্ন উপভাষিক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। যেমন: সিলেট শহরের উপভাষা (সিলেটিয়া), উত্তর সিলেটের উপভাষা, উত্তর-পূর্ব সিলেটের উপভাষা, পশ্চিম সিলেটের উপভাষা ইত্যাদি ভিন্ন ভিন্ন রূপ। এছাড়াও ময়মনসিংহ অঞ্চলের উপভাষার মত পশ্চিমা উপভাষাও সিলেটি ভাষায় প্রভাব ফেলে।

সিলেট অঞ্চলের ভাষার বৈচিত্র্যকে দুটি দলে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়েছে। এগুলো হলোঃ (১) পূর্ব-সিলেট পশ্চিম গ্রুপ; (২) সিলেট-কাছার গ্রুপ।   

সিলেটি-নাগরী ভাষার লিখন পদ্ধতি

বাংলাদেশের বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের সিলেটিয় ভাষার নিজস্ব লিখন পদ্ধতি/ বর্ণমালা রয়েছে। এটি সিলেটি-নাগরী বর্ণমালা নামে পরিচিত। ধারণা করা হয়, প্রাচীন বাংলা ভাষার উদ্ভবের পর থেকে ১৬ শতকের পূর্ব পর্যন্ত সিলেটে বাংলা লিপিতে লেখালেখি হতো। তবে মধ্যযুগে ইসলামিক শাসনব্যবস্থার আগমনের পর বাংলা বর্ণমালার পাশাপাশি সিলেটি-নাগরী লিপির প্রচলন হয়। এছাড়াও কথ্য ভাষায় এটি নাগরী, ফুল নাগরী, মোহাম্মদী নাগরী, মুসলমানী নাগরাক্ষর ইত্যাদি নামে পরিচিত ছিল।

নাগরী লিপির উৎপত্তির প্রকৃত তথ্য এখনো জানা যায়নি। তবে ভারতের বিহার রাজ্যের কৈথী লিপির সাথে সিলেটি-নাগরী লিপির মিল রয়েছে। নাগরী লিপিতে লিখিত সর্বপ্রাচীন টিকে থাকা পাণ্ডুলিপিটি হলো গুলাম হোসান – এর রচিত “তালিব হুছন”। এটি আনুমানিক ১৫৪৯-১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে লেখা হয়েছিল।

এ বিষয়ে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মত হলো, ১৫ শতকে বাংলাদেশে আগত হযরত শাহজালাল (রহ.) এবং তার ৩৬০ জন আরবি ভাষী সঙ্গীরা সহজ যোগাযোগের জন্য নাগরী লিপির উদ্ভাবন করেন। 

নাগরী লিপি/ বর্ণমালা

সিলেটি-নাগরী লিপিতে সর্বমোট ৩৩টি বর্ণ রয়েছে। তন্মধ্যে ৫টি স্বরবর্ণ, ২৭টি ব্যঞ্জনবর্ণ। স্বরবর্ণের ৫টি বর্ণের পাশাপাশি “ঐ” উচ্চারনের আরেকটি চিহ্ন ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও ৬ টি ধ্বনি নির্দেশক চিহ্ন রয়েছে। 

নাগরিক লিপিতে সংখ্যা গণনার জন্য বাংলা সংখ্যা পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। এই ভাষায় যুক্ত অক্ষরের ব্যবহার খুবই কম। বাংলা বর্ণমালার চেয়ে নাগরী লিপিতে বর্ণ সংখ্যা কম হওয়ায় নাগরী লিপি বাংলার চেয়ে তুলনামূলক সহজ।

নাগরী লিপির স্বরবর্ণ

সিলেটি নাগরী লিপির অক্ষরসমূহ হুবহু বাংলা বর্ণমালার ধারাবাহিকতা অনুসরণ করে না। নাগরী লিপির ৫টি স্বরবর্ণ ও বাংলা স্বরবর্ণের রূপতাত্ত্বিক পার্থক্য নিম্নরূপঃ

নাগরী লিপির ব্যঞ্জনবর্ণ

নাগরী লিপির ব্যঞ্জনবর্ণ

সিলেটি নাগরী লিপির ২৭টি ব্যঞ্জনবর্ণ ও বাংলা ব্যঞ্জনবর্ণের রূপতাত্ত্বিক পার্থক্য নিম্নরূপঃ

নাগরী লিপির ব্যঞ্জনবর্ণ

সিলেটি-নাগরী লিপির ব্যবহারিক পটভূমি

১৭ শতকের শেষের দিকে সিলেটের সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন কর্মকান্ডে সিলেটি ভাষা ও বর্ণমালা ব্যবহার হতে থাকে। সিলেটি-নাগরী লিপির ব্যবহারকে অধিক গতিশীল করেছিলেন মৌলভী আব্দুল করিম নামে একজন সিলেটিয়ান। দীর্ঘ কয়েক বছর তিনি ইউরোপে অবস্থান করে মুদ্রণ ব্যবসা শিখেছিলেন। তিনি ১৮৬০ এর দশকে দেশে ফিরে এসে  সিলেটি-নাগরী বর্ণমালার জন্য একটি কাঠের ব্লক ডিজাইন করেন। 

১৮৭০ সালের দিকে তিনি সিলেট শহরে ইসলামিয়া প্রেস প্রতিষ্ঠা করেন। তখন থেকে সিলেটি-নাগরী লিপি ব্যবহার করে অন্যান্য বহু প্রেস সিলেট, সুনামগঞ্জ, শিলং এবং কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯৪৭ সালের ভারত ভাগের পূর্ব পর্যন্ত সিলেট অঞ্চলের বিদ্যালয় গুলোতে নাগরী ভাষা শেখানো হতো। পরবর্তীতে ১৯৭০ দশকের শুরুর দিকে এই প্রেসগুলো বন্ধ হতে থাকে। 

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ইসলামিয়া প্রেস আগুনে পুড়ে যায় এবং এই লিপি হঠাৎ বিলুপ্তির সম্মুখীন হয়। তখন থেকে সাধারণ মানুষের মাঝে এই বর্ণমালার প্রচলন নেই। বর্তমানে শুধুমাত্র ভাষাবিদ এবং শিক্ষাবিদরা তাদের গবেষণার কাজে সিলেটি-নাগরী বর্ণমালা ব্যবহার করে থাকেন।

সিলেটি বর্ণমালার কিবোর্ড

২০১৭ সালের ডিসেম্বরে গুগল প্লে-স্টোরে ‘Syloti Nagri Keyboard‘ নামে নাগরী বর্ণমালার একটি কিবোর্ড অ্যাপ্লিকেশন পাবলিশ করা হয়। সিলেটের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাব্বির আহমদ শাওন ও নুরুল ইসলাম নামক দুই শিক্ষার্থী নাগরী লিপির ঐতিহ্য ও অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে এই কিবোর্ড তৈরি করেছিলেন। 

সিলেটি বর্ণমালার কিবোর্ড

এই কিবোর্ড টির ইংরেজি, নাগরী এবং বাংলা টু নাগরী লে-আউট ছিল। মূলত এই অ্যাপ্লিকেশনটি এন্ড্রয়েড সিস্টেমের পুরাতন ভার্সনের জন্য তৈরি করা হয়েছিল, যা বর্তমানে আর ব্যবহার উপযোগী নয়।

সিলেটি নাগরী লিপি ও বাংলার লিখিত রূপ

সিলেটি নাগরী লিপি ও বাংলা ভাষার লিখন পদ্ধতির মধ্যে অনেক বেশি পার্থক্য রয়েছে। তবে উভয় ভাষার বর্ণমালায় অনেকটা মিল থাকায় মনোযোগ সহকারে দেখলে খুব সহজে সকলেই সিলেটি-নাগরী ভাষা বুঝতে পারবে।

সিলেটি ভাষার ভৌগোলিক বিস্তার

বর্তমানে সিলেটিয় ভাষা বাংলাদেশ ও ভারতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিস্তৃত রয়েছে। ২০২০ সালে কানাডাভিত্তিক ওয়েবসাইট ভিজ্যুয়াল ক্যাপিটালিস্টে বিশ্বের সেরা ১০০টি কথ্য ভাষার তালিকা প্রকাশ করা হয়। সেই তালিকায় সিলেটি-নাগরী ভাষা পৃথিবীর বৃহৎ ভাষা গুলোর মধ্যে ৯৭ তম স্থান দখল করেছে।

২০২২ সালে লন্ডনের সিলেটি রিসার্চ এন্ড ট্রান্সলেশন সেন্টারের উদ্যোগে একটি জরিপ পরিচালিত হয়েছে। তা থেকে জানা যায়, বর্তমানে বাংলাদেশেসহ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের প্রায় ১ কোটি ৬০ লক্ষ মানুষ সিলেটিয় ভাষায় কথা বলে। 

তাছাড়া এটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ভাষা গুলোর মধ্যে বাংলা ও চাটগাইয়া ভাষার পরে ৩য় বৃহত্তম ব্যবহৃত ভাষা। ঐতিহাসিক ও বৈচিত্র্যময় এই ভাষাটি সিলেটের সুরমা উপত্যকা অঞ্চলে, ভারতের আসাম রাজ্যের বরাক উপত্যকা এবং হোজাই জেলায় প্রচলিত। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সিলেট অঞ্চল এবং ভারত ছাড়াও পৃথিবীর অন্যান্য দেশে প্রায় সাত লক্ষেরও বেশি মানুষ সিলেটের ভাষায় কথা বলে।

সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় আকর্ষণীয় শব্দ

সিলেট অঞ্চলের অধিবাসীগণ বাংলার আওতাভুক্ত হওয়ায় তাদের ব্যবহৃত শব্দগুলো বাংলা শব্দের প্রায় একইরকম। তবে বহু শব্দ ও উচ্চারণে ভিন্নতা দেখা যায়। নিচে প্রমিত বাংলা ভাষার সাথে সিলেটি ভাষার শব্দের পার্থক্য তুলে ধরা হলোঃ

প্রমিত বাংলা ভাষাসিলেটের ভাষা
নারিকেল নাইকল
সন্ধ্যাহাইঞ্জাবালা
আঙুলঅঙ্গুইল
বাচ্চাহরুতা
ভালোবাসাভালাপাওয়া, পেরেম
চালাকশিয়ান/ বিটিশ
সমস্তহক্কল
কাঁঠালখাটল
জামাইদামান
এটা কী?ইগু/ ইটা কিতা?
অবিবাহিতআবিয়াতা
ভোরে/ সকালেবিয়ানে
শোল মাছহউল মাছ 
ঝাড়ুখরখরা
ছেলেফুয়া
মেয়েফূড়ি
বোলতাবল্লা
টাকি মাছ ছ্যাং মাছ
ঘুড়ি গুড্ডি
হঠাৎ আতকা
করেছিলকরেয়ার
ক্ষুধাপেটো বুক
কথা রাও/ মাত

সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় বাক্য 

প্রমিত বাংলা ভাষাসিলেটের ভাষা
শহরের চেয়ে গ্রামে আরাম। টাউনেত্তোন গাউত আরাম।
বাচ্চাটা খুব বেশি দুষ্ট।হুনা ইগু যে উসলা।
পেটে প্রচণ্ড ক্ষুধা লেগেছে।পেটর মাঝে যে বুক করের।
হ্যাঁ যাবো জিওয় যাইমু।
ভালো করে খানভালা করি খাউক্কা।

সিলেটি ভাষার ধর্মীয় বৈচিত্র্য

সিলেটের ভাষায় কথোপকথনে ক্ষেত্রে ধর্মীয় ঐতিহ্য প্রভাব ফেলে। এই ভাষার কিছু শব্দে উচ্চারণ ও অভিবাদন জানানোর ক্ষেত্রে মুসলিম, হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মীয় শাস্ত্র অনুসারে ভিন্নতা দেখা যায়। যেমন: সিলেটের ভাষা ব্যবহারকারী মুসলিমরা অধিকাংশ সময়ই ফার্সি ও আরবি ভাষা থেকে উদ্ভূত ঋণ-শব্দ ব্যবহার করেন। অন্যদিকে, হিন্দু ধর্মীয় ভাষাভাষীরা অধিকাংশ সময়ই সংস্কৃত থেকে উদ্ভূত ঋণ শব্দ ব্যবহার করেন। এভাবে অন্যান্য ধর্মীয় শাস্ত্রও বিশেষ প্রভাব ফেলে।

সিলেটি ভাষায় প্রবাদ-প্রবচন

বিভিন্ন অঞ্চলের প্রবীণ নাগরিকরা বিভিন্ন সময় তাদের অভিজ্ঞতাজনিত জ্ঞানকে প্রবাদ-প্রবচনে মাধ্যমে ব্যাঙ্গার্থে প্রকাশ করে। প্রবাদ-প্রবচন ব্যঙ্গ করে প্রকাশ করা হলেও এর মধ্যে শিক্ষনীয় বিষয় থাকে অনেক। সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় শত শত প্রবাদ-প্রবচন রয়েছে। তন্মধ্যে কয়েকটি হলোঃ

(১) মাতিলে মাতরা আর না মাতিলে আবরা।

অর্থঃ কথা বললে বাঁচাল, আবার না বললে বোবা (ভাবা হয়)।

(২) ইজ্জত যায় না ধুইলে, খাইসলত (বদ অভ্যাস) যায় না মইলে।

অর্থঃ কয়লা ধুইলে ময়লা যায় না (বোঝাতে)।

(৩) উদান-মাদান বাছিয়া, কাম কর নাছিয়া।

অর্থঃ সময় বুঝে সঠিক কাজ কর।

(৪) আতো বৈটা, ঘাটো নাও।

অর্থঃ শেষ বিদায়ের জন্য প্রস্তুতি মুহূর্ত।

(৫) কম আকলে তরে (পার পেয়ে যায়), বেশী আকলে মরে।

অর্থঃ অতি চালাকের গলায় দড়ি। 

সিলেটি ভাষা শিক্ষা বই

বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় একটি আঞ্চলিক ভাষা হলো সিলেটের ভাষা। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা সিলেটের পর্যটন কেন্দ্রে গিয়ে অনেকেই সিলেটি-নাগরী ভাষার সাথে পরিচিত হয়। সিলেটে বসবাসকারী বাঙালি ও অন্যান্য উপজাতিদের জীবন ব্যবস্থার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে অনেকেই এই ভাষা শিখতে চায়। 

বর্তমানে সিলেটের ভাষা শিক্ষা, সিলেটি ভাষা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য প্রচার, নাগরী লিপির ইতিহাস, সিলেটি ভাষার শব্দভান্ডার/ অভিধান সম্পর্কিত বেশ কয়েকটি আকর্ষণীয় বই পাবলিশ করা হয়েছে। সিলেটের ভাষা শিক্ষার বিখ্যাত কয়েকটি বই হলোঃ

(১) ‘সিলেটের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান’। বইটির রচয়িতা: আহমেদ আমিন চৌধুরী।

(২) ‘সিলেটের উপভাষাঃ ব্যাকরণ ও অভিধান’। বইটির রচয়িতা: ড. শ্যামল কান্তি দত্ত। এটি ‘আগামী প্রকাশনী’ কর্তৃক পাবলিশ করা হয়েছে।

(৩) ‘সিলেটি নাগরী লিপির সহজপাঠ’। বইটির রচয়িতা: মোস্তফা সেলিম।

(৪) ‘সিলেটি নাগরী লিপি বর্ণ পরিচয’। বইটির রচয়িতা: মোস্তফা সেলিম।

(৫) ‘সিলেটি নাগরী: ফকিরি ধারার ফসল’। বইটির রচয়িতা: মোহাম্মদ সাদিক।

এই বইগুলো শহরের বিভিন্ন বড় লাইব্রেরী কিংবা অনলাইনে ই-কমার্স সাইট থেকে সংগ্রহ করতে পারবেন।

সিলেট অঞ্চলের উপজাতিদের ভাষা

বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলে বিভিন্ন উপজাতিদের বসবাস অনেক বেশি। ১৯৯৫ সালে সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজারে সমন্বয়ে সিলেট বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে ১৯৯৫ সালের মধ্যবর্তী সময়ে সিলেট অঞ্চলে বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সংখ্যা বহুগুনে বৃদ্ধি পেয়েছে। তাছাড়া ভারতের নিকটস্থ অঞ্চল হওয়ায় এখানে বিভিন্ন উপজাতির আগমন ঘটেছে ক্রমান্বয়ে। এসকল উপজাতিরা তাদের নিজস্ব ভাষায় কথা বলে। 

বর্তমানে সিলেট অঞ্চলে সাঁওতাল, মণিপুরী, ওঁরাও, গারো, মুন্ডা, ভূমিজ ইত্যাদি উপজাতির বসবাস রয়েছে। সিলেটি ভাষা ছাড়া উপজাতিদের অন্যান্য ভাষা সমূহের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি নিচে তুলে ধরা হলোঃ

(১) সাঁওতালি ভাষা

সিলেট অঞ্চলে বসবাসকারী সাঁওতাল উপজাতিরা সাঁওতালি ভাষায় কথা বলে। এই ভাষাটি অস্ট্রো-এশীয় ভাষাগোষ্ঠীর প্রাচ্য শাখার অন্তভুর্ক্ত। ধারণা করা হয়, প্রায় ১০ হাজার বছর পূর্বে অস্ট্রেলিয়ার অস্ট্রো-এশীয় জনগোষ্ঠী ইন্দোনেশিয়া হয়ে ব্রহ্মদেশ ও আসামের মধ্য দিয়ে ভারত উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। তাদের সাথে ছড়িয়ে পড়ে সাঁওতালি ভাষাও। বর্তমান সময়ে পশ্চিমবঙ্গের বিহারের সাঁওতাল পরগনায় সাঁওতালি ভাষা ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ১ কোটি। ভারতের সীমান্তবর্তী অঞ্চল হওয়ায় সিলেটেও সাঁওতাল উপজাতি ও সাঁওতালি ভাষা ছড়িয়ে রয়েছে। 

(২) ওঁরাও ভাষা

ওঁরাও বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীদের মধ্যে অন্যতম। এই উপজাতিদের নিজস্ব ভাষাও রয়েছে, যা ওঁরাও ভাষা নামে পরিচিত। বর্তমানে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল ও সিলেটের চা-বাগান এলাকায় প্রায় লক্ষাধিক লোকের মাতৃভাষা ওঁরাও। তবে ওঁরাও ভাষা কুরুখ নামেই বেশি পরিচিত। ওঁরাও ভাষার কোন লিখিত রূপ নেই। তবে সিলেটি ভাষার মতোই ওঁরাও ভাষা অসংখ্য রূপকথা, উপকথা, প্রবাদ-প্রবচন, ধাঁধা, গীত, ছড়া ইত্যাদি লোকসাহিত্যে সমৃদ্ধ।

(৩) মণিপুরী ভাষা

মণিপুরী ভাষা প্রায় ৩,৫০০ বছরের প্রাচীন ভাষা। এটি প্রাচীন মঙ্গোলীয় ভাষা পরিবারের তিব্বতি-বর্মী শাখার কুকি-চীন গোষ্ঠীভুক্ত ভাষা। উনিশ শতকের পূর্ব পর্যন্ত মৈতৈ জাতির নামানুসারে এই ভাষাকে মৈতৈ নামে চিহ্নিত করা হতো। পরবর্তীতে এটি মণিপুরী ভাষা নামে স্বীকৃতি পায়। এই ভাষার নিজস্ব বর্ণমালা রয়েছে। মৈতৈ ভাষার বর্ণমালা ছিল ১৮টি বর্ণের, যা পরবর্তীতে সংস্কার করে আরো বর্ণ সংযোজন করা হয়েছে। 

(৪) গারো ভাষা

উপজাতিদের মধ্যে বাংলাদেশে গারো সম্প্রদায়ের বসবাস সবচেয়ে বেশি। তাদের নিজস্ব ভাষা রয়েছে, যা গারো ভাষা নামে পরিচিত। এটি একটি অনক্ষর ও অলিখিত প্রাচীন অনার্য ভাষা। গারো ভাষা প্রধানত চীনা-তিব্বতী ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। চীনা ভাষার সাথে গারো ভাষার শব্দ, বাক্য, ব্যাকরণ ও ভাষাগত বহু মিল রয়েছে। সিলেট অঞ্চলে বসবাসরত গারো উপজাতিদের ভাষাটি উপকথা, কিংবদন্তি, গান, পালা গান, ছড়া, শ্লোক ও প্রবাদ-প্রবচনে সমৃদ্ধ।

(৫) খাসিয়া ভাষা 

সিলেট বিভাগের বিভিন্ন জেলায় এবং পার্বত্য অরণ্যাঞ্চলে খাসিয়া উপজাতির বসবাস রয়েছে। সিলেটি ভাষার বিপরীতে, তাদের প্রধান মাতৃভাষা হলো খাসিয়া ভাষা। এটি অস্ট্রো-এশীয় ভাষা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। এই ভাষার কয়েকটি ভাগ রয়েছে। যা প্রধানত পাড়, লিংগাম ও ওয়ার নামে পরিচিত। খাসিয়া-জৈন্তিয়া পাহাড়ের পূর্বাংশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে প্রচলিত ভাষাই পাড়। গারো পাহাড়ের নিকটস্থ অঞ্চলের ভাষা লিংগাম নামে পরিচিত। অন্যদিকে, ওয়ার হলো উপত্যকা অঞ্চলের ভাষা।

(৬) মুন্ডারী ভাষা

বাংলাদেশের মুন্ডা উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর ভাষাকে মুন্ডারী ভাষা বলা হয়। এই ভাষাটি অস্ট্রো-এশীয় ভাষা পরিবারের অন্তঃর্গত। বাংলাদেশসহ ভারত ও নেপালের মুন্ডা উপজাতিরা এই ভাষায় কথা বলে। এই ভাষার হাসাদা, নাগুরি, তামারিয়া, কেরা নামে কয়েকটি উপভাষাও রয়েছে। জনৈক রোহিদাস সিং নাগ – এই মুন্ডারী ভাষা লেখার জন্য মুন্ডারী বানী লিপির উদ্ভাবণ করেছিলেন। একই অস্ট্রো-এশীয় ভাষা পরিবারের হওয়ায় মুন্ডারী ভাষা এবং সাঁওতালি ভাষার মধ্যে ব্যাপক মিল লক্ষ্য করা যায়।

(৭) ভূমিজ ভাষা 

ভূমিজ সম্প্রদায় বাংলাদেশের বসবাসরত উপজাতিদের মধ্যে অন্যতম। এদের নিজস্ব ভাষাকে ভূমিজ ভাষা বলা হয়। মূলত ভূমিজ ভাষা অস্ট্রো-এশীয় ভাষার মুন্ডা উপপরিবারের অন্তর্ভুক্ত। এই ভাষাটি সাঁওতালি, মুন্ডারী এবং হো ভাষার সাথে সম্পৃক্ত। এই সম্প্রদায়ের মূল বসবাস ভারতের উড়িষ্যা, ঝাড়খন্ড ও পশ্চিমবঙ্গে। নিকটস্থ অঞ্চল হওয়ায় সিলেটেও ভূমিজ উপজাতির বসবাস লক্ষণীয়। 

সিলেটি ভাষার মতোই পূর্বে ভূমিজ ভাষাও একটি মৌখিক ভাষা ছিল। ১৯৮১-১৯৯২ সালের মধ্যবর্তী সময়ে ওল গুরু মহেন্দ্র নাথ সরদার কর্তৃক ওল ওনাল লিপির বিকাশ হয়, যা ভূমিজ ভাষার বর্ণমালা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তবে ভূমিজ সম্প্রদায়ের বহু মানুষ তাদের লিখন পদ্ধতি হিসেবে বাংলা, উড়িষ্যা বা দেবনাগরী লিপি ব্যবহার করেন।

(৮) তুরিয়া ভাষা

ব্রিটিশ শাসনামলে বাংলায় রেলপথ স্থাপনের জন্য তুরি জাতির কর্মীদের এদেশে আনা হয়েছিল। বর্তমানেও বাংলাদেশের জয়পুরহাট সহ দেশের উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় তুরি উপজাতি বসবাস করে। তবে সিলেটেও তাদের বসবাস লক্ষণীয়। তুরি সম্প্রদায়ভুক্তরা তাদের নিজস্ব তুরিয়া ভাষায় কথা বলেন। তুরিয়া ভাষায় হিন্দি, বাংলা ও নাগরী ভাষার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। এই ভাষার নিজস্ব কোন বর্ণমালা নেই। 

শেষকথা

বাংলাদেশের নিজস্ব অঞ্চলে গড়ে ওঠা ভাষা হিসেবে সিলেটি ভাষার মর্যাদা অনেক বেশি। পৃথিবীর বুকে সেরা ১০০ টি ভাষার মধ্যে নিজের স্থান দখল করে এটি বাংলাদেশকে পৃথিবীর বুকে পরিচিত করেছে। সিলেট অঞ্চলে বসবাসকারীদের কাছে এই ভাষা যেন মধু মিশ্রিত। তবে বর্তমানে সিলেটি নাগরী লিপি প্রায় বিলুপ্ত। অন্যদিকে, আধুনিকতার টানাপোড়ানে দিন দিন ব্যবহার কমছে এই ভাষার মৌখিক রূপেরও। এভাবেই কালের বিবর্তনে হারিয়ে যেতে থাকে বহু আঞ্চলিক ভাষা।

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *