অসমীয়া ভাষার ইতিহাস সম্পর্কিত সকল অজানা তথ্য 

অসমীয়া ভাষার ইতিহাস সম্পর্কিত সকল অজানা তথ্য

প্রাচীন ভাষাগুলির মাঝে অসমীয়া ভাষা বেশ গুরুত্বপূর্ণ এবং বহুল ব্যবহৃত একটি ভাষা। প্রায় দেড় কোটি মানুষের মাতৃভাষা হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসা এই অসমীয়া ভাষার ইতিহাস সম্পর্কে যারা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য খুঁজে বেড়াচ্ছেন, আমাদের আজকের এই আর্টিকেলটি তাদের জন্যই। সম্পূর্ণ তথ্য একসাথে পেতে আমাদের সাথেই থাকুন।

অসমীয়া ভাষার ইতিহাস 

এবার আমি সরাসরি অসমীয়া ভাষার ইতিহাসের ব্যাপারে। আর্টিকেলের শুরুতেই হয়তো বুঝতে পেরেছেন এটি একটি বেশ পুরোনো ভাষা। যার সাথে বাংলা ভাষার সংযোগ থাকার ব্যাপারটি মোটেও অবাক করার মতো কিছু নয়। সুতরাং একজন বাংলাভাষী হিসেবে আপনার-আমার সকলেরই অসমীয়া ভাষার ইতিহাস ঠিক কেমন সে-সম্পর্কে ধারণা রাখা উচিত। চলুন জেনে নেওয়া যাক বিস্তারিত এবং একইসাথে অজানা সকল তথ্য! 

শুরুতে এই অসমীয়া ভাষার ইতিহাস সম্পর্কিত সাম্প্রতিক একটি ব্যাপার শেয়ার করা যাক। সম্প্রতি আসামের কামরুপ মেট্রোপলিটন জেলার ধুপগুড়ি পাহাড়ে একটি শিলালিপি পাওয়া গেছে। নির্ভরযোগ্য সংবাদ মিডিয়া বিশেষ করে ইতিহাস সেক্টরে কাজ করা মিডিয়াগুলি বলছে এই শিলালিপি থেকে বিশেষ করে ব্রাহ্মী লিপির বর্ণমালা পাওয়া গেছে। মজার ব্যাপার হলো শিলালিপিটিতে মোট ১০ টির মতো অসমীয়া বর্ণমালা স্পষ্টভাবে পাওয়া গেছে। 

যদিও পুরো শিলালিপিটির বিষয়টি নিয়ে ভাষাবিদগণ গবেষণা চালাচ্ছেন। তবুও তাদের প্রাথমিক ধারণা হিসেবে শিলালিপিতে থাকা সেই ১০ বর্ণমালাকে প্রায় ২,৪০০ বছরের পুরোনো বর্ণমালা হিসেবে ধরে নেওয়া হচ্ছে। যা অনেক বেশি পুরোনো এবং এর বর্তমান বয়সের সাথে অসমীয়া ভাষার ইতিহাসের ব্যাপারটি পুরোপুরিভাবে খাপ খেয়ে যাচ্ছে। 

এখানে বলে রাখা ভালো ভাষা নিয়ে গবেষণা করা গবেষকরা অসমীয়া ভাষার দশটি বর্ণমালা হিসেবে এ, ব, ম, উ, ঋ, ৱ, য়, ই, এবং জ শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। এছাড়াও তাদের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার আলোকে ধরে নেওয়া হচ্ছে লিপিটি খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীর দিকে তৈরিকৃত একটি লিপি। 

সংশ্লিষ্টজনেরা বলছেন লিপিটিতে থাকা বর্ণগুলিই একটা সময়ে গিয়ে প্রমাণ করবে এই অসমীয়া ভাষা অন্যান্য লিপি থেকে উদ্ভূত হয়নি। বরং এটি একটি স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে নিজস্ব বৈশিষ্ট্যকে কেন্দ্র করেই সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়াও অনেকেই ভাবছেন সম্রাট অশোকের সময়ে ব্যবহৃত লিপিগুলির ভিত্তি হতে পারে এই অসমীয়া ভাষার ইতিহাস। 

তবে আরেক দল ভাষাবিদ কিন্তু আজো ঠিকই বিশ্বাস করেন যে পূর্ব ভারতীয় মাগধী প্রাকৃত ভাষা থেকে অসমীয়া ভাষার উৎপত্তি হয়েছে। ভাষাটি প্রথম সৃষ্টি হয় অসম নামের একটি অঞ্চল থেকে। যা শুরুতে সংলাপ বৈভাষিক হিসেবে ব্যবহার করার জন্যই সৃষ্টি করা হয়।

অসমীয়া ভাষার উৎপত্তির ধরণ

এবার আসি অসমীয়া ভাষার ইতিহাস সম্পর্কিত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট অর্থ্যাৎ অসমীয়া ভাষার ভাষা-পরিবার কিংবা উৎপত্তির ধরণ সম্পর্কে। মূলত অসমীয়া ভাষার আদি উৎস ছিলো ইন্দো-ইয়োরোপীয় ভাষা। অর্থ্যাৎ এই অসমীয়া ভাষাটি একটি ইন্দো-ইয়োরোপীয় ভাষা-পরিবারের সদস্য। তবে রূপকের দিক দিয়ে একটি কিন্তু সরসরি ইন্দো-ইয়োরোপীয় ভাষার সন্তান (ভাষা) নয়। 

ইন্দো-ইয়োরোপীয় ভাষার পর এসেছে ইন্দো-ইরানীয় ভাষা। আবার ইন্দো ইরানীয় ভাষা থেকে সৃষ্টি হয়েছে ইন্দো-আর্য ভাষা। ইন্দো আর্য ভাষা সৃষ্টি করেছে পূর্ব ইন্দো-আর্য ভাষা। এরপর এসেছে প্রাথমিকভাবে বাংলা অসমীয়া ভাষা এবং সবশেষে এই বাংলা অসমীয়া ভাষা থেকে এসেছে আজকের আলোচিত এই অসমীয়া ভাষা। আশা করি অসমীয়া ভাষার ইতিহাস বিশেষ করে এটি কিভাবে এবং ঠিক কোন কোন ভাষা থেকে সৃষ্টি হয়েছে সে-সম্পর্কে বুঝতে পেরেছেন! 

অসমীয়া ভাষার সাহিত্য

এবার আসি অসমীয়া ভাষার ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম অসমীয়া ভাষার সাহিত্যের ব্যাপারে। মজার ব্যাপার হলো অসমীয়া এমন একটি প্রাচীন ভাষা যে ভাষা নিয়ে খুব একটা সাহিত্যচর্চা হয়নি। যার কারণেই ভাষাটির ইতিহাস নিয়ে এতো বিভ্রান্তি। সেই সাথে গবেষণার ক্ষেত্রে প্রমাণাদি কিংবা নথিপত্র নিয়ে চরম জটিলতা তো রয়েছেই! 

বিভিন্ন ভাষা নিয়ে যদি আপনি গবেষণা করে থাকেন সেক্ষেত্রে নিশ্চয় আপনি জানেন, আধুনিক ভারতীয় ভাষাগুলির উপর বেশ ক’বার বৈজ্ঞানিক গবেষণা চালানো হয়েছে। এক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে অসমীয়া ভাষার উপর সম্পাদিত বিভিন্ন গ্রন্থ। সেদিক দিয়ে অসমীয়া ভাষার উপর সাহিত্যচর্চার ব্যাপারটি কিছুটা আগানোর সুযোগ পেয়েছে। 

সে-সময় আধুনিক ইন্দো-আর্য ভাষার উপর একটি গবেষণাভিত্তিক গ্রন্থ সম্পাদিত হয়। বইটির নাম ছিলো “লা ফর্মাসিওঁ দি লা লং মারাথ”। বইটি ১৯২০ সালের দিকে প্রকাশিত হয়েছিলো এবং এই বইটি সেসময় লিখেছিলেন বিখ্যাত লেখক এবং ফরাসি ভাষাবিজ্ঞানী জুল ব্লখ নিজেই। যেহেতু এটি একটি ইন্দো-আর্য ভাষার উপরে লেখা বই, সেহেতু বইটিতে অসমীয়া ভাষার উপর কিছু গবেষণাভিত্তিক অংশবিশেষ লেখা ছিলো। বইটিতে লেখক ইন্দো-আর্য ভাষা পরিবারের সকল ভাষা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়েই মূলত অসমীয়া ভাষার ব্যাপারে লিখেছিলেন। 

অসমীয়া ভাষা যখন কিছুটা প্রাচীন হয়ে আসলো এবং প্রয়োজনেন তাগিদেই যখন ভাষাটি গিয়ে গবেষণা শুরু হলো ঠিক তখনই নাথান ব্রাউন নামের একজন ভাষাবিদ বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলেন। অনেকের মতে এই ভাষাবিদ নাথান ব্রাউন অসমীয়াকে বাংলা অপেক্ষা একটি স্বতন্ত্র ভাষা হিসেবে পরিচয় করানোর ক্ষেত্রে আগ্রহী হয়ে উঠুন। যদিও পুরো ব্যাপারটিকেই কেবল ধারণার অংশবিশেষ হিসেবে বিবেচিত করা হয়। 

এছাড়াও মাত্র ক’বছর আগেই ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রকাশ করেন একটি গবেষণাধর্মী বই। যা সম্পাদিত হয়েছে বাংলা ভাষার উপর, এই ভাষার আদি অবস্থার উপর এবং কোন কোন ভাষা থেকে বাংলা ভাষা সৃষ্টি হয়েছে সে’সব সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্যের উপর। তার এই মহাগ্রন্থটির নাম দিয়েছেন দি অরিজিন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অভ দ্য বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ। বইটিতেও অসমীয়া ভাষার ইতিহাস সম্পর্কে গবেষণাধর্মী আলোচনা তুলে ধরা হয়েছে। যা পড়তে পারলে কিন্তু অসমীয়া ভাষার গোড়ার খবর জানা যাবে!

অসমীয়া ভাষার বৈশিষ্ট্যগুলি কি কি? 

আর্টিকেলের এই অংশে আমরা জানবো অসমীয়া ভাষার এমনকিছু বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে, যা এই ভাষাটিকে অসংখ্য ভাষার মাঝে চিনতে সাহায্য করবে। 

  • অসমীয়া ভাষা যে লিপিতে লেখা হয় সে লিপির নাম হলো পূর্ব নাগরী লিপি
  • সাধারণত আজকের দিনের প্রমিত বানানের শব্দগুলিই অসমীয়া ভাষার নতুন সংস্করণ 
  • অন্যান্য ইন্দো-আর্য ভাষাসমূহ এর ব্যাকরণের সাথে অসমীয়া ভাষার ব্যাকরণের প্রচুর মিল পাওয়া যাবে 
  • অসমীয়া ভাষার ক্ষেত্রে মূলত ধাতুর সাথে অন্ত্যপ্রত্যয় জোড়া লাগিয়ে নতুন নতুন শব্দ গঠন করা হয়

অসমীয়া ভাষার ব্যবহার কি কি? 

আসামে সাধারণত অসমীয়া ভাষাকে বেশ গুরুত্বের সাথে ব্যবহার করা হয়। ভারতের গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ভাষা হিসাবে এই ভাষাটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। অাসাম প্রদেশে এই ভাষাটিকে সর্বস্তরে ব্যবহৃত একটি লিখিত ভাষা হিসাবে ব্যবহৃত করে থাকে। শিক্ষা, মিডিয়া এবং অন্যান্য দাপ্তরিক উদ্দেশ্যেও ব্যবহৃত হয় এই ভাষা। 

অসমীয়া ভাষার বর্তমান পরিস্থিতি কেমন? 

অসমীয়া ভাষার ইতিহাস সম্পর্কে জানলেন! এবার চলুন এই জনপ্রিয় ভাষাটির বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক। বর্তমানে এই অসমীয়া ভাষা অসম সাহিত্য সভা কিংবা আসামের সাহিত্য বা অলঙ্কৃত মহাসভার অন্তর্ভুক্ত একটি ভাষা হিসাবে কাজ করছে। আমাদের দেশে বাংলা ভাষার রক্ষণাবেক্ষণ কিংবা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে যেমন বাংলা একাডেমী কাজ করছে, অসমীয়া ভাষার ক্ষেত্রেও ঠিক তেমনই কাজ করছে এই অাসাম সাহিত্য সভা। 

অসমীয়া ভাষার গুরুত্ব কি কি? 

অসমীয়া ভাষার ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পেরে নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন এই ভাষাটুকুর গুরুত্ব কতটা! আজো ভাষাটিকে নিয়ে চলছে গবেষণা! খোঁজা হচ্ছে বিভিন্ন নথিপত্র। তাছাড়া বাংলা ভাষার বয়োজ্যেষ্ঠ ভাষা হিসাবে অসমীয়া ভাষা কিন্তু হেলাফেলা করবার মতো ভাষা নয়! 

ইতি কথা

যেহেতু অন্যান্য ইন্দো-আর্য ভাষাসমূহ এর ব্যাকরণের সাথে অসমীয়া ভাষার ব্যাকরণের মিল রয়েছে সেহেতু বাংলাভাষী হিসাবে আমাদের উচিত অসমীয়া ভাষার ইতিহাস সম্পর্কে জেনে রাখা। নিজেদের সংস্কৃতির প্রতি দায়িত্ববোধ থেকেই জেগে উঠুক প্রাক-প্রাথমিক ভাষার ইতিহাস সম্পর্কে জানার এই আগ্রহটুকু। এমনটা আশা রেখে আজকের মতো বিদায় নিচ্ছি। ভালো থাকুন! ভাষা এবং ভাষাতত্ত্বের সাথেই থাকুন।

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *