কোরিয়ান ভাষার ইতিহাস: কোরিয়ান ভাষা ও বর্ণমালার পুরোনো ইতিহাস 

কোরিয়ান ভাষার ইতিহাস

বর্তমানে ইংরেজি, আরবি কিংবা অন্যান্য জনপ্রিয় ভাষার তালিকায় কোরিয়ান ভাষাকেও অন্তর্ভুক্ত করলে নেহায়েত ভুল হবে না। কারণ এই ভাষার প্রতিও আজকাল অনেকেই আগ্রহী হয়ে উঠছে। আর এই আগ্রহকে কাজে লাগিয়ে নতুন এই ভাষা শিখতে পারাটা নিশ্চয় মন্দ হবে না! তবে তার পূর্বে চলুন জেনে নেওয়া যাক কোরিয়ান ভাষার ইতিহাস সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য এবং গুরুত্বপূর্ণ টিপস। যা হয়তো কোরিয়ান ভাষা শেখার পূর্বে আপনার জেনে রাখা প্রয়োজন। 

কোরিয়ান ভাষার পরিচিতি

কোরিয়ান ভাষা হলো মূলত উত্তর কোরিয়ার সরকারী ভাষা এবং দক্ষিণ কোরিয়ার সহকারী ভাষা। তবে এই ভাষার গুরুত্বকে পুরোপুরি এড়িয়ে চলাটাও বোকামি হবে। কেনো বলছি? কারণ বর্তমানে সারা পৃথিবীতে প্রায় ৭৫ মিলিয়নের মতো কোরিয়ানভাষী রয়েছে। এক্ষেত্রে এসব কোরিয়ানভাষীর এক দল হয়তো প্রধান ভাষা হিসাবে কোরিয়ান ভাষা ব্যবহার করে থাকে৷ অন্যদিকে বাদবাকি সকলেই এই ভাষাকে সহায়ক ভাষা হিসাবে ব্যবহার করে থাকে। একটি রিসার্চ অনুযায়ী প্রায় ৪৮ মিলিয়ন কোরিয়ানভাষী এই ভাষাকে প্রধান ভাষা হিসাবে ব্যবহার করে থাকে৷ বাকি ভাষাভাষীদের অধিকাংশই চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং জাপানে বসবাস করে। যাইহোক! সর্বাধিক ব্যবহৃত ভাষা হিসাবে কোরিয়ান ভাষাকে তালিকার ১৬ নাম্বারে রাখা হয়েছে। 

বলা হয়ে থাকে এখনো পর্যন্ত যে’কটি পুরোনো ভাষা পৃথিবীতে টিকে আছে কোরিয়ান ভাষা সে’কটির ভাষার মাঝে জীবিত থাকা অন্যতম একটি ভাষা। অনেক বেশি পুরোনো দিনে ভাষা হওয়ায় এই ভাষার ইতিহাস সম্পর্কে রিসার্চ করতে গিয়ে মারাত্মক সমস্যায় পড়েছেন গবেষকেরা৷ কারণ এর গোড়া ধরাটা কঠিন হয়ে পড়েছে। তবে আমরা আমাদের আজকের এই কোরিয়ান ভাষার ইতিহাস সম্পর্কিত আর্টিকেলে ভাষাটির ইতিহাস নিয়ে আপডেটেড এবং নির্বাচিত ও পরীক্ষিত তথ্য শেয়ার করার চেষ্টা করবো। সুতরাং সাথেই থাকুন৷ 

কোরিয়ান ভাষার ইতিহাস

শুরুতেই বলেছি কোরিয়ান ভাষার ইতিহাস বিশেষ করে এর শুরুর সময়টা ঠিকভাবে বলা বেশ কঠিন ব্যাপার৷ কারণ এই ভাষার বয়স নেহায়েত কম নয়। বরং অনেক বেশি। তবুও আমাদের এই আর্টিকেলের সাহায্যে কোরিয়ান শব্দ এবং শব্দগুচ্ছের উৎপত্তি সম্পর্কিত তথ্য শেয়ার করবো। সেই সাথে শেয়ার করবো কোরিয়ান লিখন পদ্ধতির বিকাশ এবং উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার ভাষার উপর কোরিয়ান যুদ্ধের প্রভাব। যেহেতু কোরিয়ান ভাষার ইতিহাস দীর্ঘ এবং আকর্ষণীয় সেহেতু আশা করি পুরো আর্টিকেলটি উপভোগ করবেন। সুতরাং আমাদের সাথেই থাকুন। 

কোরিয়ান ভাষার উৎপত্তি ও শিকড়

মজার ভাষায় বলা যায় কোরিয়ান ভাষা পৃথিবীর প্রাচীনতম জীবিত ভাষাগুলির মধ্যে একটি। এই ভাষা এতোটাই প্রাচীন যে কোরিয়ান ইতিহাসের উৎপত্তিস্থল থেকে এই ভাষার ইতিহাস সঠিকভাবে খুঁজে বের করা কঠিন। অনেক ভাষাবিদ বিশ্বাস করেন যে এটি উত্তর এশিয়া থেকে উদ্ভূত ভাষার আলতাইক পরিবারের অন্তর্গত একটি ভাষা। আবার অনেকেই মনে করেন কোরিয়ান ভাষা ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত জেজু ভাষার সাথে।  অর্থ্যাৎ এই দলের ভাষাবিদদের মতে কোরিয়ান ভাষা জেজু ভাষার নিজস্ব ভাষা পরিবারের অন্তর্গত একটি ভাষা।

কোরিয়ান ভাষা এবং জাপানিজ ভাষার সাদৃশ্যকরণ 

কোরিয়ান ভাষার ইতিহাস সম্পর্কে যারা রিসার্চ করেন তারা একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং ইন্টারেস্টিং তত্ত্ব মাথা রাখেন। এটি মূলত এমন যে, কোরিয়ানেরা জাপানিদের সাথে সম্পর্কিত একটি জাতি। যার ফলে কোরিয়ান ভাষার সাথে জাপানিজ ভাষার প্রচুর মিল রয়েছে। শুধু তাই নয়! অনেক ভাষাবিদদের মতে নিঃসন্দেহে ব্যাকরণগত কাঠামোর দিক দিয়ে জাপানিজ ভাষা এবং কোরিয়ান ভাষা একই। তবে এখনো পর্যন্ত ভাষাবিদরা এই দুটি ভাষার মধ্যে কোনো ঐতিহাসিক সংযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হননি।

কোরিয়ান ভাষা এবং চাইনিজ ভাষার সাদৃশ্যকরণ 

অন্যদিকে অনেক ভাষাবিদের মতে, কোরিয়ান ভাষাকে চাইনিজ ভাষার বোনও বলা যেতে পারে। একটু লক্ষ্য করলে দেখবেন কোরিয়ান ভাষার সাথে চাইনিজ ভাষার উচ্চারণগত মিল রয়েছে। এমনকি দুটোই ভাষার লেখ্যরূপ দেখলে মোটামোটি একই মনে হবে। বিশেষ করে যারা পূর্ব হতে চাইনিজ এবং কোরিয়ান ভাষার সাথে পরিচিত নয়, তাদের কাছে প্রথম দেখাতেই দু’টো ভাষাকে একই মনে হবে। 

তবে বলা হয়ে থাকে বর্তমানে কোরিয়ান শব্দভান্ডারের প্রায় অর্ধেকই চীনা শব্দের রূপ। এমনকি এখনো পর্যন্ত দক্ষিণ কোরিয়ানরা কখনো কখনো চাইনিজ ভাষায় চীনা উৎসসহ বিভিন্ন শব্দ লিখতে পছন্দ করে থাকে। তবে এ-কথা সত্য যে কোরিয়ান ভাষা উচ্চারণগতভাবে চাইনিজ ভাষা থেকে অনন্য এবং শ্রুতিমধুর। ভাষাবিদদের মতে যেহেতু দুটি ভাষা পারস্পরিকভাবে বোধগম্য নয়, তাই দুটি ভাষার মধ্যে এখনও একটি বড় পার্থক্য রয়ে গেছে। 

কোরিয়ান ভাষা উৎপত্তির সময় 

কোরিয়ান ভাষাকে বিশ্বের সবচেয়ে ভুল করবার মতো ভাষা বলা হয়ে থাকে। কারণ এর ইতিহাস নিয়ে ভাষাবিদদের মাঝে ঘটা দ্বন্দ্ব এবং তথ্য অন্যান্য ব্যাক্তিদের মাঝে যথেষ্ট বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে থাকে। 

বলা হয়ে থাকে সাধারণত ষষ্ঠ থেকে চতুর্দশ শতাব্দীর মাঝে কোরিয়ান ভাষার উৎপত্তি ঘটে। প্রাচীনকালে কোরিয়ান উপদ্বীপে বসবাসকারী বিভিন্ন গোষ্ঠী মিলে সঠিকভাবে যোগাযোগের উদ্দেশ্যে একটি নতুন ভাষার প্রয়োজনীয়তাবোধ করে এবং তা সৃষ্টিও করে। একই সময়ে এই ভাষা কিন্তু কোরিয়ার সমজাতীয় ব্যাক্তিদের এক হতে সাহায্য করেছিলো। আরো কোরিয়ান ভাষা সুস্থভাবে বেড়ে উঠতে থাকে ১৫ শতকের শেষের দিকের সময় থেকে। 

কোরিয়ান ভাষার লিখন পদ্ধতির ইতিহাস

এবার আসি কোরিয়ান ভাষার লিখনপদ্ধতির ইতিহাসের ব্যাপারে। কোরিয়ান লিখনপদ্ধতিকে মূলত হাঙ্গুল বলে। এই হাঙ্গুলের সৃষ্টি এবং তার ব্যবহার শুরু হয় ১৪৪৩ সাল থেকে। আর এই কোরিয়ান ভাষার লিখনপদ্ধতির পেছনে যার অবদান সবচেয়ে বেশি তিনি হলেন ইই রাজবংশের রাজা সেজং। 

ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায় কোরিয়ান ভাষার হাঙ্গুলের বিকাশের আগে অনেক কোরিয়ান লিপি চীনা অক্ষরগুলির একটি জটিল পদ্ধতি ব্যবহার করেছিল। কারণ সে-সময় ভালোভাবে যোগাযোগ করার জন্যে কোনো একটি লিখনপদ্ধতির অনেক বেশি প্রয়োজনীয়তাবোধ করেছিলেন কোরিয়ানেরা। 

তবে যেসব চীনা অক্ষরকে কোরিয়ানেরা কোরিয়ান ভাষার লিখনপদ্ধতিতে ব্যবহার করেছিলো সে-সব অক্ষর ভালোভাবে মনের ভাব জানাতে সক্ষম হচ্ছিলো না। পাশাপাশি এতো অল্পসংখ্যক শব্দের সাহায্যে কোনোভাবেই কোরিয়ানেরা সম্পূর্ণ মনের ভাব প্রকাশ করতে পারছিলো না। সবমিলিয়ে নতুন লিখনপদ্ধতি আবিষ্কারের প্রয়োজনীয়তা মারাত্মকভাবে দেখা দেয়।

এমতাবস্থায় রাজা সেজং কোরিয়ান ভাষার লিখিত রূপের সৃষ্টির উদ্দেশ্যে একটি ধ্বনিগত স্ক্রিপ্ট বিকাশের কাজে হাত দেন এবং সেটি সম্পূর্ণরূপে সফলতা লাভ করে। যা সাধারণ মানুষের পক্ষে পড়তে এবং লিখতে যথেষ্ট সহজতর হয়ে উঠেছিলো এবং কালের পরিক্রমায় পরিণত হয়েছিলো কোরিয়ান ভাষার লিখনপদ্ধতি কিংবা হাঙ্গুলে। 

কোরিয়ান ভাষার বর্ণমালা পরিচিতি এবং ইতিহাস 

কোরিয়ান ভাষার হাঙ্গুলের ক্ষেত্রে অন্যান্য ভাষার মতো স্বরবর্ণ এবং ব্যঞ্জনবর্ণ রয়েছে। এক্ষেত্রে এই ভাষায় রয়েছে ১০ টি স্বরবর্ণ এবং ১৪ টি ব্যঞ্জনবর্ণ৷ এই ২৪ টি বর্ণের সাহায্যে কোরিয়ানভাষীরা তাদের মনের ভাব প্রকাশ করে থাকে। এই ২৪ টি ভাষার মধ্যে পাঁচটি দ্বিগুণ ব্যঞ্জনবর্ণও রয়েছে। এসব অক্ষরগুলি দুটি, তিনটি বা চারটি ক্লাস্টারে বিভক্ত করে সিলেবল এবং বাক্যাংশ তৈরি করে থাকে৷ 

হাঙ্গুলের আবির্ভাব যে কোরিয়ান সংস্কৃতির ইতিহাসে একটি মহান কৃতিত্ব ছিলো তা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। কারণ এটি বিশ্বের সর্বোচ্চ স্তরের সাক্ষরতার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম এবং প্রমাণে পরিণত হয়েছিল। কারণ সে-সময়ে পৃথিবীতে লিখিত ভাষার সংখ্যা ছিলো একেবারেই কম। 

কোরিয়ান ভাষার সাহিত্যের ইতিহাস 

শুরুতেই বলে রাখি, চীনা সাহিত্য কিন্তু কোরিয়ান লেখায় খুব প্রভাবশালী ভাষা হিসাবে রাজত্ব করেছিলো। উত্তর কোরিয়ায় চীনা আগ্রাসনের সময় এই ভাষা সাধারণত ব্যবহার করা হয়েছিলো। তা সাধারণত ৩০০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে হতে পারে। সে-সময়ের যুদ্ধের পর, কোরিয়ানরা শাস্ত্রীয় চীনা ভাষায় লিখতে শুরু করে। কোরিয়ানেরা এই সময়ে চীনা অক্ষর ব্যবহার করে তিনটি পৃথক লেখার ব্যবস্থা তৈরি করে। এগুলি হলো: 

  • হায়াংচাল
  • গুকিয়েওল
  • ইদু

তবে প্রাচীনকালে কোরিয়ান ভাষায় সাহিত্যচর্চা হলে এর কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। যদিও পুরোনো নথিপত্র এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্রে কোরিয়ান ভাষা ব্যবহারের প্রমাণ লক্ষ্য করা যায়। 

কোরিয়ান ভাষার জনপ্রিয়তা

কোরিয়ান ভাষার ব্যাপ্তি বা জনপ্রিয়তা কতটুকু বিস্তার লাভ করেছে তা জানতে আপনি চাইলে নিজের আগ্রহকেও ফোকাসে রাখতে পারেন। অর্থ্যাৎ একজন বাংলাদেশী হিসাবে এই ভাষার প্রতি আপনার আগ্রহটুকুও জানান দিচ্ছে কোরিয়ান ভাষার জনপ্রিয়তার ব্যাপ্তি ঠিক কতটুকু বেড়েছে। 

যাইহোক! দিন দিন কিন্তু দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে কোরিয়ান শিখতে ইচ্ছুক এমন ব্যাক্তির সংখ্যা বাড়ছেই। এর মূল কারণ হলো কোরিয়ায় স্কলারশিপ নিয়ে পড়াশোনার করার প্রবণতা, কে-পপ মিউজিক, জনপ্রিয় কোরিয়ান টিভি শো এবং কিছু কোরিয়ান খাবার। যা বর্তমানে কোরিয়ান ভাষাকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে সাহায্য করছে। পাশাপাশি বর্তমানে বিভিন্ন কোম্পানি কতৃক আয়োজিত কোরিয়ান শব্দ, উচ্চারণ এবং ব্যাকরণ শেখানোর কোর্সগুলিও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। 

ইতি কথা

আশা করি আজকের এই এক আর্টিকেলের সাহায্যে কোরিয়ান ভাষার ইতিহাস সম্পর্কিত সকল তথ্য শেয়ার করতে পেরেছি। তবুও যদি এ-নিয়ে আপনাদের কোনো প্রশ্ন থাকে সেক্ষেত্রে সরাসরি তা কমেন্টবক্সে জানাতে পারেন। আমাদের পরবর্তী আর্টিকেল পড়বার আমন্ত্রণ জানিয়ে আজকের মতো বিদায় নিচ্ছি। নতুন ভাষার প্রতি আপনার এই ভালোবাসা এবং আগ্রহ যেনো সবসময় বজায় থাকে, সেই কামনাই করি।

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *