ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ কে?

ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ কে?

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক বেদনাদায়ক স্মৃতি। এই আন্দোলনে ভাষার জন্য প্রাণ দিতে হয়েছে বাংলার সোনার সন্তানদের। তাদের অবদানেই পেয়েছি আমাদের আজকের প্রিয় বাংলা ভাষা। তবে বাংলা ভাষার জন্য অনেকে শহীদ হলেও ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ কে তা অনেকেরই অজানা। 

বাঙালি জাতির বাঙালিয়ানা প্রাপ্তির পেছনে সেই বীরদের ইতিহাস আমাদের মনে দেশপ্রেম ও ভাষা প্রেম জাগ্রত করে। তাই বাঙালি হিসেবে বাংলা ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ কে, ভাষা আন্দোলনে তার অবদান ও সেই ভাষা শহীদের সাধারণ পরিচয় সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য ধারণ করা হয়েছে এই পোস্টে।

বাংলা ভাষার জন্য প্রথম শহীদ হন কে?

১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনে বাংলা ভাষার জন্য প্রথম শহীদ হন রফিকউদ্দিন আহমদ। তিনি মানিকগঞ্জ জেলায় অবস্থিত দেবেন্দ্রনাথ কলেজের বাণিজ্য বিভাগের ২য় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। ভাষা আন্দোলনের অন্যান্য শহীদদের অনেকেই নিজের অজান্তে শহীদ হলেও রফিকউদ্দিন আহমদ সরাসরি বাংলাতে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে জড়িত ছিলেন। তিনি ছিলেন বীর বাঙালি, এক অসামান্য চেতনা।

২১ শে ফেব্রুয়ারির ভাষা শহীদ রফিকউদ্দিন আহমদ

২১ শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালে, যখন পাকিস্তানি সরকারের নির্দেশ- ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে বাংলার ছাত্র জনতা রাজপথে নামে তখন মিছিলে অংশগ্রহণকারী ছিলেন ভাষা শহীদ রফিকউদ্দিন আহমদ। ছাত্রদের মিছিল যখন ঢাকা মেডিকেল কলেজের সম্মুখের রাস্তায় আসে তখন ১৪৪ ধারা ভঙ্গের অভিযোগে পুলিশ আন্দোলন কারীদের উপর গুলি চালায়। 

এলোপাথাড়ি গুলিতে অনেকেই আহত হয়, তবে রফিকউদ্দিন আহমদ মাথায় গুলিবিদ্ধ হন। মাথার খুলি ছিদ্র হয়ে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তার। ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ কে তা এখানেই স্পষ্ট হয়ে যায়। মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের ১৭ নম্বর কক্ষের পূর্ব দিকে তার গুলিবিদ্ধ নিথর লাশ পড়েছিল। ছাত্রদের মধ্যে থেকে ৬-৭ জন তার লাশ এনাটমি হলের পেছনের বারান্দায় নিয়ে রাখে। 

ডাঃ মশাররফুর রহমান খান লাস্ট তুলতে গিয়ে রফিকউদ্দিনের গুলিতে ছিটকে পড়া মগজ হাতে করে নিয়ে আসেন। কতটা মর্মান্তিক ছিল সেই ঘটনা। পরবর্তীতে তার লাশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে নিয়ে যায় পুলিশ। রাত তিনটায় সামরিক বাহিনীর প্রহরা সহ তাকে সমাহিত করা হয় ঢাকার আজিমপুর কবরস্থানে।

ভাষা আন্দোলনে শহীদ রফিকউদ্দিন আহমদের অবদান

রফিকউদ্দিন আহমদ ভাষার দাবিতে একজন সক্রিয় আন্দোলনকারী ছিলেন। তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিকারী ছাত্র সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ভাষার আন্দোলনে তিনি সোচ্চার ছিলেন এবং নিজে অংশগ্রহণের পাশাপাশি অন্য ছাত্রদেরও উজ্জীবিত করেছেন বার বার। 

ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ কে তা নিয়ে কিছুটা মতভেদের সৃষ্টি হয়েছিল। কারণ, একইসময়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের বারান্দায় গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন ভাষা শহীদ আবুল বরকত। তখন আরো অনেকেই আহত হয়েছিলেন গভীরভাবে। তাদের সকলের প্রতি পাকিস্তান পুলিশের এই অবিচারকে কেন্দ্র করে সমগ্র বাঙালি জাতির মনে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে তাদের শহীদ বরন কেন্দ্র করেই পাকিস্তান সরকার বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হাওয়া থেকে বিরত রাখতে পারেনি। 

ভাষার জন্য রফিকউদ্দিন ও অন্যান্য শহীদদের অবদান কখনো ভুলার মত নয়। জীবনকে বিলিয়ে দিয়ে তারা অর্জন করেছে বাংলার সম্মান।

ভাষা শহীদ রফিকউদ্দিন আহমদের সাধারণ পরিচয়

রফিকউদ্দিন আহমদ ৩০ অক্টোবর ১৯২৬ সালে পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) মানিকগঞ্জ জেলার সিংগাইর উপজেলার পারিল বলধারা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা আব্দুল লতিফ এবং মাতা রাজিয়া খাতুন। তার দাদার নাম ছিল মোঃ মকিম। তার পরিবারে ছিলেন বাবা মা, পাঁচ ভাই ও দুই বোন। রফিকউদ্দিন আহমদ ছিলেন পরিবারের বড় সন্তান।

শিক্ষার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন যথেষ্ট মেধাবী। স্থানীয় বায়রা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৪৯ সালে মাধ্যমিক পাশ করেন রফিকউদ্দিন আহমদ। তারপর মানিকগঞ্জের দেবেন্দ্র কলেজের বাণিজ্য বিভাগে ভর্তি হন তিনি। কিন্তু পিতার দায়িত্ব সামলানোর জন্য পড়ালেখা শেষ না করে ঢাকায় এসে তার পিতার মুদ্রণশিল্প ব্যবসায় যুক্ত হতে হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ কে পরবর্তীতে আবার শিক্ষার প্রতি আগ্রহী হয়ে ঢাকার জগন্নাথ কলেজে (বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) হিসাব বিজ্ঞান বিভাগে পড়ালেখা শুরু করেন।

বিশ্ববিদ্যালয় দ্বিতীয় বর্ষে থাকা অবস্থায়ই ভাষা আন্দোলনে লিপ্ত হয়ে শহীদ হন তিনি। 

ভাষা শহীদ হিসেবে রফিকউদ্দিন আহমদের প্রাপ্তি

বাঙালি জাতির ইতিহাসের পাতায় জড়িয়ে থাকবে রফিকউদ্দিন আহমদ এর স্মৃতি। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে আত্মত্যাগের স্মৃতিচারণে ২০০০ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করেন এই ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ কে। তার গ্রামের নাম পরিবর্তন করে করা হয় রফিকনগর। ২০০৪ সালে সেই গ্রামে তার নামে প্রতিষ্ঠা করা হয়- ‘ভাষা শহীদ রফিক উদ্দিন আহমদ গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর’। অন্যদিকে, বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে, ‘ভাষা শহীদ রফিক ভবন’ নামে একটি প্রাতিষ্ঠানিক ভবনের নামকরণ করা হয়।

শেষকথা

রফিকউদ্দিন আহমদ বাঙালি জাতির চেতনা, গর্ব। কতটা মর্মান্তিক সেই ইতিহাস, যখন রফিকউদ্দিন আহমদ এর মগজ ছিটকে বেরিয়ে গিয়েছিল বাংলা ভাষার জন্য। তাই ভাষা শহীদদের এবং ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ কে স্মরণ করে প্রাণভরে শ্রদ্ধা জানানো সমগ্র বাঙালি জাতির কর্তব্য।

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *