ভাষা শহীদদের নাম, পরিচয় ও ছবি

ভাষা শহীদদের নাম, পরিচয় ও ছবি

ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতির একটি গৌরবোজ্জ্বল্য ইতিহাস। বাংলা ভাষাকে পৃথিবীর বুকে টিকিয়ে রাখার আন্দোলনকে সার্থক করে গেছেন ভাষা শহীদেরা। তাদের রক্তের বিনিময়ে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল বাংলা এবং বিশ্বর বুকে বাংলা পেয়েছে নতুন সম্মান। তবে ভাষা শহীদদের সঠিক সংখ্যা, ভাষা শহীদদের নাম, পরিচয় ও ছবি সম্পর্কে অধিকাংশ বাঙালি জানতে পারেনি আজও।

ভাষা আন্দোলনে শহীদদের অবদান যে কতটা তা আমাদের সকলেরই জানা। প্রতিবছর আমাদের মুখের বুলি বলতে পারার তৃপ্তি নিয়ে শ্রদ্ধা জানাই ভাষা শহীদদের স্মৃতি শহীদ মিনারে। এ সময় মনে বারবার ধেয়ে আসে ভাষা শহীদদের নাম, পরিচয় ও ছবি সম্পর্কে জানার কৌতুহল।

ভাষা আন্দোলনে কতজন শহীদ হয়েছিল

সর্বজন স্বীকৃত আর্জন ভাষা শহীদের নাম পরিচয় জানা যায়। তবে, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের ভাষা শহীদদের সংখ্যা ঠিক কত ছিল তা বাঙালি জাতির কাছে আজও রহস্যময় অজানা ইতিহাস। ভাষা আন্দোলনের সঠিক নিহতের সংখ্যা গোপন করা হয়েছিল সমগ্র জাতির কাছ থেকে। গুম করে ফেলা হয়েছিল অনেক লাশ। জানতে পারিনি ভাষা শহীদদের নাম, পরিচয় ও ছবি কেমন ছিল। ভাষা আন্দোলন নিয়ে রচিত বিভিন্ন সংবাদপত্রের প্রতিবেদন, কবিতা, বইয়ে শহীদদের সংখ্যা সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য হয়েছে।

১৯৫২ সালের ২৩ শে ফেব্রুয়ারি ‘সৈনিক’ পত্রিকায় ‘শহীদ ছাত্রদের তাজা রক্তে রাজধানী ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত’ প্রতিবেদনে ছাত্র আন্দোলনের নিহত ৭ এবং আহত ৩ শতাধিক উল্লেখ করা হয়। অন্যদিকে, ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকায় ২১ ও ২২ শে ফেব্রুয়ারি নিহতের সংখ্যা ৯ উল্লেখ করা হয়েছিল। 

ভারতের কলকাতার তৎকালীন ‘আনন্দবাজার’ পত্রিকায় সংবাদের শিরোনাম ছিল- ‘বৃহস্পতি ও শুক্রবার মোট ৯ জন নিহত’। অন্য একটি পত্রিকায় নিহতের সংখ্যা ৬ উল্লেখ করা হয়। সাবেক প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ তার ডায়েরিতে লিখেছিলেন- বেসরকারি তথ্যমতে মৃতের সংখ্যা ১২, আহত বহু। 

১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় সীমান্ত পত্রিকার সম্পাদক মাহবুব উল আলম চৌধুরী তার লেখা ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি’ কবিতাটিতে প্রথম লাইনে ৪০ জন শহীদের কথা উল্লেখ করা হয়। এটি সত্যি নাকি কবিতার অংশ তা আজও রহস্যময়।

ভাষা শহীদদের নাম

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সকল ভাষা শহীদদের নাম, পরিচয় ও ছবির তথ্য জানা যায়নি আজও। তবে ৮ জন শহীদের পরিচয় সম্পর্কে ইতিহাসে স্পষ্ট ধারণা রয়েছে। এসকল বীর ভাষা শহীদদের নাম হলো- 

২১ শে ফেব্রুয়ারির ভাষা শহীদদের নাম

  1. আব্দুল জব্বার
  2. রফিক উদ্দিন আহমদ
  3. আবুল বরকত
  4. আব্দুস সালাম

২২ শে ফেব্রুয়ারির ভাষা শহীদদের নাম

  1. শহীদ শফিউর রহমান
  2. আব্দুল আউয়াল
  3. মোঃ অহিউল্লাহ
  4. এক অজ্ঞাত বালক

ভাষা শহীদদের নাম, পরিচয় ও ছবি (সংক্ষিপ্ত)

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস থেকে ৮ জন ভাষা শহীদদের নাম, পরিচয় ও ছবি সংক্ষিপ্ত আকারে নিচে তুলে ধরা হলো:-

ভাষা শহীদ আব্দুল জব্বার

আব্দুল জব্বার ১৩ আগস্ট ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও উপজেলার রাওনা ইউনিয়নের পাঁচুয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পেশায় একজন সাধারণ গ্রামীণ কর্মজীবী ছিলেন। তার পিতার নাম- মরহুম হাসেন আলী এবং মাতার নাম- সাফাতুন্নেসা। 

ভাষা শহীদ আব্দুল জব্বার

তার পরিবারে ছিল পিতা-মাতা, পাঁচ ভাই ও দুই বোন। আব্দুল জব্বার বিবাহিত ছিলেন। তার স্ত্রীর নাম ছিল- আমেনা খাতুন এবং আন্দোলনের সময় ১৫ মাস বয়সী তার একমাত্র ছেলের নাম- নুরুল ইসলাম বাদল। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তিনি শহীদ হন।

ভাষা শহীদ রফিক উদ্দীন আহমদ

রফিক উদ্দিন আহমদ ৩০ অক্টোবর ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে মানিকগঞ্জ জেলার সিঙ্গাইর উপজেলার পারছিল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মানিকগঞ্জ জেলার দেবেন্দ্রনাথ কলেজের বাণিজ্য বিভাগের ২য় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। তার পিতার নাম- মরহুম আব্দুল লতিফ এবং মাতার নাম- রাজিয়া খানম। 

ভাষা শহীদ রফিক উদ্দীন আহমদ

তিনি ২০০০ সালে মরনোত্তর একুশে পদক পেয়েছিলেন। তার পরিবারে ছিল পিতা-মাতা ও তারা ২ ভাই। তার ছোট ভাই খোরশেদ আলম এখনো জীবিত। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তিনি শহীদ হন। 

ভাষা শহীদ আবুল বরকত

আবুল বরকত ১৬ই জুন ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে (তৎকালীন ভারতের) মুর্শিদাবাদ জেলার বাবলা ভরতপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এম এ (MA) ক্লাসের ছাত্র ছিলেন। তার পিতার নাম- মৌলভী শামসুজ্জোহা ওরফে ভুলু মিয়া  এবং মাতার নাম- হাজী হাসিনা বিবি।

ভাষা শহীদ আবুল বরকত

তার পরিবারে ছিল পিতা-মাতা, তিন বোন ও দুই ভাই। তিনি ছিলেন পিতামাতার চতুর্থ সন্তান এবং শিক্ষার জন্য ঢাকার পুরানা পল্টনে বসবাস করতেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তিনি শহীদ হন। এসকল ভাষা শহীদদের নাম, পরিচয় ও ছবি প্রকাশিত হয়েছিল বিভিন্ন সংবাদপত্রে।

ভাষা শহীদ আব্দুস সালাম

আব্দুস সালাম ২৭ নভেম্বর ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে ফেনী জেলার দাগনভূঞা থানার লক্ষণপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ডাইরেক্টর অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (Director of Commerce and Industry) অফিসে রেকর্ড কিপার (Record keeper) পদে চাকরি করতেন। তার পিতার নাম- মরহুম মো. ফাজিল মিয়া এবং মাতার নাম- দৌলতন নেতা।

ভাষা শহীদ আব্দুস সালাম

তার পরিবার ছিল পিতা-মাতা, তিন বোন ও চার ভাই। আব্দুস সালাম ছিলেন পরিবারের বড় ছেলে। তার সর্বকনিষ্ঠ ছোট ভাই এখনো জীবিত। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তিনি শহীদ হন।

ভাষা শহীদ শফিউর রহমান

শফিউর রহমান ২৪ জানুয়ারি ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে ভারতের হুগলি জেলার কোন্নাগর গ্রামে জন্য গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন ঢাকা হাইকোর্টের কর্মচারী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ক্লাসের প্রাইভেট ছাত্র। তার পিতার নাম- মরহুম মাহবুবুর রহমান এবং মাতার নাম মরহুমা কানেতাতুন্নেছা।

ভাষা শহীদ শফিউর রহমান

১৯৯০ সালের শফিউর রহমান মরণোত্তর একুশে পদক পান। বর্তমানে শফিউর রহমানের পরিবার ঢাকার উত্তরা মডেল টাউনে বসবাস করেন। শফিউর রহমানের স্ত্রী আকিলা খাতুন জীবিত আছেন। শফিউর রহমানের ছেলের নাম শফিকুর রহমান ও মেয়ের নাম আসফিয়া খাতুন। তিনি ১৯৫২ সালের ২২ শে ফেব্রুয়ারি ঢাকার বংশাল রোডে শহীদ হন। পরিবারের কাছে এই ভাষা শহীদদের নাম, পরিচয় ও ছবিসহ বীরত্বের ইতিহাস জানা যায়।

ভাষা শহীদ আব্দুল আউয়াল

আব্দুল আউয়াল ১১ই মার্চ ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে ঢাকার গেন্ডারিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পেশায় একজন রিকশাচালক ছিলেন। তার পিতার নাম- মোঃ আব্দুল হাশেম। 

ভাষা শহীদ আব্দুল আউয়াল

১৯৫২ সালের ২২ শে ফেব্রুয়ারি সশস্ত্র বাহিনীর মোটর গাড়ির নিচে চাপা পড়ে তিনি শহীদ হন।

ভাষা শহীদ মোঃ অহিউল্লাহ

মোঃ অহিউল্লাহ ১১ সেপ্টেম্বর ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করে। সে ছিল ভাষা আন্দোলনের সর্বকনিষ্ঠ ভাষা শহীদ। সে একজন শিশু শ্রমিক ছিল। তার পিতার নাম হাবিবুর রহমান, যিনি পেশায় একজন রাজমিস্ত্রি ছিলেন। 

ভাষা শহীদ মোঃ অহিউল্লাহ

১৯৫২ সালের ২২ শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা নবাবপুর এলাকায় বংশাল রোডে পুলিশের গুলিতে তিনি শহীদ হন। তবে তার লাশ পুলিশ অপহরণ করেছিল।

ভাষা শহীদ- বালক (পরিচয় অজ্ঞাত)

১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারিতে শহীদদের শোকে ২২ শে ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে যে শোক মিছিল হয়েছিল সেখানে এই অল্পবয়সী বালক অংশগ্রহণ করেছিল। তৎকালীন সশস্ত্র বাহিনী মিছিল থেকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য মিছিলের মধ্যখানে ট্রাক চালিয়ে দেয়। সেখানে কার্জন হল এলাকায় মোটরগাড়ি দুর্ঘটনায় এই অজ্ঞাতনামা বালক শহীদ হন। এই বালকসহ অন্যান্য ভাষা শহীদদের নাম, পরিচয় ও ছবির তথ্য পাওয়া যায়নি কোথাও।

শেষকথা

ভাষা শহীদের আমাদের দেশের কৃতি সন্তান এবং বাঙালি জাতির গৌরব। এই ভাষা শহীদদের নাম, পরিচয় ও ছবি আমাদের মনে ভাষা প্রেম জাগ্রত করে গভীরভাবে। এ সকল শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়েই পেয়েছিলাম আমাদের মাতৃভাষা। তাই তাদের বুকের রক্তের সঠিক মূল্যায়ন করতে বাংলা ভাষার মর্যাদা নিশ্চিত করা সকল বাঙ্গালির দায়িত্ব।

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *