ভাষা আন্দোলন কি? ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস

ভাষা আন্দোলন কি? ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস

আমরা বাঙালি জাতি। তবে বাংলা ভাষায় কথা বলার অধিকার প্রকৃতিগতভাবে পাইনি। বাংলা ভাষাকে নিজের মাতৃভাষা হিসেবে পাওয়ার জন্য বাঙালি ভাষা প্রেমীদের করতে হয়েছে তুমুল আন্দোলন। বাংলা ভাষাকে ঘিরে রয়েছে বিস্তীর্ণ ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস। বাঙালি জাতি হিসেবে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন কি এবং ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস সম্পর্কে জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। তাই ভাষা আন্দোলন কি এবং ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য থাকছে আজকের লেখাটিতে।

মোদের গর্ব,,,মোদের আশা,,, আ মরি বাংলা ভাষা।

বাংলাদেশের সোনার,,, ছেলে ভাষা শহীদের দল,

জীবন দিয়ে এনে দিল,,, বাংলা ভাষার ফল,

তাদের দানে আজকে আমরা,,, স্বাধীনভাবে বাংলা বলি,,,

সেই সোনার ছেলেদের ত্যাগের কথা,,, কেমন করে ভুলি!

– অতুল প্রসাদ সেন

সূচিপত্র

ভাষা আন্দোলন কি?

ভাষা আন্দোলন হলো ১৯৫২ সালে বাঙালি জাতির প্রাণপ্রিয় মুখের বুলি ‘বাংলা ভাষার’ অধিকার আদায়ের সংগ্রাম। ১৯৫২ সালে তৎকালীন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু ঘোষণা করায়, রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবিতে বাঙালিরা পাকিস্তানি সরকারের বিরুদ্ধে এই আন্দোলন করেছিল। বাঙালীদের বুকের রক্ত দিয়ে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার এই ঐতিহাসিক আন্দোলন কে বিশ্বজুড়ে ভাষা আন্দোলন বলা হয়।

ভাষা আন্দোলনের সূচনা

বাংলা ভাষা আন্দোলন ১৯৫২ সালে হলেও ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস এর সূচনা হয়েছিল অনেক আগেই। ১৮৫৮-১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ শাসনামলে অবিভক্ত ভারতবর্ষে উর্দু ছিল একটি জনপ্রিয় ভাষা। বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের প্রচেষ্টায় এটি আন্তঃদেশীয় যোগাযোগের ভাষার মর্যাদা পেয়েছিল। 

উর্দু ভাষায় ফার্সি, আরবি এবং তুর্কি ভাষার ঘনিষ্ঠ প্রভাব রয়েছে। পারসিক-আরবি লিপি হওয়ায় উর্দু ভাষা ভারতীয় মুসলমানদের ইসলামিক সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে ওঠে। তবে বাংলার মুসলমানদের প্রিয় এবং প্রধান ভাষা ছিল বাংলা। তখন থেকেই ভাষা নিয়ে দ্বিমত লক্ষণীয় ছিল এবং ভাষা আন্দোলন কি এবং কেন হয়েছিল সে বিষয়ে নিম্নোক্ত পর্যায় গুলো পার হতে থাকে:

ভাষা আন্দোলন সূচনা; দ্বি-জাতি তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা

১৯৪৭ সালে প্রায় ১৯০ বছরের ব্রিটিশ শোষণ থেকে মুক্তি পায় ভারতবর্ষ। ১৯৪৭ সালে ইংল্যান্ডের উপনিবেশিক শক্তি যখন ভারতবর্ষ থেকে বিদায় নেয় তখন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ভাষা, সংস্কৃতি এগুলোর পরিবর্তে ধর্মকে প্রাধান্য দিয়ে দ্বিজাতি তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। তার দিকনির্দেশনায় ১৪ ও ১৫ আগস্ট যথাক্রমে পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি রাষ্ট্র তৈরি হয়। তখন থেকেই ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস শুরু হয়।

ভাষা নিয়ে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যবর্তী বৈষম্য

তৎকালীন পাকিস্তানের দুটি অংশ ছিল, পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) ও পশ্চিম পাকিস্তান। পশ্চিম পাকিস্তান শুরু থেকেই পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করতে থাকে। বেশিরভাগ উন্নয়ন ও সরকারি সুবিধা শুধুমাত্র পশ্চিম পাকিস্তানই ভোগ করতে থাকে। 

তবে বাঙালির হৃদয়ে সবচেয়ে বড় আঘাত হানে যখন উর্দুকে মূল ভাষা হিসেবে প্রাধান্য দিতে থাকে। পাকিস্তানের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, মুসলিম লীগের মোহাজেরগণ সকলেই ছিলেন উর্দুভাষী।

উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা

ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস অনুযায়ী ১৯৪৭ সালে করাচীতে একটি জাতীয় শিক্ষা সম্মেলনের অনুষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা হিসেবে উদ্যোগে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষার প্রস্তাব করা হয়। সমাবেশে প্রতিবাদ জানানো হলেও পাকিস্তান পাবলিক সার্ভিস কমিশন বাংলা ভাষাকে তাদের অনুমোদিত বিষয় তালিকা থেকে বাদ দেয়। 

পাকিস্তানি মুদ্রা, গণমাধ্যম, ডাকটিকেট ও বিভিন্ন সরকারি কাগজপত্র থেকে বাংলা অক্ষর বাতিল করা হয়, যা বাংলা ভাষাপ্রেমী বাঙ্গালীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করে। ভাষা আন্দোলন কি এবং কেন হয়েছিল তা এই সময়ই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল।

বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার দাবি

ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস মতে সমগ্র বাঙালি জাতি এবং সমগ্র পাকিস্তানের প্রায় ৫৬% জনগণ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার দাবি জানায়। এই দাবিকে ঘিরে পর্যায়ক্রমিক ভাবে রয়েছে আরো কিছু অভ্যন্তরীন ইতিহাস।

ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের গণপরিষদে দাবি

১৯৪৮ সালে কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত পাকিস্তান পার্লামেন্টের এসেম্বলিতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করেন। তবে তৎকালীন পাকিস্তানি সরকার, খাজা নাজিমুদ্দিন, লিয়াকত আলী খান এর বিরোধিতা করে প্রস্তাব খারিজ করে দেন। এর প্রতিবাদ জানাতে ২ মার্চ গড়ে ওঠে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। তারপর তীব্র প্রতিবাদ ও পশ্চিম পাকিস্তানের অত্যাচার চলতে থাকে।

ভাষা নিয়ে রেসকোর্স ময়দানে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ভাষণ

ভারতবর্ষ বিভাগীয় হওয়ার পর ১৯৪৮ সালের ১৯ শে মার্চ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ প্রথমবারের মতো পূর্ব পাকিস্তানের আসেন। একুশে মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে আপামর ছাত্র জনতার সামনে তিনি ঘোষণা করেন- ” উর্দু ভাষাই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, অন্য কোন ভাষা নয়। 

তিনি আরো বলেন জনগণের মধ্যে ভাষা নিয়ে কিছু ষড়যন্ত্রকারী রয়েছে, তারা পাকিস্তানের শত্রু এবং তাদেরকে ক্ষমা করা হবে না। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে তার এমন বক্তব্যে বিক্ষোভ শুরু করেন উপস্থিত ছাত্রসমাজ।

আরবি হরফে বাংলা লেখার অযৌক্তিক প্রস্তাব

ভাষা নিয়ে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ঘোষণার পর পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ ও সম্মেলন হতে থাকে। পরিস্থিতি সামলে রাখতে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রী ফজলুর রহমান ভিন্নধর্মী কৌশল করেন। 

তিনি বলেন, আরবি হরফে বাংলা লেখার প্রচলন করতে। তার যুক্তি অনুযায়ী বাংলা ঘরে ইসলামী ভাবাদর্শ নেই, তাই আরবি হরফ দিয়ে বাংলা লিখলে তা প্রকৃত মুসলিমদের ভাষা হয়ে উঠবে। 

ভাষাকে ঘিরে পাকিস্তানের প্রথম বিরোধীদল আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা

পাকিস্তানি শোষনের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির অধিকার আদায়ের জন্য ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ নামে একটি নতুন রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে ওঠে। এর সভাপতি ছিলেন মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। এই রাজনৈতিক বিরোধী দলকে ঘীরেই বাংলা ভাষার অস্তিত্ব রক্ষা ও বাঙালি জাতির অধিকার আদায়ের চেষ্টা চলতে থাকে।

১৯৫১ ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত

১৯৫১ সালে ভাষা নিয়ে পুনরায় ষড়যন্ত্রের শুরু হয়। ফলে বাংলা নিজস্ব সংস্কৃতিকে নিয়ে সচেতন একটি দল- ‘পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ’ গঠন করা হয়। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে ১৯৫১ সালে পুনরায় পাকিস্তানের পার্লামেন্টে আরবি হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু পাকিস্তান যুবলীগ কমিটি এই প্রস্তাবকে বাতিল করে দেয়। 

ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, হাবিবুল্লাহ বাহার সহ আরো অনেকেই এই প্রস্তাবকে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংসের উদ্যোগ বলে অভিহিত করে। ফলে পাকিস্তানি সরকার পুনরায় এ প্রস্তাব বাতিল করেন।

১৯৫২ ভাষা আন্দোলনের পুনর্জাগরণ

১৯৫২ সালের ২৭শে জানুয়ারি তৎকালীন হবু প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ঢাকার পল্টন ময়দানে এক জনসভায় পুনরায় ঘোষণা দেন- ‘পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। সেই জনসভাতেই ছাত্রসমাজ স্লোগান দিতে থাকে, “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই”। এই পরিস্থিতি দেখেই ভাষা আন্দোলন কি হতে পারে পাকিস্তান সরকার বুঝে গিয়েছিল।

বারবার ভাষা নিয়ে বিকৃত মনোভাব প্রকাশ করায় স্থানে স্থানে প্রতিবাদ সভা ও ধর্মঘট বারণ হতে থাকে। ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষার প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা সমবেত হয়ে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি জানাই এবং বিক্ষোভ মিছিল বের করে। একুশে ফেব্রুয়ারি হরতাল, সমাবেশ ও মিছিলের কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। 

তৎকালীন সরকার ২০ই ফেব্রুয়ারি স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে একুশে ফেব্রুয়ারি থেকে পরবর্তী এক মাসের জন্য ঢাকায় সভা সমাবেশ ও মিছিল নিষিদ্ধ করেন এবং ১৪৪ ধারা জারি করে এবং বাংলা ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের মূল পর্ব শুরু হয়।

একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের পটভূমি

বাংলা ভাষাপ্রেমী পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রসমাজ ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সরকারের ১৪৪ ধারা আদেশ উপেক্ষা করে সকাল ৯ টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমবেত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতন কলাভবন প্রাঙ্গণের আমতলায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গের প্রশ্নে ঐতিহাসিক ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। ছাত্ররা দলে দলে বিভক্ত হয়ে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগানের সাথে মিছিল নিয়ে বেরিয়ে আসতে চায়। এ সময় সশস্ত্র পুলিশ সবার চারিদিকে ঘিরে রাখে।

সকাল ১১:১৫ মিনিটের দিকে ছাত্ররা প্রতিবন্ধকতা ভেঙে রাস্তায় নামতে চাইলে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে সকলকে সতর্ক করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এ সময় পুলিশকে কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ বন্ধ করতে এবং বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ত্যাগের নির্দেশ করে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে সময় পুলিশ বহু ছাত্রকে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের অভিযোগে গ্রেফতার করেন। 

আন্দোলনকারী ছাত্ররা বিষয়টিতে ক্ষুব্ধ হয়ে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। মিছিল নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের নিকটবর্তী এলাকায় আসলে পুলিশ ১৪৪ ধারা বঙ্গের অজুহাতে বিক্ষোভকারীদের উপর গুলি বর্ষন করে। সালাম, বরকত, জব্বার, রফিক সহ অনেক শহীদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়ে যায়। এর ফলে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।

২২ শে ফেব্রুয়ারির আন্দোলন

১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে ২২ ও ২৩শে ফেব্রুয়ারি ছাত্র, সাহিত্যিক, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, শ্রমিক ও সাধারণ মানুষ পূর্ণ হরতাল পালন করে এবং শোভাযাত্রা সহকারে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে। পুলিশের গুলিতে ২২ শে ফেব্রুয়ারি শহীদ হন শফিউর রহমান শফিক, যা ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে আজও স্মরণীয়। 

ভাষা আন্দোলন পরবর্তী অবস্থা

ভাষা আন্দোলনের পরবর্তী সময়ে ২২ ও ২৩ ফেব্রুয়ারিতে বাংলা ভাষাভাষী আন্দোলনকারী মানুষদের বিরুদ্ধে পুলিশদের অত্যাচার বাড়তেই থাকে। ২৩ শে ফেব্রুয়ারি ফুলবাড়ীয়া এলাকায় ছাত্র জনতার মিছিলেও অত্যাচার চালায় পুলিশ। 

২৩ শে বিকেলে ফেব্রুয়ারি ভাষা শহীদদের স্মরণে এবং বাংলা ভাষার মর্যাদাপূর্ণ স্মৃতিকে অম্লান রাখতে ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ মিনার তৈরি করা হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে শহীদ মিনার নির্মাণ কাজ শেষ হয় ২৪ শে ফেব্রুয়ারি ভোররাতে। 

২৪ শে ফেব্রুয়ারি শহীদ শফিউর রহমানের পিতা প্রথম শহীদ মিনারটি উদ্বোধন করেন। শহীদ মিনারটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন হয় ২৬ শে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের অন্যতম অংশ দৈনিক আজাদ পত্রিকার সম্পাদক জনাব আবুল কালাম শামসুদ্দিনের মাধ্যমে।

ভাষা আন্দোলন পরবর্তী পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া

ভাষা আন্দোলনের পর পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের সংস্কৃতির পার্থক্যগুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পশ্চিম পাকিস্তানের উর্দু ভাষাভাষীরা এই ভাষা আন্দোলন কি এবং কেন হয়েছিল তা না বুঝে আন্দোলনটিকে পাকিস্তানের জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে উত্থান বলে মনে করে। এছাড়াও পাকিস্তানি সরকার ভাষা আন্দোলনটির মিথ্যা ব্যাখ্যা দিয়ে গণমাধ্যমে অপপ্রচার শুরু করে।

১৯৫২ সালে গণমাধ্যমে বাংলা ভাষা আন্দোলন

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই ভাষা নিয়ে নানা রকম প্রচার-প্রচারণা, আলোচনা সমালোচনা জুড়ে ছিল গণমাধ্যম। দৈনিক ইত্তেহাদ, দৈনিক আজাদ পত্রিকা শুরু থেকেই বাংলা ভাষার সমর্থনে বেশ কিছু প্রবন্ধ ও প্রতিবেদন ছাপায়। ইনসাফ, জিন্দেগী ও দেশের দাবি পত্রিকাও ভাষা আন্দোলনে প্রভাব ফেলেছিল।

১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি দৈনিক আজাদ পত্রিকায় ‘ছাত্রদের তাজা খুনে ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত’ ব্যানার শিরোনামে প্রতিবাদ জানায় এবং ভাষা আন্দোলনের পক্ষে জোরদার ভূমিকা রাখে। অন্যদিকে, মর্নিং নিউজ পত্রিকাটি উর্দু ভাষাকে সমর্থন করে ভাষা আন্দোলনের ঘটনাকে ভিন্ন রূপে প্রচার করে। হলে ২২ শে ফেব্রুয়ারি বিক্ষোভ দুজনতা মর্নিং নিউজ এর প্রেস ও অফিস জ্বালিয়ে দেয়।

১৯৫৬ সালে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি

বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদানে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে যুক্তফ্রন্ট এর ভূমিকা অপরিসীম। ১৯৫৪ সালের ৪ ডিসেম্বর মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে থাকা সকল রাজনৈতিক দল নিয়ে যুক্তফ্রন্ট প্রতিষ্ঠিত হয়ে। ঘরে পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিপুল ভোটে জয়লাভ করে। এ সময় বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি রক্ষার জন্য ১৯৫৫ সালের ৩ ডিসেম্বর বাংলা একাডেমি গঠন করে। 

তারপর, ১৯৫৬ সালে ২৬ শে ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের পার্লামেন্টের সংবিধানে ২১৪ নং অনুচ্ছেদে ঊর্দু এবং বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

ভাষা আন্দোলনের অর্জন

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর ১৯৫৬ সালে বাংলা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলার অধিকার আদায়ের পথ সুগম হয়। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সূচনা বলা চলে এই ভাষা আন্দোলনকে। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে ১৮৮ টি দেশের সমর্থনে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা দেওয়া হয়। আমরা আজও যে বাংলা ভাষায় বলি, লিখি এর সবই ভাষা আন্দোলনের অর্জন।

ভাষা আন্দোলনে ভাষা শহীদদের অবদান

বাংলা ভাষার সম্মান রক্ষার্থে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ছাত্ররা ভাষা আন্দোলন করেছিল। ভাষাপ্রেমের জন্যই দিতে হয়েছে তাদের মূল্যবান প্রাণ। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস অনুযায়ী ভাষা শহীদদের মধ্যে সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার,শফিউর এদেরকে একসাথে ‘ভাষা শহীদ’ বলা হয়। 

ভাষা শহীদদের জীবন বিলিয়ে দেওয়ার কারণেই তৎকালীন পাকিস্তান সরকার বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। বর্তমানে তাদের স্মরণার্থেই ২১ শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়। ভাষা আন্দোলনের ভাষা শহীদদের অবদান কতটুকু তা বর্তমান বাংলা ভাষার অবস্থান দেখলেই বোঝা যায়।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধু

১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বাংলার রাজনৈতিক উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান লক্ষণীয়। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর রাষ্ট্রভাষা উর্দু হওয়ার ঘোষণার সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তীব্র প্রতিবাদ জানায়। ১৯৫২ সাল থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত তিনি ভাষার জন্য কাজ করা ‘পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ’ এর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৫২ সালে তিনি কারাবন্দি হন। 

১৬ ই ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু এবং মহিউদ্দিন আহমেদকে মুক্তি না দিলে তারা অনুষ্ঠানে বসেন। একুশে ফেব্রুয়ারিতে পুলিশের গুলির কথা শুনে তিনি বলেন- ” রক্ত যখন আমাদের ছেলেরা দিয়েছে, তখন বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা না করে উপায় নেই”। 

বাঙালি সংস্কৃতিতে ভাষা আন্দোলনের প্রভাব

ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস বাংলার সংস্কৃতিকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। এই দিনটি বাংলাদেশকে বিশ্ব বুকে এনে দিয়েছে একটি নতুন পরিচয়। দিনটির স্মরণে বাঙ্গালীদের মনে জাগে মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা। মানুষের ভেতরে অমর একুশের আবেগ ও চেতনা পৌঁছে দেয় একুশের ঘটনা। একুশে ফেব্রুয়ারিকে ঘিরে রয়েছে হাজারো বাংলা সাহিত্য। দেশের বেশিরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তৈরি আছে শহীদ মিনার যা বাংলার মানুষের মনে ভাষা আন্দোলনের প্রভাব বিস্তার করে।

ভাষা দিবস উদযাপন

১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি সেই ভাষা আন্দোলনের দিনটিকে বর্তমানে সমগ্র পৃথিবী জুড়ে উদযাপন করা হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। প্রতিবছর এই দিনটি একটি সরকারি ছুটির দিন। শহীদদের স্মৃতিতে সারাদেশ জুড়ে থাকা শহীদ মিনার গুলোতে ফুল দিয়ে স্মরণ করে সকলে। দেশের বিভিন্ন স্থানে হয় সভা, সমাবেশ, সেমিনার। বাংলা একাডেমি কর্তৃক পুরো ফেব্রুয়ারি মাসব্যাপী আয়োজিত হয় অমর একুশে বইমেলা।

ভাষা আন্দোলন নিয়ে সাহিত্য

এখানে যারা প্রাণ দিয়েছে

রমনার ঊর্ধ্বমুখী কৃষ্ণচূড়ার তলায়

যেখানে আগুনের ফুলকির মত

এখানে ওখানে জলছে অসংখ্য রক্তের ছাপ

সেখানে আমি কাঁদতে আসিনি।

আজ আমি শোকে বিহ্বল নই

আজ আমি ক্রোধে উন্মত্ত নই

আজ আমি প্রতিজ্ঞায় অবিচল।

– মাহবুব উল আলম চৌধুরী

ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্মরণীয় বিষয়গুলোর একটি। এই দিনটিকে ঘিরে তৈরি হয়েছে বিভিন্ন গান, কবিতা, উপন্যাস, চলচ্চিত্র, নাটক ইত্যাদি। এর মধ্যে প্রসিদ্ধ কিছু সাহিত্য হলো:-

  • গীতিকার আব্দুল গাফফার চৌধুরী এর- একুশের গান, “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো”।
  • মাহবুব উল আলম চৌধুরী এর লিখা কবিতা- “কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি”।
  • জহির রায়হানের লেখা উপন্যাস- “একুশে ফেব্রুয়ারি”।

এছাড়াও ভাষা আন্দোলন কি এবং ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস কে ঘিরে সহস্রাধিক সাহিত্য ও চিত্রশালা রয়েছে ভাষা আন্দোলনকে ঘিরে।

শেষকথা

ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতির উন্নয়ন ধারার প্রথম সিঁড়ি ছিল। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের হাত ধরে ই বাঙালি জাতি এগিয়ে গেছে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের দিকে। ভাষা শহীদদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে বাঙালি জাতির বিজয় ও বাংলা ভাষার গৌরব ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবী জুড়ে এবং সকলেই জানে ভাষা আন্দোলন কি। বর্তমানে পৃথিবী জুড়ে প্রায় ৩০ কোটি লোকের মাতৃভাষা এই বাংলা। ভাষা আন্দোলনের ফলেই আজও প্রাণ খুলে বলতে পারি,- আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *