অসমীয়া ভাষা কি এবং এই ভাষার সম্পূর্ণ পরিচিতি

অসমীয়া ভাষা কি এবং এই ভাষার সম্পূর্ণ পরিচিতি

অনেকেই নতুন নতুন ভাষা শিখতে পছন্দ করেন। নতুন ভাষা নিয়ে রিসার্চ করতে পছন্দ করেন। পুরোনো ভাষাকে আবারো নতুনের মতো ব্যবহার করে একধরণের মানসিক প্রশান্তি অনুভব করেন। আর ভাষার প্রতি অসাধারণ আবেগ থাকা এসব ব্যাক্তিদের কাছে কিন্তু অসমীয়া ভাষা হতে পারে সেরা একটি প্ল্যাটফর্ম। প্ল্যাটফর্ম বলার কারণ হলো এই ভাষার পরিধি এতোটাই বিশাল যে ভাষাটি সম্পর্কে জানতে জানতে দিন ফুরিয়ে গেলো জানাটুকু শেষ হবে না। তার উপর অসমীয়া ভাষার বয়সটাও কম হলো না। যাইহোক! চলুন তবে আজ জেনে নেওয়া যাক অসমীয়া ভাষা এবং এই ভাষা সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্যাদি।

অসমীয়া ভাষা কি? 

অসমীয়া ভাষা মূলত ভারতের বেশ জনপ্রিয় একটি ভাষা। ভাষাটিকে উচ্চারণে অনেকেই অখ়মীয়া ভাষা বলে থাকে। বিশেষ করে ভারতের আসাম রাজ্যে এই অসমীয়া ভাষাভাষীরা বাস করেন। রাজ্যটির নাম শুনেই হয়তো বুঝতে পেরেছেন নামের সাথে অসমীয়া ভাষার নামকরণের বিরাট একটি সম্পর্ক রয়েছে। মনে হতে পারে অসমীয়া এবং আসাম প্রায় কাছাকাছি শব্দ! 

সে যাইহোক! এই অসমীয়া ভাষা কিন্তু ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি সরকারি ভাষা। বিশেষ করে ভারতের আসাম নামের রাজ্যটিতে এই ভাষাটিকে সরকারি ভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। রাজ্যটিতে সরকারি বিভিন্ন কর্মকান্ড কিংবা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় এই অসমীয়া ভাষা। এছাড়াও রাজ্যটিতে কথ্য ভাষা হিসেবেও অসমীয়া ভাষার প্রচলন রয়েছে। 

এক্ষেত্রে বলে রাখা ভালো ১৮৩৬ সালের দিকে অসমীয়া ভাষা একটি রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি পাওয়ার সুযোগ লাভ করে। তবে তখনো কিন্তু ভাষাটি সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায় নি। যদিও এর প্রায় কয়েক বছর আগে অর্থ্যাৎ ১৮২৬ সালে ব্রিটিশ শাসনের অধীনে আসামের উৎপত্তি ঘটায অসমীয়া ভাষাটিকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিলো। পরবর্তীতে ১৮৭২ সালের দিকে এসেই এই অসমীয়া ভাষা সরকারি ভাষার রূপ লাভ করে। যা আজো অব্যহত রয়েছে। 

আপনারা যারা ইন্দো আর্য ভাষা সমূহের সাথে কিছুটা হলেও পরিচিত হয়ে আছেন তারা নিশ্চয় এই ভাষাগুলি দেখতে কেমন হয় কিংবা এর কিছুটা ব্যাকরণ-রীতি সম্পর্কে ধারণা রাখেন! এক্ষেত্রে অসমীয়া ভাষার সাথেও কিন্তু ইন্দো আর্য ভাষা সমূহের ব্যাকরণগত কিছুটা মিল রয়েছে। সুতরাং যারা ইন্দো আর্য ভাষা সমূহ সম্পর্কে ধারণা রাখেন আশা করো তাদের কাছে এই অসমীয়া ভাষার গঠনরীতি কিংবা ব্যাকরণ রীতি বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হবে না। 

অসমীয়া ভাষার ইতিহাস

আপনি কি জানেন অসমীয়া ভাষাকে বাংলা ভাষার প্রতিবেশী বলা হয়ে থাকে? মূলত এই আত্মীয়তার কারণেই অসমীয়া ভাষার সাথে কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমাদের এই বাংলা ভাষারও মিল পাওয়া যায়। 

এবারে আমরা জানবো অসমীয়া ভাষার ইতিহাস কিংবা পেছনের গল্প সম্পর্কে। বলা হয়ে থাকে অসমের প্রাচীন নাম ‘কামরূপ’। আর এই অসম শব্দটি থেকেই এসেছে অসমীয়া ভাষার এই অর্থবহ নামকরণ। আর যারা এই অসমীয়া ভাষার উৎপত্তিস্থল হিসেবে সরাসরি কোনো নির্দিষ্ট ভাষা সম্পর্কে জানতে চাচ্ছেন তাদের উদ্দেশ্যে বলবো এই ভাষাটি পূর্ব ভারতীয় মাগধী প্রাকৃত ভাষা থেকে এসেছে। 

মূলত ১৮২৬ সাল থেকে শুরু করে ১৮৭২ পর্যন্ত ভাষাটিকে বিভিন্ন সেক্টরে স্বীকৃতি প্রদান করার কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছিলো। পরবর্তী সময় থেকে এখন পর্যন্ত এই অসমীয়া ভাষা রাষ্ট্রভাষা কিংবা সরকারি ভাষা অথবা গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলি ব্যবহৃত অন্যতম ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। 

ইতিহাসের দিক দিয়ে যদি বাংলা ভাষার সাথে এই অসমীয়া ভাষার কোনো সম্পর্ক কিংবা রূপদানের কথা বলি সেক্ষেত্রে ব্যাপারটা হবে এমন, ইন্দো-ইউরোপীয় > ইন্দো-ইরানীয় > ইন্দো-আর্য > পূর্ব ইন্দো-আর্য > বাংলা-অসমীয়া > বাংলা। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে বাংলা-অসমীয়া ভাষা থেকেই আমাদের আজকের এই বাংলা ভাষার জন্ম। সেদিক দিয়ে ঐতিহাসিকভাবেও অসমীয়া ভাষার সাথে আমাদের আজকের এই বাংলা ভাষার কিন্তু দারুণ সম্পর্ক রয়েছে। 

অসমীয়া ভাষার বৈশিষ্ট্য 

এবার আসি তাদের ব্যাপারে যারা কিনা অসমীয়া ভাষা কি সে-সম্পর্কে জেনে এর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানার ক্ষেত্রে প্রচুর আগ্রহী হয়ে উঠেছে সে-ব্যাপারে। অসমীয়া ভাষার কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো:

এটি কিন্তু ভারতের পূর্ব ইন্দো-আর্য ভাষার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যা ভারতের অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গ, মেঘালয় ও অরুণাচল প্রদেশে বেশ প্রচলিত একটি ভাষা। সুতরাং এসব প্রদেশের ব্যবহৃত হওয়ার ব্যাপারটিই অসমীয়া ভাষার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি বৈশিষ্ট্য। 

বলে রাখা ভালো অসমীয়া ভাষার সাথে কিন্তু আমাদের বাংলাদেশের চাটগাঁইয়া এবং সিলেটি ভাষার দারুণ মিল রয়েছে। যেমন Môi kôrim কিংবা মুই করিমকে আমর্ বাংলা ভাষায় বলি ami korbo কিংবা আমি করবো। আবার একই বিষয়টিকে চাটগাঁইয়া হিসেবে আমরা বলি ãi gôirgôm কিংবা আঁই গইজ্জুম। সেই সাথে সিলেটি ভাষায় আমরা যদি ব্যাপারটি ট্রান্সলেট করি সেক্ষেত্রে দেখা যাবে ব্যাপারটি গিয়ে দাঁড়াচ্ছে Ami/Mui xôrmu কিংবা আমি/মুই করমু! 

অসমীয়া ভাষার অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো এটি একটি সংশ্লেষণাত্মক ভাষা। এই ভাষাটিতে প্রথমত ধাতুর সাথে অন্ত্যপ্রত্যয় জোড়া লাগে। পরবর্তীতে গিয়ে এই জোড়াখানি সৃষ্টি করে নতুন অসমীয়া শব্দ, ভাষা কিংবা বাক্য। 

অসমীয়া ভাষার ব্যাকরণ দিকটা সম্পর্কে যদি বলি তাহলে বলবো ভাষাটির ব্যাকরণগত দিকের সাথে কিন্তু বাংলা ভাষার ব্যাকরণগত দিকের প্রচুর মিল রয়েছে। এতে রয়েছে বিশেষ্য-বিশেষণের ব্যবহার কিংবা বচন বা লিঙ্গের সঠিক ব্যবহার। 

অসমীয়া ভাষার উপভাষা 

যেকোনো ভাষার উপভাষা বলতে এমনকিছু ভাষাকে বোঝানো হয়ে থাকে যা মূলত সেই মূল ভাষা থেকে সৃষ্টি হয়েছে। এই যেমন ধরুন আমরা বিভিন্ন জেলার মানুষ সরাসরি বাংলা ভাষা ছাড়াও আলাদা একটি আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করে থাকি! অসমীয়া ভাষার ক্ষেত্রেও আলাদা কিছু উপভাষা রয়েছে। যেমন:

  • গোয়ালপাড়িয়া অসমীয়া ভাষা
  • কেন্দ্রীয় অসমীয়া ভাষা 
  • পূর্ব অসমীয়া ভাষা
  • এবং সবশেষে কামরূপী অসমীয়া ভাষা

উপরের উপভাষাগুলির বেশকিছু ভাষা কিন্তু আমাদের দেশেও প্রচলিত রয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের নওগাঁ জেলার বেশকিছু অংশে কেন্দ্রীয় অংশে অসমীয়া ভাষা ব্যবহৃত হয়ে থাকে। 

অসমীয়া ভাষার সাহিত্য

অসমীয়া ভাষা যেহেতু বেশ প্রাচীন কিংবা পুরোনো একটি ভাষা সেহেতু এই ভাষার উপর বিভিন্ন লেখালেখি পাওয়াটা কিন্তু যুক্তিযুক্ত পয়েন্ট ছিলো। তবে অবাক করা ব্যাপার হলো অসমীয়া ভাষার উপর কিন্তু খুব একটা লেখালেখি পাওয়া যায়নি। গবেষণা বলছে যেহেতু খুব একটা নথি কিংবা লেখালেখি সংগ্রহ করা যায়নি সেহেতু ধরে নেওয়া যায় ভাষাটির সাহিত্যিক দিকের ব্যাপারটি যথেষ্ট দূর্বল।

তবে ফরাসি ভাষাবিজ্ঞানী জুল ব্লখ এর “লা ফর্মাসিওঁ দি লা লং মারাথ” নামের একটি বই ছিলো। যেখানে লেখক বইটিকে সাজাতে গিয়ে ব্যবহার করেছে আধুনিক ইন্দো-আর্য ভাষার ঘনঘটা। প্রথম কোনো একটি পূর্ণাঙ্গ ভাষাবৈজ্ঞানিক গ্রন্থ হিসেবে এই বইটি আধুনিক ইন্দো-আর্য ভাষার ভাষাগত দিককে বিকশিত করতে সাহায্য করেছে। মজার ব্যাপার হলো বইটিতে কিন্তু অসমীয়া ভাষা নিয়েও বেশকিছু লেখা রয়েছে। কারণ এই অসমীয়া ভাষাও আধুনিক ইন্দো-আর্য ভাষার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। 

এছাড়াও অসমীয়া ভাষার আংশিক দিক উঠে এসেছে দি অরিজিন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অভ দ্য বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ বইয়ে। বইটির মূল লেখক ছিলেন ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। যা কিনা প্রকাশিত হয়েছিলো ১৯২৬ সালে। 

 

ইতি কথা

এই পর্যায়ে এসে বুঝলেন তো অসমীয়া ভাষা কি এবং এই ভাষা কোত্থেকে এসেছে কিংবা ভাষাটির বৈশিষ্ট্যগুলিই বা কি কি! আশা করি পরবর্তীতে আপনার পছন্দের ভাষার তালিকায় এই অসমীয়া ভাষা থাকবে প্রথম দিকে। আর হ্যাঁ! বিভিন্ন ভাষা নিয়ে যারা প্রচুর পরিমাণে আবেগপ্রবণ তারা আমাদের প্রকাশিত লেখাগুলোতে চোখ রাখতে পারেন। আশা করি আপনাকে কিছুটা হলেও উপকৃত করবে। 

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *