হিন্দি ভাষার ইতিহাস সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য 

হিন্দি ভাষার ইতিহাস সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য 

আজ আমরা আলোচনা করবো দিল্লি ও উত্তর ভারতের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের খারিবোলি উপভাষার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠা জনপ্রিয় একটি ভাষা অর্থ্যাৎ হিন্দি ভাষার ইতিহাস সম্পর্কে। ভারত আমাদের পাশ্ববর্তী দেশ এবং এই ভারতে সংস্কৃতি আমাদের মনের কোটরে জায়গা করে নিলেও আমরা অনেকেই হয়তো দেশটির প্রধান ভাষা সম্পর্কে অনেককিছুই জানি না। চলুন তবে আজ এই না জানার জগত থেকে বেরিয়ে এসে লুফে নেওয়া যাক হিন্দি ভাষার ইতিহাস সম্পর্কিত তথ্যাদি। 

হিন্দি ভাষা সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য

শুরুতেই বলে রাখি বর্তমানে আমরা যে ধরণের হিন্দি ভাষার সাথে পরিচিত সে-ধরণের হিন্দি ভাষাকে আধুনিক প্রতিম হিন্দি বলা হয়ে থাকে। এই ভাষাটিকে প্রধানভাবে ব্যবহার করা হয়ে উত্তর ভারতাঞ্চলে। দেশটিতে প্রচলিত প্রায় ২২ টি তফসিলি ভাষার মাঝে এই হিন্দি ভাষাটিকেও বেশ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়। হিন্দি ভাষা উচ্চারণকে ভাষাবিজ্ঞানের মতে সাধারণত হিন্দুস্থানী উচ্চারণ বলা হয়ে থাকে। পৃথিবীর প্রায় ৩২.২ কোটি ভাষাভাষী মানুষের মাঝে হিন্দি ভাষা প্রধান ভাষা হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে।

বলা হয়ে থাকে এই হিন্দি ভাষা হলো পৃথিবীতে জনপ্রিয়তার সাথে ব্যবহৃত ম্যান্ডারিন, স্প্যানিশ ও ইংরেজির পরে কোনো এক চতুর্থ সর্বাধিক কথিত ভাষা। অনেকেই হয়তো ইতিমধ্যেই জেনে গেছেন হিন্দি ভাষাকে সাধারণত ইন্দো-আর্য ভাষা পরিবারের একটি অংশ হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। আর লেখার ব্যাপারে কিছু বলতে হয় তবে বলবো এই হিন্দি ভাষা লেখার সময় দেবনাগরী লিখন পদ্ধতি ব্যবহার করে লেখা হয়। 

মূলত ভারত জুড়ে বিভিন্ন অঞ্চলে অনেকগুলি উপভাষা প্রচলিত থাকলেও স্ট্যান্ডার্ড হিন্দি দিল্লি অঞ্চল থেকে উদ্ভূত খারিবোলি উপভাষার উপর ভিত্তি করে তৈরি এই হিন্দি ভাষাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বের সাথে ব্যবহার করা হয়। শুধু তাই নয়! পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন ভাষাগুলির মাঝে এই হিন্দি ভাষাকে প্রথম সারির স্থানের সম্মান প্রদর্শন করলে তা অত্যুক্তি করা হবে না বৈকি! 

বর্তমানে সম্মান প্রদান এবং ব্যবহারের দিক দিয়ে এই হিন্দি ভাষাকে ভারতের ৯ টি রাজ্য ও ৩ টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের দাপ্তরিক ভাষা এবং অন্যান্য ৩ টি রাজ্যে একটি অতিরিক্ত দাপ্তরিক ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে এবং সে অনুযায়ী তা ব্যবহারও হচ্ছে। আর হিন্দি ভাষার লিখন পদ্ধতির ক্ষেত্রে দেবনাগরী লিপি, ঐতিহাসিক কৈথি, ঐতিহাসিক মহাযানী, ঐতিহাসিক লন্দা, অনুমোদন না পাওয়া রোমান এবং দেবনাগরী ব্রেইল পদ্ধতির প্রচলন রয়েছে। সেই সাথে সাইন ল্যাংগুয়েজের ব্যাপারটি তো থাকছেই! 

হিন্দি ভাষার সমৃদ্ধ ইতিহাস 

এবারে আমরা আলোচনা করবো আজকের আর্টিকেলের গুরুত্বপূর্ণ অংশ অর্থ্যাৎ হিন্দি ভাষার ইতিহাস নিয়ে। সুতরাং আমাদের সাথেই থাকুন এবং এ-ব্যাপারে জানতে থাকুন বিস্তারিত তথ্য। 

মনে রাখবেন হিন্দির একটি সমৃদ্ধ এবং রঙিন ইতিহাস রয়েছে। কারণ এটি ভাষা হিসাবে বহু শতাব্দী ধরে যোগাযোগের মাধ্যমের সাথে ব্যবহৃত হয়ে আসছে এবং আজও এটি ভারতের সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃত একটি ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

বলা হয়ে থাকে হিন্দি ভাষা পৃথিবীর প্রাচীনতম ভাষাগুলির মধ্যে একটি। যা এখন উত্তর ভারত নামে পরিচিত অঞ্চলের প্রাচীনতম উদ্ভূত ভাষা বলে মনে করা হয়। হিন্দি ভাষা সংস্কৃত ভাষা থেকে এসেছে বলে জানা যায়। যেটি কিনা বহু বছর আগে অর্থ্যাৎ প্রাচীন ভারতীয় সাম্রাজ্য চলাকালীন সময়ে সরকারী ভাষা হিসেবে প্রচলিত ছিল।

এছাড়াও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো প্রাচীন ভারতে, সংস্কৃত ভাষা ছিলো সাধারণভাবে জ্ঞান ও শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ একটি ভাষা। এটিকে একটি ঐশ্বরিক ভাষা বলেও অনেকেই সে-সময় বিশ্বাস করা শুরু করেছিলো। 

বলা হয়ে থাকে হিন্দি ভাষা এমন একটি ভাষা যা মানুষের সৃষ্টির আগে স্বর্গে ব্যবহৃত হয়েছিল। তাই, হিন্দুধর্ম সর্বদা সংস্কৃতকে একটি পবিত্র ভাষা হিসাবে সম্মান করে এসেছে এবং এখনো করছে। ফলে অনেকে এটাও বিশ্বাস করে যে হিন্দি ভাষা শেখা শেখা মানেই আপনি আধ্যাত্মিক জ্ঞানের কাছাকাছি চলে যাওয়ার সিঁড়ি খুঁজে পাওয়া। 

যদিও হিন্দি ভাষার জননী খ্যাত এই সংস্কৃত ভাষা এখন আর একটি সাধারণ কথ্য ভাষা হিসাবে প্রচলিত নয়। তবুও বেশ কিছু প্রাচীন হিন্দু ও বৌদ্ধ রীতিতে এই ভাষার অতিরিক্ত ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। 

যারা হিন্দি ভাষা সৃষ্টির ইতিহাস শুরুর সঠিক সময়টি সম্পর্কে জানতে মুখিয়ে আছেন তাদের জানিয়ে রাখা ভালো এই ভাষার প্রচলন উত্তর-পশ্চিম ভারতে শুরু হয় ১৮০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের শুরুর দিকে। মূলত সংস্কৃত ভাষাটুকু আর্যরা নিজেদের সাথে নিয়ে এসেছিল এবং তা থেকেই পরবর্তীতে জন্ম নিয়েছিলো হিন্দি ভাষা। যা জার্মানিক বা ইন্দো ইউরোপীয় ভাষার পরিবারের অংশ হিসেবে সে-সময় বেশ জনপ্রিয় ছিলো।

যেকোনো ভাষার বিবর্তন মানুষের বিবর্তনের সাথে সাথে চলতে থাকে। আপনার আশেপাশে যত বেশি বস্তুর নাম রাখার প্রয়োজন পড়বে আপনার ভাষার শব্দভান্ডার ঠিক ততবেশি বিকশিত হওয়ার সুযোগ পাবে। জীবন যেমন জটিল হয়ে উঠেছে তেমনি ভাষাও নিজেকে জটিল করে নিয়েছে৷ 

আর্যরা আদিবাসী, প্রাথমিকভাবে শিকারী এবং খাবার সংগ্রহকারী হিসেবেই সে-সময় জীবন যাপন করতো। ইন্দো-গাঙ্গেয় সমভূমির উর্বর অঞ্চলে তাদের জীবনযাত্রা বিকাশ লাভ করতে শুরু করলে বসতিপূর্ণ এবং পশুপালন জীবনযাপন করার ক্ষেত্রে নতুন নতুন শব্দ সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা বাড়তে লাগলো। ধীরে ধীরে বাড়তে লাগলো শব্দ জন্ম নেওয়া হিন্দির ভাষার শব্দভান্ডার

যদিও এ-কথা মানতে হবে যে সংস্কৃত ভাষায় প্রচুর পরিমাণে শব্দভান্ডারের সূচনা ভারতীয় উপমহাদেশের আদিবাসীদের কাছ থেকেই এসেছে। প্রায় ৫০০ বছর ধরে এই প্রচুর পরিমাণে শব্দভান্ডারের সূচনা আজো মোটামুটি আগের মতোই আছে। 

ইতিহাস ঘাটাঘাটি করলেই হয়তো জানতে পারবেন অতীতে ভারতে ফরাসি শাসকের অভাব ছিলো না। এই শাসনব্যবস্থা হিন্দির ভাষার ক্ষেত্রেও খানিটা প্রভাব বিস্তার করেছিলো। 

সারা বিশ্বে যারা হিন্দি সংস্কৃতি সম্পর্কে আরও জানতে চান তারা এই হিন্দি ভাষা শেখার মাধ্যমে উপকৃত হতে পারেন। যা আপনাকে ভারতীয়দের শিকড়ের সাথে আরও ভালোভাবে সংযোগ স্থাপন করার পথ উন্মোচন করে দিতে পারে৷ সেই সাথে একসময় যারা সংস্কৃত ভাষায় কথা বলতেন তাদের জীবনাচরণ কেমন ছিলো এবং ভারতীয় সমাজ কিভাবে চলে আসছে তা আরও ভালভাবে বুঝতে সাহায্য করতে পারে। যদিও অনেকের মতে হিন্দি ভাষা কেবল সংস্কৃত ভাষা থেকেই আসেনি। বরং এই ভাষার সৃষ্টির পেছনে ফরাসি বেশকিছু শব্দ, বাক্য এবং ব্যাকরণেরও ভুমিকা রয়েছে। 

একটু লক্ষ্য করলেই দেখবেন হিন্দি ভাষাকে আজ পশ্চিমের ইংরেজি ভাষার সঙ্গেও তুলনা করা যায়। হিন্দি শুধু ভারতীয় উপমহাদেশের ভাষাই নয়। বরং বর্তমানে ইংরেজি ভাষার মতোই হিন্দি ভাষার ব্যাপ্তি উপমহাদেশের আশেপাশের অগণিত মাতৃভাষার প্রাণকেন্দ্র পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। মুঘল, ইংরেজি, পর্তুগালসহ বিভিন্ন ভাষার খানিকটা মিশ্রণ আর সংস্কৃত ভাষার মতো পবিত্র ভাষার সংমিশ্রণে হিন্দি ভাষা হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রাচীনতম সমৃদ্ধ ভাষায়। 

ভারতের প্রেক্ষাপটে হিন্দি ভাষার গুরুত্ব 

তবে বলা রাখা ভালো ভারতে ইতিমধ্যেই বিভিন্ন আক্রমণ সংঘটিত হয়েছে। অনেকেই ভারত দখল করার চেষ্টা করেছে এবং দখলও করতে পেরেছে। সেক্ষেত্রে দখলকারী গোষ্ঠী নিজেরা নিজেদের ঐতিহ্য এবং ভাষাকে ভারতবাসীর উপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। এতোকিছুর পরও আজো ভারতের সরকারি এবং প্রধান ভাষা হিসেবে হিন্দি ভাষার গুরুত্ব এতোটুকু কমেনি। সংস্কৃতি এবং সমৃদ্ধি দু’টোর দিক দিয়েই এগিয়ে যাওয়া এই হিন্দি ভাষার ব্যাপ্তি ঠিক এভাবেই ছড়াতে থাকুক। 

ইতি কথা

চেষ্টা করেছি একটি আর্টিকেলের মাঝেই হিন্দি ভাষার ইতিহাস বিষয়ক সকল তথ্য তুলে ধরার। আশা করি যারা হিন্দি ভাষা ভালোবাসেন এবং এই ভাষা শেখার প্রতি আগ্রহী তারা আর্টিকেলটি পড়ে কিছুটা হলেও উপকৃত হবেন। আপনার জানার ইতিহাসটুকু যেনো আরো বিস্তৃত হয় সে কামনা করেই আজকের মতো বিদায় নিচ্ছি। ভালো থাকুন এবং প্রতিটি ভাষার সঠিক ইতিহাস জানার চেষ্টা করুন।

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *